Sunday 28 December 2014

রাজভাষা, রাজধানী আর ঢেঁকি ও ধান

প্রায় মাসখানেক ধরে গুয়াহাটি তথা অফিসের ঘানি পিষতে পিষতে যখন নিজেকে বেশ একটা গার্হস্থ্য আর বাণপ্রস্থের মাঝামাঝি স্তরের আশ্রমিক ভাবতে শুরু করেছি, তখনই সমন (শমনও বলা চলে) এসে পৌঁছল ক'দিন আগে। রাজভাষা (একে নিছক হিন্দি বললে চলবে না। হিন্দি বলা হয় বলিউডি মশলাদার সিনেমায়। সরকারি কাজে যে দুর্বোধ্য এবং কার্যত অর্থহীন ভাষাটি ব্যবহার করতে কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তর এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করা হয়, এ হল সেই ভাষা।) বিষয়ক সংসদীয় সমিতি আগামীকাল ২৯শে ডিসেম্বর আরও পাঁচটি সংস্থার সঙ্গে আমাদের অফিসেও কাজকর্মে রাজভাষার ব্যবহার নিয়ে নিরীক্ষণ (হুঁ হুঁ বাবা, গোদা ভাষায় ইন্সপেকশন বললে কি আর এমন একটা শিরদাঁড়া-দিয়ে-হিমেল-স্পর্শ গোছের অনুভূতি হত?) করবেন। তবে সাংসদদের দয়ার শরীর, তার ওপর অসম এই মুহূর্তে বেড়াবার পক্ষে মোটেই সুবিধের নয়। তাই এই নিরীক্ষণ হবে রাজধানী-তে। অতঃপর বাঙালের রাজধানী আগমন, সকাল থেকে কুয়াশা আর শীত উপেক্ষা করে বধ্যভূমি (মানে কাল যেখানে যেতে হবে) খুঁজে বের করা এবং মিটিং করা। এই সব করতেই বেলা দু'টো বাজলো। লাঞ্চ সেরে মনে হল যে হোটেলে পড়ে থেকে কচু হবে। তারপর, দস্যু মোহনের ভাষ্য ঝেড়ে বললে: "কী হইতে কী হইয়া গেল!", দেখলাম যে আমি বেঙ্গল এসোসিয়েশন দ্বারা আয়োজিত চতুর্দশ বইমেলার সামনে পৌঁছে গেছি। আর তারপর যা হবার তাই হল। দু হাতে মোট সাতটা প্যাকেট আর মুখে লাজুক হাসি (আজ্ঞে হ্যাঁ, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে, সর্বত্র বই কিনলে আমার একটু লজ্জা করে, বাড়িতে গিয়ে শ্রীমতীর সামনে পড়ার সম্ভাবনা থাকলে ভয়ও করে) নিয়ে যখন গাড়িতে বসলাম, তখন আমার সঙ্গে থাকা প্রবীণ অ্যাসিস্টেন্ট ডাইরেক্টর আব্দুল হাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আগের বার বুকশেলফ গুলো ওনার পরিচিত দোকান থেকেই নিয়েছিলাম তো......।

তবে, যদিও এই মেলায় আমার এই প্রথম আসা, মেলাটার বেশ কয়েকটা বিশেষত্ব আমার নজরে পড়ল। ভুল হবার সম্ভাবনা খুব বেশি, তবু আমার মনে হল: -
১) কলকাতার মেলা যদিও তৃণমূলের একটা শিবিরে পরিণত হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে, এই মেলার চরিত্রটা কিন্তু এখনও বামপন্থী রয়েছে। এই বামপন্থা সি.পি.এম বা ফরোয়ার্ড ব্লকের শেষ দিককার ধান্দাবাজি আর লুম্পেন-ভিত্তিক রাজনীতি নয়, বরং মুক্তচিন্তা আর সংস্কৃতি-নির্ভর সেইসব চিন্তার কম্পন বহন করছে, একসময় আমরা যার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম।
২) এই মেলায় বিভিন্ন স্টলের দায়িত্ব যাঁদের কাছে ছিল, তাঁরা পেশাদার বিক্রেতা নন। তাই স্টলের তুলনায় অনেক সময়েই তাঁদের মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছিল পাশের মঞ্চে চলতে থাকা ক্যুইজ, যাতে বাঙালির একেবারে প্রাণের বিষয় নিয়ে চলছিল প্রশ্নোত্তর। তবে আমার সেটা ভালই লাগছিল, কারণ আমি নিজেও সোৎসাহে কান পেতেছিলাম ওই দিক তাক করেই। মাঝে যখন "এই পথ যদি না শেষ হয়" গানটা কোন সিনেমার, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে বেশ কয়েকটি দল ব্যর্থ হল, তখন "নামিয়ে দিন" বলে আমিও চেঁচিয়েছিলাম।

যাইহোক, বইমেলার উদ্দেশ্যে তো আর "আবার এসো মা" বলা যায়না। তাই বইগুলো ব্যাগে ভরি (প্লেনে এই অতিরিক্ত ওজনটা কীভাবে চেক-ইন্ করানো যায়, সেটাও ভাববার বিষয়), আর আজকের দুপুর-গড়িয়ে-সন্ধে কাটান সময়টা মনে রেখে দিই।

Wednesday 3 December 2014

দাড়ি-গোঁফ এবং ডিসেম্বর রাতের স্বপ্ন

ছেলে/পুরুষ-এর যদি দাড়ি-গোঁফ না থাকে, তবে তার অবস্থা যে কি করুণ হয়, তা সকলেই জানেন| কোথাও একটা পড়েছিলাম যে ভীমসেন [জোশি নন, মধ্যম পাণ্ডব-এর কথা বলছি (অবশ্য তিনিও যথেষ্ট ‘জোশি’ ছিলেন বলেই জানা যায়)] মাকুন্দ ছিলেন| তারপরেও যে তিনি শুধু দুর্যোধন-দুঃশাসন-কীচক প্রমুখের ওপরেই নিজের বাহুবল দেখিয়েছিলেন, কোনো মাস-মার্ডারার হয়ে যাননি, এ থেকেই তাঁর সংযমের প্রভূত পরিচয় পাওয়া যায় [এও বোঝা যায় যে মহাপ্রস্থানের পথে তাঁর পতন তাঁর অতিভোজনের জন্যে নয়, অন্য কোনো কারণে হয়েছিলো| সি.বি.আই না এস.আই.টি? হমমমম...]| কিন্তু একবার গজালে, এবং গজাতে থাকলে, দুটি বস্তুই ‘কাফি তকলিফ’-দেয়| গোঁফ-কে অনেক যত্নে রাখতে হয়, যাতে তার একদিকের দৈর্ঘ্য/প্রস্থ অন্যদিকের থেকে আলাদা না হয়, যাতে তাতে ক্রমে দৃশ্যমান হওয়া সাদা/ধূসর কেশ (অন্য কী টার্ম ব্যবহার করা যায় তা বুঝে পেলাম না| মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু আমরা...) খুব বাজে একটা এফেক্ট না আনে, ইত্যাদি-ইত্যাদি| আর দাড়ি মানে এক বিদিকিচ্ছিরি ব্যাপার| রোজ সকালে ফেনা-জল-সময়ের শ্রাদ্ধ করে ওটিকে নির্মূল না করলে গাল কুটকুট করবেই; একমাত্র রেহাই মিলতে পারে যদি ওটিকে নির্বিবাদে বাড়তে দেওয়ার অভ্যাসটি বজায় রাখা যায়| অনেক মুসলিমকে দেখেছি এই সমস্যাটার মোকাবিলা করার জন্যে গোঁফ উড়িয়ে শুধু দাড়ি লম্বা করতে (এর পেছনে কি কোনো ধর্মীয় কারণ আছে? হতেও পারে| একাধিক মানুষের মুখে শুনেছি যে ইসলাম নাকি সবথেকে বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম| তাতে হয়তো পুরুষের এই দ্বিবিধ সমস্যার এই বিশেষ সমাধান করে দেওয়া আছে|), কিন্তু আমার যেহেতু ওই লুক-টা অসহ্য লাগে, তাই ওই বিশেষ সমাধানটাও আমার কোনোকালেই মনঃপূত হয়নি| এদিকে শীতের সকালে রোজ এই হাঙ্গামা আর পোষাচ্ছিলো না| তাই কাল রাতে শুতে যাওয়ার আগে এর সমাধান ভাবার চেষ্টা করছিলাম|

আমার এয়ারফোর্স প্রত্যাগত বাবা এই সমস্যার সমাধান করেছিলেন দাড়ি ও গোঁফ দুইই কামিয়ে| সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, উত্তম কুমার, সৌরভ গাঙ্গুলি: এঁরা প্রত্যেকেই সেই পথেই হেঁটেছেন| কিন্তু এঁদের মুখের এমন একটা ব্যাক্তিত্ব আছে যে গোঁফ ছাড়াও এঁদের ভালো লাগে| আমি গোঁফ কামালে নিজেই নিজের মুখের দিকে তাকাতে পারবো না, বাকিরা যে কী পরিমাণ হাসাহাসি করবে তা তো সহজেই অনুমেয়| অতঃপর একটিই উপায়: গোঁফ ও দাড়ি দুটিকেই অবাধে বাড়তে দেওয়া| এই সমাধানটা আমার বেশ পছন্দ হলো| একদিকে রবীন্দ্রনাথের শান্ত-সৌম্য মুখ, অন্যদিকে আমার একগাল দাড়ি দেখে শ্রীমতীর মেজাজ কেমন হবে, এই নিয়ে ভেবে বেশ মুচকি-মুচকি হেসে ঘুমের সাধনা করলাম| কিন্তু তারপর....?

কোনো একটা বই-এ পড়েছিলাম (এইসব নাম মনে রাখতে পারলে ফুটনোট-টীকা সহযোগে এগুলোকে প্রবন্ধ বানানো যেতো, কিন্তু আমার আলসেমি নিয়ে আর কীই বা বলার আছে?) যে স্বপ্নে নাকি অবচেতন মন আমাদের এমন অনেক সত্যের সন্ধান দেয়, যা আমরা সচেতন ভাবে ভাবতে পারিনা| ঠিক তাইই হলো কাল রাতের স্বপ্নে| আমার ক্রম-পশ্চাদগামী কেশরেখা (গোদা বাংলায়: রিসিডিং হেয়ারলাইন)-র কথাটা আমি খেয়াল রাখিনি বা রাখতে চাইনি| স্বপ্নে দেখলাম যে আমাকে দেখতে রবীন্দ্রনাথ নয়, শুভাপ্রসন্নের মতো দেখাচ্ছে!

ঘুম ভাঙার পর যে টুথব্রাশ-এর বদলে শেভিং রেজর হাতে উঠেছিলো, একে কি অস্বাভাবিক বলা যায়?

Monday 1 December 2014

কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান: পূজাবার্ষিকী ২০১৪

আমাদের ছোটবেলায় সবথেকে সম্ভ্রমের চোখে যে শারদীয়া সংখ্যাটাকে দেখা হতো, সেটা হলো “কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান”| এখনকার ছোটরা এই পত্রিকাটিকে ঠিক কী চোখে দেখে তা আমার জানা নেই, কারণ, খুবই দুঃখের সঙ্গে হলেও স্বীকার করতেই হচ্ছে যে আমার চেনা-পরিচিতের মধ্যে আমি একটিও ‘ছোটো’ মানুষকে চিনি না (আমার মেয়ে সহ) যে পূজাবার্ষিকী পড়ে| তবে এই পত্রিকার এবছরের পূজাবার্ষিকী পড়ে আমার মতামত নিচে পেশ করলাম:
1.      যে পত্রিকার সবথেকে আকর্ষণীয় বিষয় হলো সতজিত রায়-এর “স্বপ্নদ্বীপ” (সুচিপত্রে তাও আবার ভুল বানানে ছাপা হয়েছে), সিদ্ধার্থ ঘোষ-এর “ঝন্টুমামার ছাঁকনি” আর সুধীন্দ্র সরকার-এর “প্রফেসর ব্রহ্ম ও কালোচিতা” [দুটিই এই পত্রিকার বছর ত্রিশেক পুরনো সংস্করণ থেকে নিয়ে আবার ছাপানো], তার অবস্থা নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই|
2.      নতুন লেখকদের মধ্যে শান্তনু বসু-র “অনাদি অধিকারীর একোয়াস্কোপ” আর নবকুমার দাস-এর “বক্সা রহস্য” সম্পাদকীয় স্পর্শ পেলে আরও উপভোগ্য হতো, এবং এঁদের আরও লেখা পড়ার ইচ্ছে রইলো|
3.      রাজেশ বসু-র নানা “গুণ”-এর কথা এর আগে অন্যান্য লেখকদের কাছ থেকে জেনেছি, তবে যেটা সত্যিই কৌতূহল উদ্রেক করে সেটা হলো: কোন লবির জোরে এই লোকটির লেখা বাংলার প্রায় সব ক’টি পাবলিশিং হাউস ছেপেই চলে, যেখানে সত্যিকারের ভালো এবং পাঠক-সমাদৃত লেখা পড়ে থাকে ছাপাখানা আর সম্পাদকের টেবিলের মাঝের ব্ল্যাক হোল-এ?
4.      পার্থজিত গঙ্গোপাধ্যায় (ইনিও আর একজন “শক্তিশালী” লেখক, যাঁর সম্পূর্ণভাবে খড়-ভুষি-তুল্য লেখাও পত্র ভারতী থেকে বই আকারে প্রকাশিত)-কে খুব ঠান্ডা মাথায় বোঝানো দরকার যে মাধ্যমিকের জন্যে লেখা রচনা ছাপাতে হলে (এই সব বিদ্বদজনের যা লবি থাকে তাতে এঁদের ধোপার জন্যে বানানো তালিকাও ছাপা হবে) তাকে “বিজ্ঞানভিত্তিক উপন্যাস” বলে মিথ্যা-ভাষণের কোনো প্রয়োজন নেই| বাংলার অভাগা খোকাখুকুরা রচনা-জ্ঞানেই ওই লেখা পড়ে ফেলবে|

সামগ্রিকভাবে আমি এই কথাই বলবো যে গত বছরের শারদীয়া সংখ্যাতেও রাবিশ বোঝাই ছিলো, তবে সৈকত মুখোপাধ্যায়-এর নিপুণ “সোনালি পশম” আর অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী-র “নিয়ম যখন ভাঙে” পড়ে মুখ থেকে বেরিয়েছিলো: “বাঃ”| এবারের সংখ্যাটি পড়ে যা বেরিয়েছে তা লেখার কোনো প্রয়োজন নেই| আমি এই পত্রিকাটির শারদীয়া সংখ্যা আর পড়বো না|