Sunday 6 October 2013

বৃষ্টিভেজা রোববারের কিছু কথা আর গপ্পো



দেবীপক্ষের তৃতীয়া তথা রোববারের সকাল, অথচ আলো-ঝলমলে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলার বদলে দিনটা শুরু হয়েছে বাদামি-ধূসর মেঘে ঢাকা আকাশ থেকে অবিরাম চলতে থাকা টিপটিপ বৃষ্টি দেখতে-দেখতে| মর্নিং ওয়াক হয়নি, তবে অন্যান্য আবশ্যিক কর্তব্য-গুলো হয়ে গেছে (স্নান ইত্যাদি)| আচ্ছা, যতো ল্যাদ-ই খাই না কেন, দাড়ি কামিয়ে ফিটফাট না হয়ে বসলে আমার এই যে প্রবল অস্বস্তি, এটা কি বয়সোচিত পিটপিটানি, না কি বারো বছরের অফিসার-জীবন আমাকে এই ভাবেই ভাবতে বাধ্য করে? কে জানে| এটুকু বলতে পারি যে এককালের ফ্যান্টাসি-গুলো (রোববার মানে স্নান না করে ডিওডেরান্টের নতুন প্যাক খোলা, অবশ্যই দাড়ি না কামানো, বিছানায় গড়ানো আর বই নিয়ে এপাশ-ওপাশ করা) এখন বউ-এর তাগাদা বা চ্যাঁচামেচি ছাড়াই কোথায় যেন উবে গেছে| আর কী-কী এই ভাবে শূন্যে বিলীন হয়েছে? একটা তালিকা করা যাক (কোয়ার্টারে গ্যাস-ওভেন কিছুই নেই, ফলে খই ভাজার বিকল্প হিসেবে এটা বোধহয় খারাপ হবেনা, অন্তত রবীন্দ্রনাথ-কথিত জ্যাঠাইমার গঙ্গাযাত্রা-র থেকে এটা ভালো): -
1.   নিজের রোজগার-টা টিউশনি করে উপার্জিত পরিমানের থেকে বেশি হলেই খুশি হবো, কারণ একলা মানুষের প্রয়োজন-মতো বই-সিনেমা-মিউজিক-সিগারেট-[কালেভদ্রে]মদিরা-র জন্যে কতো আর লাগে?
2.  মাসে অন্তত দুদিন হোটেলে গিয়ে কব্জি ডুবিয়ে ভালোমন্দ খাবো|
3.  বিয়ে করবো না, একবারে বাধা-বন্ধহীন ভাবে জীবন কাটাবো|
4.  বানিয়ে-বানিয়ে যে গপ্পো-গুলো বোলে ছোটোদের আনন্দ দিই, সেগুলোকে সাজিয়ে-গুছিয়ে বই আকারে প্রকাশ করবো|
বাকি ফ্যান্টাসি (উর্দু ধার করে খোয়াব বলাই ভালো)-গুলোর কথা ভাবলে এখন হাসি পায়, তবে ৪ নম্বরটা পূরণ হলো না বলে ব্যাপক দুঃখ হয়| বিয়ের জন্যে মেয়ে দেখতে গিয়ে সম্ভাব্য বউ-কে ভূতের গল্প আমি ছাড়া ভূভারতে কেউ শুনিয়েছে বলে মনে হয় না, আর তার পর থেকেই সেই মেয়েটি (মানে এখন আমার বউ) আমাকে ক্রমাগত (১১ বছর হতে চললো সেই আলাপের পর!)খুঁচিয়ে চলেছে এই গল্প-গুলোকে লেখার জন্যে, অথচ এই সাধটা আর মিটিলো না| কেন এটা হলো না তার চটকরে ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল, কারণ আপাতদৃষ্টিতে যে কারণগুলো অনায়াসে উল্লেখ করা যায় (সময়াভাব, ক্লান্তি, সুযোগের অভাব, ইত্যাদি-ইত্যাদি) সেগুলোকে আমার ক্ষেত্রে ঠিক ব্যবহার করা যাবে না| দিনের মধ্যে অন্তত ২ ঘন্টা আমি পাই যখন আমার কিছুই করার থাকে না এবং প্রায় নিরুপায় হয়ে নেট-নিয়ে বসে থাকতে হয়| ক্লান্তির জন্যে আজ অবধি আমার কোনো কাজ আটকায় নি, যদিনা নিজেই সেটাকে একটা বাহানা হিসেবে নিজের কাছে ব্যবহার করতে ইচ্ছুক হয়ে থাকি| সুযোগের অভাবের ব্যাপারটা একটু আগে সময়ের ব্যাপারে আমার দেওয়া যুক্তির মাধ্যমেই খারিজ করে দেওয়া যায়|

সচরাচর আমি নিজের কাছে যে কারণটা বলে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করি সেটা হলো: ৮ বছর ধরে “ইউ আর হিয়ারবাই ডাইরেক্টেড....” গোছের লেখা পড়ে আর তারপর ৪ বছর ধরে ওই অমোঘ লাইন দিয়ে শুরু হওয়া লেখা লিখে আমার পেনের পিন্ডি চটকে গেছে| ফলে আমি এখন গল্প লিখলে সেটা এরকম হতে পারে:
“দয়া করে গতকাল মেইল মারফৎ পাঠানো নির্দেশ-গুলো পড়ে দেখুন যেখানে আপনাকে বলা হয়েছিলো বেলতলায় যেতে| আমার কাছে সদ্য এই খবর এসেছে যে আপনি উকুন/খুশকি-জাতীয় কোনো সংক্রমণের শিকার হয়ে সম্প্রতি মস্তক-মুণ্ডিত করিয়েছেন| এই অবস্থায় দয়া করে উপরোক্ত মেইলটির মাধ্যমে পাঠানো নির্দেশিকা উপেক্ষা করুন এবং পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা করুন| ইতিমধ্যে বেলতলার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে আপনার সহকর্মী-কে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে| গত এক মাসে ১০ বার ট্র্যাফিক পুলিশের হাতে জরিমানা/অন্যান্য শুল্ক জমা দিতে বাধ্য হওয়ার ফলে সে এখন সব অবস্থায় [এমনকি প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করার সময়েও] হেলমেট পরে থাকে বলে জানা গেছে, তাই বেলতলায় কাজ করার মতো ক্ষমতা তার আছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে করা যাচ্ছে| অতএব, তাকে কৌশলগত পরামর্শ এবং উত্সাহ দেওয়াই এই মুহুর্তে আপনার প্রধান কাজ| এই নির্দেশের প্রাপ্তি-স্বীকার করুন|

এই গল্পটা শেষ অবধি লিখলে এবং রণে-বনে-জঙ্গলে কোনো সম্পাদক একে প্রকাশ করলে তারপর কী হবে সেটা ভেবে যেসব দৃশ্য ও দৃশ্যকল্প (জীবনানন্দর কবিতার ব্যাখ্যামূলক বই পড়লে [সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় বাধ্য হয়ে যা পড়তে হয়েছিলো] যাসব বাঘা-বাঘা বাংলা শেখা যায় না!) চোখের সামনে ভেসে উঠছে তাদের একত্র করলে একটা জম্পেস হরর-স্টোরি হবে| কিন্তু এসব ফাজলামি না করে বরং একটা গোটা গল্প এই সুযোগে লিখে ফেলা যাক:

“ঠিক কবে থেকে যে আমি স্বপ্নটা দেখা শুরু করেছিলাম তা মনে নেই| অনাথাশ্রমের দমবন্ধ করে দেওয়া ঘুপচি ঘরটায় বালিশ, চাদর আর অন্য অনেক কিছুর জন্যে মারামারি আর অন্য সবকিছু শেষ হলে, আমাদের মতো বিজিতদের জন্যে বরাদ্দ কোণ-টায় কোনক্রমে মাথাটা শরীরের মধ্যে গুজে দিয়ে জানালা দিয়ে ভেসে আসা ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শকে কখনো জানতে না পারা মা-র আদর ভেবে যখন দুচোখ বন্ধ করতাম, তখনই স্বপ্নটা আসতো| স্বপ্নটা বড় অদ্ভূত ছিলো, কারণ এতে আমি কাউকে দেখতে পেতাম না, কোনো চলাফেরা বুঝতাম না, শুধু একটা দৃশ্য আমার সামনে ফুটে উঠতো| একটা ধু-ধু ফাঁকা মাঠ, যার একেবারে শেষ সীমায় জলে ভিজে ঝাপসা হয়ে যাওয়া ছবির মতো একটু অস্পষ্ট কম্পমান সবুজের আভাস| কিন্তু এই মাঠের ঠিক মাঝখানে দাড়িয়ে আছে একটা একতলা বাড়ি| বাড়িটা পুরোপুরি ছিরিছাদ-হীন, তায় অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকায় সেটাকে আরও কুত্সিত লাগতো| সূর্য তখন ডুবছে, তার লাল আলোয় মাঠের ধুলোর দিকে তাকালে মনে হতো যেন একটা সমুদ্রের মধ্যে স্থির হয়ে রয়েছে একটা কদাকার জাহাজের মতো ওই বাড়িটা| বাড়িটায় যে কোনো লোকজন নেই সেটা বেশ বোঝা যেতো, কিন্তু ভাঙ্গা দেওয়াল, শিক-দোমড়ানো জানালা আর তার ভেতরে চাপচাপ অন্ধকার থেকে মনে হতো যেন অনন্ত খিদে নিয়ে কোনো এক বিভীষিকা অপেক্ষা করছে ওই বাড়ির ভেতরে অপ্রস্তুত ও অনাহূত প্রবেশকারীদের জন্যে| এই স্বপ্নটা আমি যে কতো বছর ধরে দেখেছি তা আমি বলতে পারবো না, তবে এতিমখানায় আগুন লাগার পর, পুলিশের ভয়ে ফেরার হওয়ার দিন থেকেই স্বপ্নটা গায়েব হয়ে যায়|
তারপর, সত্যিকারের পড়াশোনার স্বাদ পেয়ে নিজেকে আমি অন্য রকম স্বপ্ন দেখাতে শুরু করি| নিজের পায়ে দাড়ানোর পর থেকে যে বিলাসিতাটা আমার হয়েছে, সেটার সৌজন্যেই (শহরের একটা নামকরা পার্লারে চুল কাটানোর ফাঁকে সময় কাটানোর জন্যে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে গিয়ে) আমি বাড়িটার ছবি দেখি, আর সেখান থেকেই ব্যাপারটা আবার শুরু হয়|

ম্যাগাজিনটা আজকের অন্য বাজার-চলতি ট্যাবলয়েড আর ভারিক্কি পিরিয়ডিকাল-গুলোর মধ্যে একটা মাঝামাঝি অবস্থান নিতে চেয়েছিলো বলেই হয়তো ফিচারটা প্রকাশিত হয়েছিলো| চকচকে পাতায় লাস্যময়ী নারীদের হাতে ধরা শেভিং রেজার (এই ব্যাপারটা দেখলেই আমার বেখাপ্পা রকম হাসি পায়, কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখন থাক) আর ক্রেতা-সুরক্ষা বিভাগের বিজ্ঞাপনের মাঝে কোনঠাসা লেখাটার বিষয়বস্তু ছিলো পাশের রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলতে দাঙ্গার ফলাফল, উদ্বাস্তু সমস্যা আর পরিত্যক্ত সম্পত্তি-গুলোর একটা হিসেব-নিকেশ| এই আপাত রস-কষ-হীন বিষয়টিকে একটু পাঠযোগ্য করার জন্যে লেখক একটা স্রেফ আজগুবি গল্পকে ফিচারটায় জুড়ে দিয়েছিলেন, আর তার কেন্দ্রে রয়েছে যে বাড়িটা সেটারই ছবি রয়েছে পাতা জুড়ে| গল্পটার বিষয় এরকম: এই বাড়িটি একটি বহু পুরনো পরিবারের বাসস্থান ছিলো| দাঙ্গায় পরিবারটি নিঃচিহ্ন হয়, এবং তারপর থেকে বাড়িটি পরিত্যক্ত| স্থানীয় মানুষদের ধারণা এই যে বাড়িটিতে বাস করে এক ভয়ংকর অপদেবতা, এবং ওই পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কারো ওই বাড়িতে প্রবেশাধিকার নেই| আজ পর্যন্ত নিয়ম-সংগত (দাঙ্গায় যদি তেমন কিছু আদৌ থেকে থাকে) ও বে-আইনি ভাবে ওই বাড়িতে যেই ঢুকেছে তারই মৃত্যু হয়েছে অত্যন্ত রহস্যজনক ভাবে| পুলিশ থেকে শুরু করে এলাকার শাসক দলগুলো, সব্বাই বাড়িটা এড়িয়ে চলেছে| লেখক সরস মন্তব্য করেছেন যে পাছে স্থানীয় মানুষেরা তাকেও একজন দখলদার বলে ভেবে নেয়, তাই তিনি ওই বাড়িতে ঢোকেননি, তবে দুঃসাহসী মুক্তমনা মানুষদের এই চ্যালেঞ্জ নেওয়া উচিত, যাতে দাঙ্গা-দীর্ণ এই এলাকায় অন্তত কুসংস্কারের দাপট-টা কিছু কমে| আমি নিজেকে বেপরোয়া বা মুক্তমনা বলে ভাবি না, তাছাড়া শৈশব থেকে টিকে থাকাটাই চ্যালেঞ্জ ভেবে এসেছি বলে নতুন করে কারো কাছে আমার কিছু প্রমাণ করার নেই| কিন্তু বাড়িটা আমাকে চুম্বক যেমন করে লোহাকে টানে তেমন করে টানছিলো| ওই এলাকায় আমি কস্মিনকালেও যাই নি, দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকা থেকে আসা আরো বেশ কিছু অনাথের সঙ্গে আলাপ হলেও এমন কিছু নিয়ে কথা বলার কোনো সুযোগ-ও আমরা পেতাম না, তাহলে স্বপ্নে ঠিক এই বাড়িটাই আমি কীভাবে দেখতাম? চুল কাটানো মাথায় উঠলো, পার্লার ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম ওই ম্যাগাজিন-টির স্থানীয় অফিসে যাবো বলে|

ফিচারটির লেখকের সঙ্গে কথা বলে, আমি যে “চ্যালেঞ্জ-নিতে ইচ্ছুক অন্যান্য উজবুক”-দের থেকে আলাদা সেটা বুঝিয়ে, বাড়িটার সঠিক অবস্থান জেনে, সেই জেলাসদর-এর জমি-বাড়ি রেজিস্ট্রেশনের অফিসে গিয়ে, সেখান থেকে বাড়িটির বর্তমান নিয়ম-সঙ্গত মালিকের নাম-ঠিকানা জানতে গিয়ে (দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকায় সরকারি দফতর থেকে কাজ আদায় করা যে কী বস্তু তা নিশ্চই আলাদা করে বুঝিয়ে বলতে হবে না) আমার যে অভিজ্ঞতা হলো তা গুছিয়ে লিখবার চেষ্টা করলে দিন কাবার হয়ে যাবে, তাই সোজাসুজি মালিক (আপাততো এই নামটাই চলুক)-এর সঙ্গে সাক্ষাতকার-এর প্রসঙ্গে আসছি|

মালিক-এর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে প্রথমেই আমাকে যেটা অবাক করলো সেটা হলো ভদ্রলোকের রাগ| ভূতুড়ে বাড়িতে অনুসন্ধান চালাতে আগ্রহী-দের সম্মন্ধে সংশ্লিষ্ট বাড়িওয়ালা-র মনোভাব কেমন হতে পারে সেটা আমি কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম, কিন্তু ভদ্রলোকের রাগের মধ্যে বিরক্তির থেকে ভয়ের মাত্রাটা অনেক বেশি ছিলো বলে আমি অবাক হয়েছিলাম| উনি প্রথমেই আমাকে শাসিয়ে ও ধমকে প্রতিপন্ন করতে চাইলেন যে ওই বাড়িটির ওপর সম্পূর্ণ এক্তিয়ার ওনার, এবং আদালত থেকে সেই মর্মে উনি দস্তুরমত ডিক্রি নিয়ে রেখেছেন| আমি এটা জানতাম যে আমার স্বপ্নে-দেখা-বাড়ি-র কথা বললে উনি আমায় পাগল ভাববেন, তাই ওসব না বলাই ভালো| আমি নিজেকে একজন কৌতুহলী এবং কুসংস্কার-বর্জিত পাঠক বলে পরিচয় দিলাম, কিন্তু তাতে আশ্বস্ত না হয়ে, সাধারণতঃ (মেয়ের জন্যে সম্মন্ধ করতে না বসলে) লোকে যা করে না, উনি এবার সেটাও করলেন, মানে একেবারে জেরা করার স্টাইলে আমার বংশ-পরিচয় নিয়ে পড়লেন| অন্যদের সংগে ভাব জমানোর জন্যে যে কৃত্তিম বংশপরিচয়-টা আমি ব্যবহার করি (এক অনাথ-কে যে চট করে কেউ কাজ দেবে না তা জানতাম বলে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে এটা আমায় তৈরি করতে হয়েছে) সেটা এক্ষেত্রে কাজে লাগলো, এবং দীর্ঘদিনের অভ্যাস থাকার ফলে মালিকের প্যাঁচালো প্রশ্ন-গুলোরও সন্তোষজনক উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হলো| তারপরেও উনি বেশ গম্ভীরভাবে জানালেন যে উনি আমার অনুরোধ নিয়ে ভেবে দেখবেন এবং এক দিন পর আমায় জানাবেন| আমি যে ব্যবসাটা করি সেটা যেহেতু ইন্টারনেট আর ফোন-এও চালানো যায় (অন্ততঃ স্বল্পকালীন-ভিত্তিতে), সেহেতু আমি হোটেলে থাকার মেয়াদ কদিনের জন্যে বাড়িয়ে দিলাম|

পরদিন আমি মালিকের কাছ থেকে ফোন পেলাম| বেশ খুশিয়াল গলায় উনি জানালেন যে আমি যে শহরের বাসিন্দা সেখানে খোজ-খবর নিয়ে উনি নিশ্চিন্ত হয়েছেন যে আমি নিজের সম্মন্ধে যা বলেছি সেগুলো সত্যি এবং আমি ‘অন্যদের মতো’ সম্পত্তি দখল করতে আসা একজন মতলববাজ নই| উনি এও জানালেন যে দুদিন পর উনি নিজে আমাকে ওই বাড়িতে নিয়ে যাবেন| ভদ্রলোকের গলায় একটা অদ্ভূত লোভের আভাস ছিলো যেটা আমাকে বেশ অবাক করলো, তবে আমি সেটাকে এই বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম যে বাড়িটা নিয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধারণাগুলো কাটলে নিশ্চিতভাবেই ওনার সম্পত্তির মূল্য বাড়বে, আর তাই ভেবে উনি একটু বেশি উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন| আমি এটাও জানতাম যে যাই ঘটুক না কেন, ওই বাড়িতে গিয়ে সামনে থেকে বাড়িটা না দেখা অবধি আমি শান্তি পাবো না, তাই নিজের ভাবনা-গুলোকে অনর্থক আমল দিয়ে লাভ হবে না|

সেদিন সকাল থেকে চলতে থাকা দুর্যোগ যখন থামলো তখন রোদের রং হলুদ থেকে কমলা হয়ে লালের দিকে যাচ্ছে| অন্ধকার হওয়ার আগে বাড়িটার কাছে পৌছনোর অনেক চেষ্টা করেও যখন শেষ অবধি মালিকের গাড়ি আমাদের মাঠের শেষ সীমায় পৌছে দিলো তখন পুরো মাঠটা ডুবতে থাকা সূর্যের লাল আলোয় ভেসে যাচ্ছে, আর আমার স্বপ্নের নিখুত অথচ বাস্তবায়িত চিত্ররূপ হয়ে লাল সমুদ্রের বুকে ভেসে থাকা একটা কদাকার জাহাজের মতো দাড়িয়ে আছে বাড়িটা| এতো কাছে এসে আমার বুকটা এক অজানা আশংকায় কেঁপে উঠলো, তবু মালিকের পেছনে থেকে আমিও বাড়িটার দিকে এগোলাম| দরজার একদম কাছে এসে মালিক আমায় বললেন বাড়িতে ঢুকতে| আমি স্বাভাবিক ভদ্রতার বসে ওনাকে বলতে বাধ্য হলাম যে উনি আগে ঢুকে আমাকে আমন্ত্রণ জানালে ব্যাপারটা যথাযথ হবে, কিন্তু এই কথাটা শুনেই উনি খেপে উঠলেন| নিজের পকেট থেকে একটা দেশি পিস্তল (দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকায় এগুলো খুব দুর্লভ নয়) বের করে উনি যখন হিংস্রভাবে আমায় বাড়িতে ঢুকতে বলছেন, তখনই ঘটনাটা ঘটলো|

পুলিশ, ডাক্তার, সাংবাদিক, দফায়-দফায় এদের সবার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ফাঁকে আমি নিজেও অনেক বার ভাবার আর বোঝার চেষ্টা করেছিলাম যে সেদিন ওই বাড়িটার দরজার সামনে ঠিক কী হয়েছিলো| ব্যাপারটা যথাসম্ভব গুছিয়ে বলতে গিয়ে প্রত্যেক বারেই মনে হয়েছে এমন একটা আজগুবি গল্প বললে পাগলা-গারদ ছাড়া অন্য কোথাও আশ্রয় জুটবে না, তাই বিশ্বাসযোগ্য একটা উত্তর-কেই বারবার আমি আউড়ে গেছিলাম, কিন্তু এতোদিন কেটে যাবার পর বুঝতে পারছি যে অন্ততঃ নিজের কাছে সত্যিটা স্বীকার করা উচিত, তা যতোই অবিশ্বাস্য শোনাক না কেন|

মালিক যখন আমার দিকে পিস্তলটা তাক করে আমায় বাড়িটায় ঢুকতে বলছেন, ঠিক তখনই বাড়িটার ভেতরে জমে থাকা অন্ধকারটা জমাট বাঁধতে শুরু করেছিলো| সূর্যের আলোটা যদি আমার চোখে পড়তো তাহলে এই অদ্ভূত ও অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা আমার দেখতে পেতাম না, কিন্তু আমি তখন ছায়ায় দাড়িয়ে ছিলাম যেখানে তখনই তরল অন্ধকারের রাজত্ব শুরু হয়ে গেছে| তার একটু পরেই (মিনিট-সেকেন্ডের হিসেব রাখার অবস্থা তখন আমার ছিলো না) সূর্যটা ডুবলো, আর বাড়ির ভেতর জমে থাকা জমাট অন্ধকারটা স্রোতের মতো বেরিয়ে এসে মালিকের শরীরটাকে ঘিরে পাক খেতে শুরু করলো| মালিকের মুখ থেকে রুদ্ধ-স্বরে একটা অদ্ভূত আর্তনাদ আমি শুনেছিলাম: “আমায় নয়, ও’কে! ও’কে এনেছি!”, তারপর আমি ছুটতে শুরু করেছিলাম| প্রতি মুহুর্তে মনে হচ্ছিলো যে অন্ধকারটা আমায় গ্রাস করবে, কিন্তু তবু মাঠের প্রান্তে দাড়ানো গাড়িটার দিকে দৌড়তে-দৌড়তে আমি একবার পেছন ফিরে তাকিয়েছিলাম, এবং এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখেছিলাম| দেখেছিলাম যে বাড়িটার দরজার সামনে দু-পায়ে দাড়ানো কোনো প্রাগৈতিহাসিক মানবের মতো জমাট বেধে রয়েছে অন্ধকার, কিন্তু সেটি স্থির হয়ে নেই, বরং ভেঙে-চুরে যাওয়া হাত-দুটো নেড়ে সে আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে| এরপর, হাসপাতালে জ্ঞান হওয়ার আগে, আমার আর কিছু মনে নেই|

পুলিশি জেরার মুখোমুখি হওয়ার আগে একজন সহানুভূতিশীল নার্স পেয়েছিলাম বলে যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর-টা সাজাতে আমার অসুবিধে হয় নি| নার্সের কাছ থেকেই আমি জেনেছিলাম যে ওই বাড়িটির সামনে একটা ছাদের অংশ ভেঙে পড়েছিলো, তার নিচেই মালিকের থেতলে যাওয়া শরীরটা পাওয়া যায়| আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় গ্রামবাসীরা প্রায় মাঠের শেষ সীমায়, গাড়িটার কাছেই| জেরার জবাবে আমার উত্তর এটাই ছিলো যে ছাদটা হঠাত ধসে পড়তে দেখে আমি সাহায্য আনার জন্যে গাড়ির দিকে ছুটেছিলাম, কিন্তু চোখের সামনে এমন একটা ঘটনা দেখে স্নায়ুর ওপর চাপ নিতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম| পুর্লিশ আমায় মৃত্যুর জন্যে দায়ী ভেবে সন্দেহ করলেও বাড়িতে আমার ঢোকার কোনো প্রমাণ পায়নি, আর রিমোট-কন্ট্রোলে ছাদ ধসানোর তত্ব তাদের পক্ষেও বাড়াবাড়ি হয়ে যেতো বলে শেষ অবধি আমি আমার শহরে ফিরে আসতে পারি| তারপর, অনেক দিন ধরে, একটু-একটু করে নিজের জীবনকে ফিরে পাওয়ার এবং আরও বড় করার লড়াই-এর চাপে যখন পুরো ব্যাপারটাকে একটা দুঃস্বপ্ন ভাবতে শুরু করেছিলাম, তখন-ই, আবার সেই পার্লারে, সেই ম্যাগাজিনের অন্য একটি সংখ্যায় একটা ছবি দেখে, সব কিছু মনে পড়ে গেলো|

এবারের ফিচারটা ছিলো পুরোপুরি ‘সেনসেশনাল’| বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও প্রাচীন পরিবার নিজেদের সপত্তিকে অনধিকারী-র কবল থেকে দুরে রাখার জন্যে কতো রকম অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারের আশ্রয় নিয়েছে, সেটাই ছিলো ফিচার-টায় উল্লিখিত বিভিন্ন ঘটনার ও কিংবদন্তির বিষয়| এমন-ই একটি পরিবারের অতি দূর সম্পর্কের তথা শেষ সন্তান হিসেবে পত্রিকায় যার ছবি বেরিয়েছিলো সে আর কেউ নয়, সেই মানুষটি যাকে আমি এতোক্ষণ মালিক বলে সম্বোধিত করে এসেছি| তার প্রসঙ্গে লেখা হয়েছিলো লতায়-পাতায় জড়ানো সম্পর্কের সৌজন্যে পাওয়া একটি বাড়িকে তিনি মনে-প্রাণে অভিশপ্ত বলেই মানতেন| তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে ওই বাড়ির রক্ষক এক অপদেবতার কাছে পরিবারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক-নেই এমন কাউকে উত্সর্গ না করলে ওই বাড়িতে বসবাসের অধিকার পাওয়া যায় না, আর সেই বিশ্বাসের বশে তিনি অসংখ্য নিরাশ্রয়-কে ওই বাড়িতে কোনো-না-কোনো ভাবে পাঠিয়েছিলেন, ঘটনাক্রমে যাদের প্রত্যেকেরই ওই বাড়িতে অদ্ভূত-ভাবে মৃত্যু হয়েছিলো (এই জায়গাটায় এসে ফিচারের লেখক যে বেশ দ্বিধান্বিত হয়েছিলেন সেটা লেখা থেকে সহজবোধ্য, কারণ মালিক-কে ঘুরিয়ে খুনি বলতে গেলেও অপদেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে হয়!)| কিন্তু একবার, অন্য রাজ্য থেকে আসা এক ভিনদেশি-কে ওই বাড়িতে নিয়ে যাবার সময়, বাড়ির ছাদ ভেঙে তার মৃত্যু হয়| সেই বাড়ি পরে সেনাবাহিনীর চাঁদমারি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, আর এখন সেসবই ধংসস্তুপ| ফিচারটা পড়ে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম| গত-জন্মের স্মৃতির মতো মনের গভীর থেকে হঠাত উঠে এলো সেই দিনটা, আর তার সঙ্গেই ফিরে এলো আরো অনেক আগের অস্পষ্ট কুয়াশার মতো কিছু দৃশ্য: আগুন জ্বলছে, চারদিকে রক্ত আর আর্তনাদের মধ্যে আমি ধুলোয় বসে আছি, আর একটা লোক (যাকে দেখতে অনেকটা আয়নায় দেখা আমার মতো, কিন্তু অনেক ভারিক্কি আর বেশি বয়সের) আমায় বলছে, “তুই ফিরে আসবি| এসব তোর জন্যে থাকবে|” আর তারপরেই রক্ত, কয়েকটা লোকের হিংস্র হাসি, আর আমাকে নিয়ে লোফালুফি করতে-করতে লোকগুলোর চলে যাওয়া, আর তারপর শুধু অন্ধকার| আমার মনে পড়লো বাড়িটার সামনে দাড়ানো জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে থেকে আমার উদ্দেশ্যে হাতছানিটার কথা| তাহলে কি সেদিন বাড়ির রক্ষক পরিবারের সত্যিকারের উত্তরাধিকারীকে খুঁজে পেয়েছিলো?”

গল্প শেষ, সকাল ফুরিয়ে ঘড়ির কাটা-ও ঘনায়মান বিকেলের দিকে ইংগিত করছে| অতঃপর, আজকের মতো এখানেই শেষ করি| নজর রাখুন পরের ব্লগের দিকে|