Wednesday 30 December 2015

মহাভারত ও সৌরভ মুখোপাধ্যায়

ঠাকুর্দার মুখে শুনেছিলাম যে দেশভাগ, এবং উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে আসার আগে, আমাদের পারিবারিক পেশা নাকি ছিল পৌরোহিত্য ও কথকতা| পরবর্তীকালে রুজির বন্দোবস্ত করার জন্যে পরিবারের সদস্যদের নানা পন্থা বেছে নিতে হলেও এটা আমি ছোটোবেলাতেও দেখেছিলাম, যে অবিভক্ত গাঙ্গুলি-পরিবারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এমনকি রসিকতার ছলেও পৌরাণিক প্রসঙ্গ এসে যায়| খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার হাতে, কার্যত অক্ষর-পরিচয়ের পরেই, এসেছিল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছেলেদের রামায়ণ আর ছেলেদের মহাভারত| প্রথমটি সেই শৈশবেই কিঞ্চিৎ সরলীকৃত (অতএব তুচ্ছ) ঠেকলেও শেষোক্ত মহাকাব্যটি আমাকে যুগপৎ কৌতূহলী ও বিস্ময়বিহবল করে তুলেছিল তার জটিলতায়, যার কাছে ঠাকুমার সঙ্গে সিনেমা (রাজা হরিশ্চন্দ্র, সীতার বনবাস, ইত্যাদি) দেখতে গিয়ে মোকাবিলা করা নানা ঘটনাক্রম নিতান্তই তুশ্চু বলে মনে হত| বয়স বাড়ার সঙ্গে প্রথমে পড়লাম অমর চিত্র কথা-য় খণ্ড-খণ্ড আকারে বিভিন্ন উপাখ্যান, আর তার কিছুদিন পরেই টেলিভিশনের পর্দায় জাঁকিয়ে বসল বি.আর.চোপড়া-র মহাভারত|

স্রেফ গল্প-পড়ার তাগিদে মহাভারতের নানা রকম সংক্ষিপ্ত ও সংক্ষিপ্ততর সংস্করণ এরপর কিনেছি ও পড়েছি, নিজের মতো করে বিভিন্ন চরিত্র ও তাঁদের পরিণতি নিয়ে ভেবেওছি| তবে, এবার ব্ল্যাকবোর্ড পত্রিকার উত্সব সংখ্যার থিম মহাভারত বলে তাতে লেখা পাঠানোর জন্যে, অনেক দিন পর, এই মহাকাব্যটির একটি বিশেষ অংশ নিয়ে পড়াশোনা করতে বাধ্য হই| আর তার পরেই মহাভারতের বৌদ্ধিক দিকটা নিয়ে পড়ার আগ্রহটা আমার মধ্যে ফিরে আসে, যেখানে গল্পের মাদকতার পেছনে ছোটা নেই, নেই চোখ-ধাঁধানো বর্ণনার বিলাসে ডুবে যাওয়া, কিন্তু আছে মানব জীবনের অন্তর্নিহিত অর্থের সন্ধানে স্থিতধী পথচলা|

বাজারে এমন বইয়ের অভাব নেই, যেগুলো মহাভারতের বিশ্লেষণ করে তাতে এমন অনেক লুকিয়ে থাকা মাত্রা ও তাত্পর্যের সন্ধান দিয়েছে, যা এই প্রায় দুই সহস্রাব্দী পার করা মহাকাব্যকেও সম্পূর্ণ নতুন আলোয় দেখতে সাহায্য করে| কিন্তু আমার অবস্থা তখন অঞ্জনের সেই গানের মতো:
আমার শুধু ছিল-আছে কাঠখোট্টা বাস্তবটা, দিবারাত্রি আপোষ আর আপোষ,
রবীন্দ্র কি গণসঙ্গীত কোনটাই ঠিক দিচ্ছিল না, বুকের ভেতর রেগে ওঠার রোষ|
তত্ত্বকথা নয়, আমার মতো পাঁড় গল্পপ্রেমী চাইছিল গল্পের মধ্য দিয়ে সত্যানুসন্ধান, আর সেটি যে কী ভীষণ কঠিন কাজ তা সবাই জানেন| এবার একে সমাপতন বলা উচিত না কপালক্রম তা জানি না, কিন্তু ঠিক তখনই ১৪২২-এর শারদীয়া দেশ-এ প্রকাশিত, আমার অত্যন্ত প্রিয় সাহিত্যিক সৌরভ মুখোপাধ্যায়-এর লেখা, একটি গল্প নিয়ে ফেসবুক তেতে উঠল|

ফেসবুক নামক চায়ের পেয়ালা এসে অবধি তর্কপ্রিয় বাঙালির তুফান তোলার মস্ত একটা জায়গা করে দিয়েছে ঠিকই, তবে এবারের আলোচনাটা ছিল প্রশংসাসূচক| শারদীয়া পড়ার ক্ষেত্রে আমি সচরাচর ভূতের ভবিষ্যৎ-এর রিকশাওয়ালার পদ্ধতি নিই, মানে শিশু-কিশোর সাহিত্যের হলে পড়তেই হবে, অন্য ক্ষেত্রে হামি গরিব আদমি আছে| কিন্তু এই লেখাটা নিয়ে ভালো-ভালো কথা না থেমে চলেছে-তো-চলেইছে, আর এও পড়তে পাচ্ছি যে লেখাটা মহাভারতের একটি বিশেষ মুহূর্ত নিয়ে| যখন এও জানলাম যে এই লেখাটি বিচ্ছিন্ন নয়, বরং এযাবৎ মহাভারতের কোন-না-কোন বিশেষ সময় নিয়ে লেখকের এটি তৃতীয় লেখা, তখন আর পারা গেল না| আমি এমনিতে পি.ডি.এফ-এর মাধ্যমে বই পড়ার বিরোধী হলেও এবার একে-একে ডাউনলোড করতে বাধ্য হলাম শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা ১৪২০, শারদীয়া দেশ ১৪২১, এবং শারদীয়া দেশ ১৪২২. এই তিনটি পূজাবার্ষিকীতে পড়া তিনটি মহাভারতীয় গল্প পড়ে আমার যে প্রতিক্রিয়া, তাই নিয়েই আজকের এই ভ্যাজর-ভ্যাজর|

(১) অবরোহিণী: ২০১৩-য় প্রকাশিত এই গল্প আয়োজিত হচ্ছে মহাভারতের শেষ মুহূর্তে, যখন মহাপ্রস্থানের পথে যুধিষ্ঠির একা রয়েছেন সুমেরুর পথে, আর পতন হয়েছে বাকিদের| কিন্তু এখানেই গল্প বাঁক নিয়েছে এক নতুন দিশায়, যার সন্ধান পেতে গেলে আপনাকে লেখাটা পড়তে হবে| তবে আমার পাঠ-প্রতিক্রিয়া এরকম:
Ø শংকরের লেখায় পড়েছিলাম যে শরদিন্দু তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার আগে সংস্কৃত শেখার| পৌরাণিক লেখার ক্ষেত্রেও যে সেই ঋষিবাক্য কঠোরভাবে পালনীয়, সেটি অক্ষরে-অক্ষরে বুঝলাম এই লেখা পড়তে গিয়ে| এমনিতেই সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের গদ্যভাষা নান্দনিকতার শিখর ছুঁয়েও সহজবোধ্য থাকে বলে আমি তাঁর লেখার ভক্ত| কিন্তু এই সংস্কৃত-ব্যঞ্জনায় মুখর অথচ শাণিত অসির মতো যুক্তিনির্ভর ভাষা পড়ে আমি স্রেফ স্তব্ধবাক হয়ে রইলাম| কিছুক্ষণ কথা বললাম না, ফোন ধরলাম না, স্রেফ পঠনের অভিজ্ঞতাটা ধরে রাখতে চাইলাম নিজের মনে|
Ø লেখাটি বড়ো বেশি একতরফা, এবং বিশালাকার সংলাপ-নির্ভর বলে আমার মনে হয়েছে| শিশিরকুমার দাসের অলৌকিক সংলাপ আমায় মুগ্ধ করেছিল এই জন্যে যে তাতে হেলেনের যুক্তিতে তীক্ষ্ণ ও ক্রোধে উত্তপ্ত প্রশ্ন বা আরোপ, এবং রাম-এর নমনীয়, স্নিগ্ধ, অথচ ভাগ্য-বিড়ম্বিত উত্তর, দুইই ছিল সংক্ষিপ্ত| এখানে সেটা না হওয়ায় রসভঙ্গ হয়েছে বলেই আমার ধারণা|
Ø সর্বোপরি, এক জনকে কুকর্মের চক্রী সাব্যস্ত না করে কথোপকথনটা চালালে তা বোধহয় এই মহাকাব্যের সঙ্গে আরও মানানসই হত| তবে গল্পের পরিণতি, কিছুটা অতিকথিত হলেও, একে এক অন্য স্তরে উত্তীর্ণ করেছে|

(২) উত্তরফাল্গুনি: ২০১৩-র কাহিনি মহাভারতের যে বিন্দুতে সংঘটিত হয়েছে, ২০১৪-র কাহিনি কিন্তু তার তুলনায় পিছিয়ে এসেছে সেই ক্ষণে, যখন দ্বারকা থেকে যাদব কুলনারীরা চলেছে হস্তিনাপুর, অর্জুনের প্রহরায়| এখানেও গল্প বেদব্যাসকে উল্লঙ্ঘন করে চলে গেছে এক অন্য পথে, আর এক্ষেত্রেও আমি পাঠককে লেখাটি পড়ে রসাস্বাদন করতে অনুরোধ করব| ভাষা নিয়ে আমার মুগ্ধতার পুনরাবৃত্তি করব না| তাছাড়া এই লেখাটি আমার কার্যত সর্বাঙ্গসুন্দর লেগেছে| চরিত্রবর্ণন, নির্মেদ ঘটনাক্রম, পরিমিত-অথচ-নির্মোহ সংলাপ, এবং পরনির্ধারিত সর্বব্যাপী অন্ধকারের মধ্যে স্বীয় ভাগ্যনির্মাণের তিমিরবিদারী প্রয়াস: একটি গল্পে লেখকের কাছ থেকে এর বেশি আর কী চাইতে পারি আমি?

(৩) শেষ সূর্যোদয়: ২০১৫-র এই কাহিনি পিছিয়ে এসেছে আরও, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের চতুর্দশ দিনের ভোরে| জ্ঞানী পাঠক চট করে বুঝে নেবেন ঠিক কোন দিনটির সূচনালগ্ন নিয়ে লেখক এবারে আমাদের উপহার দিয়েছেন শক্তি, সাহস, ভীরুতা, প্রেম, লজ্জা, গর্ব, আর অমরত্বের অভিলাষ-পূরণের জন্যে সর্বস্ব পণ করার এক আশ্চর্য উপাখ্যান| আমার প্রতিক্রিয়া? আকাশচুম্বী গিরিশৃঙ্গ থেকে পতনোন্মুখ আরোহী যেমন ভয়ংকর সুন্দরের ডাকে মরণকে উপেক্ষা করে, আমিও তেমন এই গল্পের আপাত-অবাস্তবতা আর নারী চরিত্রটির ম্লান (এবং পার্শ্ব) উপস্থিতি ভুলে এখনও বুঁদ হয়ে আছি তার ভাষা, আর মূল চরিত্রের ট্র্যাজেডির গভীরতায়| কাল সকালে যদি নেশা কাটে, নাহয় আরও কিছু লিখব| আপাতত শুধু এটুকুই লেখার: সৌরভ, আপনার লেখার সুরভি এমনি করেই মহাভারতের বিপুল ঐশ্বর্য আমাদের মতো দীন পাঠকের মাঝে বিলিয়ে দিক, বছরের-পর-বছর|

Wednesday 3 June 2015

রুক্মিণী

খুব সম্ভবত “দক্ষিণের বারান্দা”-তেই পড়েছিলাম যে অবনীন্দ্রনাথ-এর গল্প লেখার সূত্রপাত হয়েছিল একদিন, ভাইবোনদের সঙ্গে দল বেঁধে জোড়াসাঁকোর বাড়ির বারান্দায়, স্বপ্নে দেখা গল্প লিখে| আমরাও স্বপ্নে কত গল্প দেখি| অবশ্য স্বপ্নে আমরা যা দেখি তার বেশির ভাগ গল্পই আমাদের নিজেদের নানা রকম ভয় আর দুশ্চিন্তার আরেকটু জটিল বা এলোমেলো সংস্করণ মাত্র, যাতে আমরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হই| আমি নিজে যেসব স্বপ্ন দেখি সেগুলো খুবই সাধারণ, এবং একান্তভাবেই ভীতিমূলক, যেগুলো, আমার ধারণা, প্রায় প্রত্যেকেই অজস্রবার নানা ভাবে দেখেছেন (রাস্তায় বেরিয়ে আবিষ্কার করছি: আমি বিবস্ত্র! ট্রেনে টিকিট চেকারের সামনে টিকিট খুঁজে পাচ্ছি না! প্লেনে চেপে বিদেশের এয়ারপোর্টে নামার আগে টের পাচ্ছি যে সঙ্গে পাসপোর্ট-ভিসা এসব কিচ্ছু নেই!)| কিন্তু কাল রাতে আমি একটা খুব ইন্টারেস্টিং স্বপ্ন দেখলাম| স্বপ্নে আমি ছিলাম না (নাকি ছিলাম? কী জানি| চিনতে পারলাম তো|), তবে একটা গোটা গল্প ছিল, একেবারে নাম-টাম সহ| সেই গল্পটা, অতি সামান্য সাজগোজের সঙ্গে পেশ করার জন্যেই এত ভ্যানতাড়া ভাঁজছিলাম|

গল্পটা একটা ছেলের আর একটা মেয়ের| তাদের আলাপ হল একটা ন্যাশনাল পার্কে, বিকেলের শেষ এলিফ্যান্ট রাইডে চড়তে গিয়ে| হাতির পিঠে গ্রুপে চড়তে হয়, আর এরা দুজনেই সেদিন পার্কে এসেছিল একা-একা| তাই, সব গ্রুপ-এর চড়া শেষ হয়ে যাবার পর একেবারে শেষ রাইডে গাইড আর মাহুতের সঙ্গে হাতির পিঠে সওয়ার হল ওরা দুজন| দুজনেই অসম্ভব মুখচোরা আর লাজুক, তাই প্রায় সিঁটিয়ে দু কোণায় যাওয়ার মত করেই বসার চেষ্টা করছিল তারা| কিন্তু হাতি কি আর ওসবের পরোয়া করে? সমুদ্রে ঢেউ তোলা জাহাজের মত করে হাতি এগিয়ে চলছিল ঘাসবন, কাদাজমি আর দূরে নীলচে পাহাড়ের পেছনে অস্তগামী সূর্যের আলোর মধ্য দিয়ে| আর তার পিঠে চাপানো বাক্সের মধ্যে বসে এর ওর গায়ে হেলে পড়তে পড়তে কখন যে ছেলেটা আর মেয়েটা একজন আর আরেকজনের সামনে সহজ হয়ে গেছে, তা তারা খেয়ালই করেনি| যাইহোক, রাইড শেষ হল| হাতি (আসলে হস্তিনী) এবং তার মাহুত ও গাইডকে বখশিস দেওয়া হল| মেয়েটা হাতির শক্ত কাঁটার মত লোমওলা মাথায় আস্তে-আস্তে হাত বুলিয়ে তাকে আদরও করল| কিন্তু পার্কের বাইরে এসেই তারা পড়ল মহা সমস্যায়|

একে তখন সন্ধে নামছে, তায় ঝমঝমিয়ে শুরু হয়েছে বৃষ্টি| শহরে ফেরার কোন গাড়ি না পেয়ে নিরুপায় হয়ে তারা দুজনে কাছাকাছি যেসব হোটেল-রেসর্ট আছে, তাতেই ঘরের সন্ধান করতে লাগল| ট্যুরিস্ট সিজনে অমন হুট করে কি আর ঘর পাওয়া যায়? শেষ অবধি একটা কমনামি রেসর্টের একটাই ঘরে ছেলেটি আর মেয়েটির ঠাঁই হল; অবশ্যই ভদ্রলোকের (ও ভদ্রমহিলার) চুক্তি মেনে ছেলেটি শোবে সোফায়, আর মেয়েটি খাটে| ইতিমধ্যে দুজনের আলাপ একটু-একটু করে জমে উঠেছে| ছেলেটা যেসব কথা কোনদিন কাউকে বলে উঠতে পারবে এমনটাই ভাবেনি, সেগুলো সে গড়গড়িয়ে মেয়েটিকে বলে ফেলেছে| মেয়েটি সেসব কথা শুনে কখনও রেগেছে, কখনও গলা খুলে হেসেছে| এসবের মধ্যে দিয়েই সারা হল ডিনার, বাইরের আলোগুলো একে-একে নিভে গেল, আর কাঁচের জানলা দিয়ে আসা বিদ্যুতের আলোয় ওরা দুজনেই দুজনের অন্ধকার অবয়বকে দূরে না রেখে শেষ অবধি একাকার হয়েই গেল|

রাত ফুরোলেও কিন্তু দুজনের মধ্যে রোমান্সটা ভোরের নরম কুয়াশার মত রয়েই গেল| লজ্জায়, ভয়ে, বা সম্পূর্ণ অন্য কোন অনুভূতির বশে ওরা কথোপকথন চালাতে পারছিল না, কথাগুলো শুরু হয়েই থেমে যাচ্ছিল, কিন্তু দুজনেরই মুখে এমন একটা অদ্ভূত আভা ছড়িয়ে ছিল যে কথাবার্তার আর দরকারই হচ্ছিল না| তারপর দুজনেই শহরে ফিরল| রাতের অত বড় একটা কান্ডের পরেও (আমার স্বপ্নে অন্তত ওটা একটা কান্ডই ছিল, সে আপনারা যাই ভাবুন নাহয়) ওদের আলাপ ফোন, আর কখনও-সখনো দেখার মধ্যেই আটকে রইল অনেক দিন ধরে| ইতিমধ্যে দুজনেই মর্মে-মর্মে বুঝে ফেলেছে যে তাদের সম্পর্কটাকে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই| কিন্তু তার জন্যে যে মস্ত বড় গাঁটটা পেরোতে হবে, তার জন্যে তো ওপরমহলের অনুমতি চাই| মেয়েটা একটা মেস-এ থেকে একটা খুবই ছোট চাকরি করে| ছেলেটা নিজের বাড়িতে বাবা-মা’র সঙ্গে থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরির পরীক্ষা দেয়| তাই লজ্জায় রাঙা হয়েও একদিন মেয়েটাই এল ছেলেটার বাড়ি “কথা” বলতে|

ছেলেটা মেয়েটাকে বাইরের ঘরে বসাল| তারপর সে ভেতরে গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বাবা আর হোমমেকার মা-কে সবকিছু খুলে বলে যখন বসার ঘরে নিয়ে এল [বীরপুরুষের দ্বারা যে এই কথাগুলো আগে তার বাবা-মা’র কাছে উথ্বাপিত হয়নি, তা বলাই বাহুল্য], তখন কিন্তু মেয়েটি সেই ঘরে ছিল না| ছেলেটি খুব অবাক হয়ে ফোনে মেয়েটিকে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল| তারপর যোগাযোগ করার অন্য চেষ্টাগুলোও একে-একে ব্যর্থ হল| ছেলেটি এক রকম হন্যে হয়ে মেয়েটির খোঁজ করার চেষ্টা করবে ভেবেও এগোতে পারছিল না, কারণ তার সব থেকে বেশি আকাংক্ষিত চাকরির পরীক্ষা তখন দরজায় কলিং বেল টিপছে| বিশাল লম্বা পরীক্ষা প্রক্রিয়া যদ্দিনে শেষ হল, তদ্দিনে ছেলেটি ফোন করে, আর সময় পেলেই মেয়েটি যে মেসে থাকত সেই মেসের অন্য বাসিন্দাদের প্রায় জেরা করে নিজের মত করে সন্ধান চালিয়েছিল| কিন্তু মেয়েটির কোন সন্ধান সে পায়নি| সে ছিল মোবাইল-পূর্ব যুগ (আহা, স্বপ্নকে আপ-টু-ডেট হতেই হবে তার কি কোন গ্যারান্টি আছে?), তাই অন্তত তাতে তোলা মেয়েটির কোন ফটোও ছিলনা ছেলেটির কাছে, যা দিয়ে অন্য কোনভাবে খোঁজখবর নেওয়া যায়| তারপর রেজাল্ট বেরোল, ছেলেটি চাকরি পেয়ে পাড়ি দিল অনেক দূরে| আর ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো ফরফরিয়ে উল্টে গেল দিন-মাস-বছর ঘোরার ইঙ্গিত দিয়ে|

অনেক দিন কেটে গেছে| প্লেন আর এ.সি. কামরায় অভ্যস্ত ছেলেটি নেহাত দায়ে পড়ে (এই শহরে ট্র্যাফিক জ্যাম এতই কুখ্যাত যে লোকাল ট্রেনেই চলাফেরা করার পরামর্শ তাকে দিয়েছিল সবাই) সেদিন ট্রেনে করে অচেনা শহরে কোথায় যেন যাচ্ছিল| হঠাৎ উল্টোদিকে বসে থাকা এক মহিলার দিকে ছেলেটার নজর গেল| সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত হলেও, এবং মনের কাঁচে বহু-বহু বছরের ধুলো পড়লেও, তার সেই হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাকে চিনতে পারল ছেলেটি| কিন্তু তারপরেই সে পড়ল কঠিন সমস্যায়| একদিকে তার বুকের ভেতর আগ্নেয়গিরি থেকে উৎক্ষিপ্ত লাভার মত উঠে আসতে চাইছে প্রশ্নের ঝাঁক, যাদের কাটছাঁট করলে এটাই দাঁড়ায়: “কেন? কেন? কেন?”, অন্যদিকে সে বুঝতে পারছে যে সময়, পরিবেশ, এমনকি তার নিজের পরিচয়, কোনটাই সেই উদগীরণের পক্ষে অনূকুল নয়| এমন সময় ভিড়ের ফাঁক দিয়ে একটি টিনএজার মুখ বাড়িয়ে মহিলাকে কিছু বলল, আর শেলফে রাখা একটা ব্যাগ নামাল| দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের চলন থেকে ছেলেটি বুঝতে পারল যে মহিলা এবার নামবেন| মহিলা উঠে দাঁড়াতেই একজন সেখানে বসার চেষ্টা করলেন, অন্যরা কেউ এগোলেন, কেউ পেছলেন, কিন্তু তার মধ্যেও ছেলেটি আর থাকতে না পেরে মেয়েটির নাম ধরে ডেকে উঠল|


মহিলাটি ভীষণ চমকে উঠে ছেলেটির দিকে তাকালেন| আর তারপর তাঁর মুখে সেই লজ্জা-বিস্ময়-ভয় মেশান হাসিটা ঝিকমিকিয়ে উঠল যেটা দেখে ছেলেটি সেই প্রথম দিন বিকেলেই তার মন দিয়ে দিয়েছিল| কিন্তু কথা বলার সময় ছিল না, কারণ ট্রেনের গতিবেগ তখন কমে আসছে, মানে স্টেশন সামনেই| মহিলা আর ছেলেটিকে বলে উঠতে পারলেন না, যে সেদিন ছেলেটির বসার ঘরে বসে তার বাবার ছবি দেখে তিনি নিজের এক মামাকে চিনতে পেরেছিলেন, আর তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাদের সম্পর্কটা সামনে এলে প্রলয় আসবে দুটি পরিবারেই| তাই নিজের পুরনো জীবনকে পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন অনেক-অনেক দূরে, এক নতুন জীবনের সন্ধানে| কিন্তু ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি একটা কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন| নিজের মেয়েকে ডেকে তিনি শুধু বললেন: “ইনি আমার খুব কাছের মানুষ| এঁকে প্রণাম করো|” টিনএজার মেয়েটি এই কথায় একটু হকচকিয়ে গেলেও মায়ের কথা মানল| ট্রেন স্টেশনে দাঁড়াল| হুড়মুড় করে নামা যাত্রীদের সঙ্গে মা-মেয়ে নেমে গেলেও ছেলেটি ভিড়ের মধ্যে তাদের খোঁজার চেষ্টা করছিল| মহিলা ট্রেনের জানলার কাছে এসে ছেলেটির চোখে চোখ রেখে বললেন, “আমার মেয়ের নাম রুক্মিণী| তুমি ভালো থেকো|” তারপর ট্রেন ছেড়ে দিল|

দুলতে থাকা ভিড়াক্কার কামরার মধ্যে হতবুদ্ধি হয়ে বসে থাকা ছেলেটি দুটো প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিল| প্রথমত, মেয়েটার মুখে কেমন যেন একটা চেনা আদল রয়েছে, যেটা তার মায়ের থেকে আলাদা; এমনটা কেন মনে হচ্ছে? দ্বিতীয়ত, রুক্মিণী নামটা ওদের মধ্যে, এমনকি এই প্রদেশেও, খুব একটা প্রচলিত নয়; তাহলে এমন নামকরণ কেন? এই ভাবনার ঘূর্ণিঝড়-এর মধ্যে কখন যে ছেলেটি তার গন্তব্যে পৌঁছল, তার তা মনেও নেই| কিন্তু বাথরুমে গিয়ে, চোখে-মুখে-গলায়-ঘাড়ে জলের ঝাপটা দিয়ে মুখ মুছতে গিয়ে বিদ্যুতচমকের মত একটা স্মৃতি তার মনের অন্ধকারে ঝলসে উঠল| যে হাতির পিঠে চড়ে ওরা সেদিন ন্যাশনাল পার্কে ঘুরেছিল, তার নাম ছিল রুক্মিণী| আর তখনই, আয়নার দিকে তাকিয়ে, হতাশার অন্ধকারে আরও একবার তলিয়ে যেতে-যেতে ছেলেটি বুঝতে পারল, কেন মেয়েটার মুখের কিছু অংশ তার এত চেনা লেগেছিল|

Saturday 25 April 2015

"এইসব দিনরাত্রি" (সৌজন্যে: হুমায়ুন আহমেদ)

অনেক দিন পর আজ ব্লগ লিখতে বসলাম| এর মধ্যে চারপাশে এত কিছু হয়ে গেছে, যে সেই সব চিত্তচাঞ্চল্যকর ঘটনাবলির মধ্যেও শুধু সাম্প্রতিকতম-গুলোর এক ঝলক তুলে ধরার লোভ সামলানো গেল না: -
Ø পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মাস্টারমশাই-ত্ব প্রাপ্তি (ফলে সেখানকার বড়-মেজ-সেজ কর্তারা কলকাতা পৌরসভা নির্বাচনের দিন কিছুই দেখলেন না);
Ø অগ্নিকন্যা কর্তৃক বাংলার একাধিক শহর বা তার উপকন্ঠে নির্মীয়মান টাউনশিপের নামকরণ, এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুকে প্রচুর মনিমুক্তার সমাবেশ, যা সবই আমাদের মত অসহায় বাঁদরদের গলায় বা পেজে ঝুলবে (আসল ক্ষমতা যাঁদের হাতে তাঁরা তো সারদা-মারফৎ সর্বস্বান্ত হয়েও চিত্রতারকাদের ভোট দিচ্ছি ভেবে চোর-ডাকাত-দেরই জিতিয়ে চলেছেন);
Ø মেটাফরিক নয়, আক্ষরিক ভূমিকম্প!
আর নয়, এই সব ব্যাপারস্যাপার নিয়ে পড়ে থাকলে লেখাটা এ.বি.পি.লাইভের ওয়েবসাইট-এর মত দেখাবে| তাই নিজের কথায় আসি|

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ৯ তারিখ কলকাতা থেকে ফিরে অফিসে যোগ দেওয়ার পর পেশাগত ক্ষেত্রে আমি এমন একটা সাংঘাতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলাম, যে প্রায় মাস-খানেক সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই দূরে চলে গেছিলাম| কিন্তু একটা সময়ের পর লোকে প্রায় সব কিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়, আর আমার ক্ষেত্রে যে জিনিসটা নিজেকে রুটিনমাফিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছিল সেটা হল আমার একাকিত্ব| এ এমন জিনিস, যে অফিসে ফাইল, ফোন, মেইল আর অফিস-পরবর্তী বই বা সিনেমার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলার চেষ্টা করেও এর থেকে রেহাই পাওয়া যায় না| আর কাজ এমনই বালাই যে মার্চ মাস এসে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আমার বর্ণান্তর হল! শূদ্র থেকে উত্তরণ হয়ে একেবারে ক্ষত্রিয় বনে গেলাম আমি প্ল্যান-প্রোজেক্ট আর ইয়ার-এন্ডিং-এর শেষ বাজারে| ফলে, সেই বিপর্যয় কালো মেঘের মত আমার আকাশের একটা বড় অংশকে আচ্ছন্ন করে রাখলেও, আমি যথাসম্ভব নিজের মত করে ভালো থাকার রুটিনে ফিরে গেছি| প্রচুর সিনেমা দেখেছি, প্রচুরতর বই পড়েছি, গান শুনেছি, আর ফেসবুক-এর মাধ্যমে নতুন করে খুঁজে পেয়েছি এমন বেশ কিছু মানুষকে যাঁদের প্রজ্ঞা, রসবোধ, জীবনশক্তি, প্রতিভা আর উপস্থিতি (ভার্চুয়াল হলেই বা) থেকে “চরৈবেতি” শব্দটার মানে ঠিকঠাক বোঝা যায়| কিন্তু নিজের কথা আর নয়, বরং একটা সত্যি ঘটনা লিখে আজকের মত পালাই|

কাল আমি যখন তেজপুরে পৌছেছিলাম, তখন বেশ রাত হয়েছে| তবু, ডিনার সেরে, বাকি সব গুছিয়ে, শুতে যাবার আগে মনে হল, একবার স্নান না করলে ঠিক শান্তি হচ্ছে না| যে হোটেলে উঠেছিলাম, সেখানকার বিশাল ব্যাপার| বাথরুমে ঘ্যামা একখানা টব, আর মাথার ওপর শাওয়ার, দিশি বালতি-ফালতির কোনো সিনই নেই! নেই যখন, তখন শাওয়ারই ভরসা| স্নান করার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল, আমি এ.সি-টা পছন্দসই তাপমানে ফিট করে কম্বলের তলায় ডাইভ দিলাম| বেশ কিছুক্ষণ পর, সেটা কতক্ষণ তা ঠিক করে বলতে পারব না, আমার ঘুম ভাঙলো জল পড়ার আওয়াজে| এটা ঠিক বেসিনে জল পড়ে যাওয়ার, বা কল থেকে ফোঁটা-ফোঁটা জল পড়ার আওয়াজ ছিল না| বরং আধো ঘুমের মধ্যে আওয়াজটা শুনে ঠিক এটাই মনে হয়েছিল যেন কেউ শাওয়ার চালিয়ে স্নান করছে, অর্থাৎ পুরোদমে জল পড়া, তারপর থামা, তারপর আবার পুরোদমে জল পড়া| ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর বেশ কয়েকটা অনুভূতি এক সঙ্গে মাথায় এসে হল্লা করল| প্রথমেই বুঝলাম যে ঘরটা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হয়ে গেছে| তার সঙ্গে এটাও বুঝলাম যে আমার চোখের পাতাগুলো কেউ যেন আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়েছে, ফলে মন ও কান সক্রিয় হলেও ওই ইন্দ্রিয়টি অচল| আরও বুঝলাম যে হোটেলে আর কোন ফ্লোরে তখনও হইচই চলছে, অর্থাৎ রাত খুব বেশি হয়নি| তারই মধ্যে আমি আবার শাওয়ার থেকে জল পড়ার আওয়াজ পেলাম| এর পর আর কম্বলের তলায় পড়ে থাকা যায়না, আমিও উঠলাম| অতি কষ্টে চোখ খুলে, বাথরুমের আলো জ্বালিয়ে, ভেতরে গিয়ে দেখলাম: জলে ভিজে আছে শাওয়ারের নিচের ফ্লোরটা, তবে বাথরুমে সেই মুহূর্তে আমি ছাড়া কেউ নেই| এই অবস্থায় কীই বা করা যায়? আমি মুখে-চোখে জলের ঝাপটা দিলাম, ঘরে এসে এ.সি-টা নিয়ে খুটখাট করলাম, এবং আবার শুয়ে পড়লাম| ঘুম ভাঙল ভোর ছ’টায়, আর তারপর শুরু হয়ে গেল আজকের দিনটা|


কী বুঝলেন? আমি তেজ্পুরের সিনিয়র সুপারিন্টেন্ডেন্টকে বলে রেখেছি পরের বার আমি তেজপুর এলেও যেন ওই ঘরটাই বুক করা হয়| আপনাদের জন্যেও কি তেমনটাই বলব?

Monday 9 March 2015

একটি জ্বরাক্রান্ত দিন এবং দোয়েল বন্দোপাধ্যায়

গত সপ্তাহ-দুয়েক ধরে ভোগান গুজ্গুজে জ্বর (যাকে লোকে ‘সফি’ ভাষায় ভাইরাল ফিভার বলে)-টা আজ এমন চেহারা নিল যে সকালের রুটিনটা বরবাদ করে বিছানায় ধপাস হওয়া ছাড়া উপায় রইল না| এদিকে এমন পোড়ার চাকরি করি যে ছুটি-ফুটি পাওয়ার চান্স-ও নেই! অগত্যা সিদ্ধান্ত নিলাম যে ছোটবেলার ওষুধটা প্রয়োগ করব, অর্থাৎ কিছু ভালো বই, কি নিদেনপক্ষে গল্প পড়ে বাকি দিনটা কাটাবার মত শক্তি সঞ্চয় করে নেব| হাতের কাছে থাকা পুরনো আনন্দমেলার শেষ বান্ডিলটা নামালাম (যার কিছুদিন পরেই আনন্দমেলার সঙ্গে আমার “কাট্টি” হয়ে গেছিল), যাতে ২০১৩-য় প্রকাশিত সংখ্যাগুলো ছিল| এদিক-সেদিক দেখে বেশ কিছু ভালো লেখা আবার পড়লাম, তবে মন ভালো করে দেওয়া লেখাগুলোর মধ্যে দোয়েল বন্দোপাধ্যায়-এর (‘রঙবেরঙ’-এর ১৪২১ শারদ সংখ্যায় যাঁর লেখা “পাবলো ও পিথাগোরাস” পড়ে আমি স্রেফ ফিদা হয়ে গেছিলাম) যে লেখাগুলো মনে ছাপ রেখে গেল, সেগুলোর কথা আলাদাভাবে লিখতেই হচ্ছে: -

১. জলপাহাড়ের খোঁজে (৫ই জুলাই ২০১৩): আধুনিক রূপকথা লিখে, খুব বড় কথাগুলো ছোটদের খুব সহজে বলার কাজটা ইদানিং অনেক সাহিত্যিক করার চেষ্টা করছেন| এই গল্পটাও সেই ধারায়, এবং খুব ভালোভাবে লেখা হয়েছে|
২. গণেশ নিরুদ্দেশ (২০শে অক্টোবর ২০১৩): এর আগের গল্প-টায় লেখিকা যে দুই ভাইবোন (ভেলকি আর ফুলকি)-এর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, এই গল্পটাও তাদের নিয়েই, কিন্তু এটা নিখাদ মজার গল্প, যেটা দীপান্বিতা রায়ের “বাহনের বায়নাক্কা”-র কথা মনে করিয়ে দেয়|
৩. ইতিহাসে পাতিহাঁস (২০শে নভেম্বর ২০১৩): অ..সা..ধা..র..ণ একটি মজার গল্প, যা না পড়লে, হে পাঠক, আপনি জানিবেন না আপনি কী হারাইতেছেন|

এরপর যা হয় আর কী, আমি দোয়েল-এর আরও লেখা খুঁজে বের করতে সচেষ্ট হলাম| ওই ২০১৩-র আনন্দমেলা-তেই আমি ওনার লেখা গোটা দুই ভালো নন-ফিকশন পিস খুঁজে পেলাম, যেগুলো ছোটদের মনে আরও পড়ার, আরও জানার আগ্রহ তৈরি করার পক্ষে একেবারে আদর্শ| সেই লেখাগুলো হল: -
১) কারাগার থেকে পালানো (২০শে অগস্ট ২০১৩)
২) পুরাণ ও মহাকাব্যের অমর চরিত্ররা (৫ই ডিসেম্বর ২০১৩)

অতঃপর আরও অনুসন্ধান, এবং শেষে লেখিকার সৌজন্যে (এই বাজারে স্রেফ পড়তে চাইছি বললেই কি আর গল্প পড়তে পাওয়া যায়, তাও আবার “ফ্রি-ফ্রি-ফ্রি”??) পাওয়া আরও তিনটি লেখা পাঠ| এর মধ্যে নন-ফিকশন পিস একটিই: কড়ি দিয়ে চিনলাম, যা ভারতে মুদ্রার ইতিহাসের একটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, অথচ কৌতূহল-উদ্দীপক বিবরণ| অন্য দুটো বাংলা ‘ফেমিনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত ফিকশন, যাদের নাম: -
১. মির্চ (জুন ২০১৪): সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-এর “রসেবশে” ঘরানার উত্তরসূরী এই লেখাকে ছোটদের লেখা বলা যাবেনা, (তবে ছোটরা তো এখন অনেক বড় হয়ে গেছে!), কিন্তু এই গল্প যে অনুভূতির জন্ম দেয় তার কথা ভেবেই বোধহয় ‘হালকা হাসি, চোখের জল’ (আবার সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-এর কাছেই হাত পাততে হল)-গোত্রটির উদ্ভব|
২. ঘরে ফেরার গান (জানুয়ারি ২০১৫): মধ্যবিত্ত ঊর্ধ্বগামী বাঙালির সংসারের এক কঠোর ও কটু বাস্তব দিকের সঙ্গে লেখিকা আমাদের আরও একবার পরিচয় করিয়ে দিলেন এই গল্পে| তবে আমার এই গল্পটা ভালো লাগেনি|

এছাড়াও দোয়েলের লেখা গল্প আছে “জয়ঢাক”-এ, “কাকলী”-তে, এবং সাম্প্রতিকতম “রঙবেরঙ”-এ| সেগুলো এখনো পড়া হয়নি বলে এখনো কিছু লিখতে পারলাম না| কিন্তু আমার অনুরোধ: দয়া করে লেখা চালিয়ে যান দোয়েল| আমাদের জীবনে হাসি আর মজার বড্ড অভাব| সেই অভাব মেটানোর জন্যে আমরা কিন্তু আপনার মত লেখকদের দিকেই তাকিয়ে আছি|

Sunday 8 February 2015

বইমেলা ২০১৫: ফিরে দেখা

আজ বেলা পৌনে দুটো নাগাদ যখন বইমেলা থেকে বেরোচ্ছি, তখন সবক'টা গেট দিয়ে জনস্রোত মেলায় ঢুকছে। মনে হল, "নবমী নিশি গো, পোহায়ো না আর" ব্যাপারটা বাঙালি এখন মেলার শেষ দিনেই সবচেয়ে বেশি করে টের পায়। এমনকি আমার মত একাচোরা পাবলিকের কাছেও এই শেষ দিনের টানটা অমোঘ বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু সেটা ঠিক কেন? একে তো বইমেলার তুলনায় কলেজ স্ট্রিটে সারা বছর বেশি ছাড় পাওয়া যায়। তার ওপর এক ঝলকের রাগি নজরে বইমেলাকে বই-এর বদলে খাবারের মেলা বলেই মনে হয়। সারদা আর রোজ ভ্যালি কি এম.পি.এস-এর তরফে টাকা তোলার উদ্যোগ স্বাভাবিক ভাবেই এবার ছিল না, যেটা ভালো। কিন্তু সেই "ক্ষতি" পূরণ করার জন্যে খাবারের স্টলগুলো, আর তার সামনে ভিড় জমান জনতাই কাফি ছিল। তাহলে কেন এই মেলা শেষ হয়ে যাওয়ার দুঃখটা একেবারে টনটনিয়ে উঠছে? ভেবে চিন্তে যে কারণগুলো মাথায় এল তারা হল: -

১) বইমেলা উপলক্ষে সারা বছর ফেসবুক আর অন্য নানা মাধ্যমে টুকটাক যোগাযোগ (সেও ভার্চুয়াল) হওয়া নামগুলো বাস্তব মানুষ হয়ে সামনে আসে। দশচক্রে ভূতায়িত আমরা তখন টের পাই, আড্ডার শেকড়টা কত গভীরে বিস্তৃত, অথচ সেই আড্ডাটা জমাট বাঁধার আগেই ভেঙে যায়, কারণ কেউ যাবে নর্থে, কেউ সাউথে, কেউ রাজ্যের বাইরে, কেউবা দেশের বাইরে।
২) ধর্ষণ, শিশুহত্যা, মৌলবাদ, রাজনীতি, সানি লিওন, ভিরাট কোহলি, আর জ্যান্ত দুর্গার শ্রীবচনের বাইরেও যে একটা বিশাল ভুবন আছে, তার আভাস আমরা পাই এই ক'টা দিন বই (সঙ্গে প্রেমিকা কি বন্ধুবান্ধব থাকলে তো কেস জমে ক্ষীর) নিয়ে মেতে উঠে।
৩) অচল টাকার অপ্রতিরোধ্য ঠেলায় ভালো টাকার সরে যাওয়ার মত করে, বাজার আর মামাটিমানুস-এর ধাক্কায় বই-এর জগতেও রসসিক্ত অথচ বুদ্ধিদীপ্ত (বিশেষত একটু অন্য ধারার, একটু ক্রিটিক্যাল) লেখাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বইমেলায় এলে "সৃষ্টিসুখ", "গুরুচণ্ডা৯", আর অন্যান্য স্বাধীনচেতা প্রকাশনা সংস্থাগুলোর স্টলে গেলে মনে হয় যে মননশীল বাংলা লেখার প্রত্যাবর্তন নিয়ে এখনো আশাবাদী হওয়া যায়।

আমি এবারো, যথারীতি, কাছা খুলে এবং ব্যাগ ফাটিয়ে বই কিনেছি। সবথেকে বেশি কিনেছি সৃষ্টিসুখ, সংসদ, মেইনস্ট্রিম, কোরক, গুরুচণ্ডা৯, আর নানা ছোটখাটো সংস্থা থেকে। কিছু সংস্থা যথারীতি ঝুলিয়েছে, মানে বই প্রকাশ করে উঠতে পারেনি। ছাড়া কিছু সংস্থার বই পাওয়াই যায়নি, অর্থাৎ কলেজ স্ট্রিটে সেগুলো যোগাড় করতে হবে পরে। আর নামজাদা ও পায়াভারী সংস্থাগুলোর বই আমি কলেজ স্ট্রিটের দোকান থেকেই কিনি, তাই তাদের কথা আলাদা। কিন্তু এবারের মেলাটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেকদিন এর রেশ আমার মনে থেকে যাবে। সমুদ্রের স্বাদ পাওয়া মানুষ যেমন প্যাচপেচে ঘেমো অফিসে বসে ঢেউয়ের গর্জন শুনতে পায়, আমিও আমার অর্ধোন্মাদ সাইকোটিক বসের কথা শুনতে-শুনতে বইমেলার এই ভিড় আর হাসিঠাট্টার কথা ভাবব, আর অপেক্ষা করব সামনের বছরের জন্যে