Thursday 25 October 2018

বন্ড। জেমস বন্ড।

আমার ‘বন্ড’-এজ শুরু হয়েছিল যুগান্তরের পাতায় য়ারোস্লাভ হোরাকের আঁকা দুর্দান্ত কমিক স্ট্রিপগুলো পড়ে। ওগুলোতে রাজনীতির কূটকচাল খুব কম থাকত, বেশি থাকত অসাধারণ সাদা-কালো দাগে ফুটিয়ে তোলা গতি, এস্পিওনাজ জগতের আলো-অন্ধকার, আর স্বল্পবসনা নারীদের লাস্যময়ী বিভঙ্গ। পরে বুঝি, ওই সাদা, কালো, বাদামি শরীরগুলো এই গোত্রের সিনেমা-তে প্রপস বা আই ক্যান্ডি ছাড়া বিশেষ ভূমিকা নেয় না। এরপরেই আমার, এই সিনেমাগুলোর জন্য আশৈশব লালিত ফিক্সেশন তথা নিষিদ্ধ আকর্ষণ কেটে যেতে থাকে। বরং, বন্ড মানেই যে “এন্টারটেইনমেন্ট, এন্টারটেইনমেন্ট, অ্যান্ড ওনলি এন্টারটেইনমেন্ট” (সৌজন্যে: বিদ্যা বালান), এটা মগজস্থ হয়। স্বাভাবিকভাবেই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ড হন রজার মুর। মুর-অভিনীত অবাস্তব, ওভার-দ্য-টপ সিনেমাগুলোর বিনোদনমূল্য বাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর মুখের উইটি সংলাপ, এবং মেট্রোসেক্সুয়াল চার্ম। দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ড মুভি-ই ছিল ‘লিভ অ্যান্ড লেট ডাই’, যা বন্ডের সিনেমা বলতে আমরা ততদিন যা-যা বুঝতাম, তার একেবারে সেরা-সেরা জিনিসে ঠাসা ছিল। প্লাস, মুরের ডায়লগগুলো আমি জাস্ট ভুলতে পারিনি!


ছিল। এখন আর নয়। এখন আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ড মুভি ‘স্কাইফল’।
কেন? সেই নিয়েই তো এই পোস্ট!

কাল সন্ধেবেলা শ্রীমতী বাড়ি ছিলেন না। অপ্রত্যাশিতভাবে রিমোটের মালিকানা পেয়ে আমি, এবং ‘পড়্‌!পড়্‌!’ থেকে স্বাধীনতা পেয়ে আমার মেয়ে কিঞ্চিৎ দিশেহারা হয়ে পড়ি। কন্যারত্ন কোনো একটা রমকম দেখার চেষ্টায় ছিলেন, কিন্তু স্টার এইচডি-তে সিনেমাটা চলছে দেখে আমি অনুনয়-বিনয় করে ওকে সেখানে নিয়ে এলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সেও আঠা হয়ে গেল। বিজ্ঞাপনের জন্য সিনেমা দেখায় সমস্যা হচ্ছে বলে দু’জনেরই মাথা গরম হল। টিভি ছেড়ে ডিভিডি-টা চালানো হল। তারপর...!
সিনেমাটা নিয়ে আমি বিশেষ কিছু লিখব না। যাঁরা সিনেমাটা দেখেননি, তাঁরা মহাপাতক করেছেন। আপনি নারীবাদী, মার্ক্সবাদী, বাদি, বিবাদী যা খুশি হোন, কিন্তু এই সিনেমাটাকে বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদী অবক্ষয় ভেবে, বা সিংগল স্ক্রিন সিনেমাহলের আশারদের পেটে অন্ন জোগানোয় মদত দেওয়া হবে না ভেবে যদি ত্যাগ করে থাকেন, তাহলে মারাত্মক ভুল করেছেন। এই সিনেমাটা আসলে কী নিয়ে জানেন? ওপরে বিদ্যা বালানের কোটেশনটি দেখুন।
তবে আমার কাছে সিনেমাটা ফেভারিট একাধিক কারণে।
প্রথমত, অ্যাডেল আমাদের দু’জনেরই প্রিয় শিল্পী। তাঁর লেখা ও গাওয়া টাইটেল ট্র্যাক-টা আমাদের দু’জনেরই অন্যতম প্রিয় গান। কিন্তু এক সুপারহিরো (হ্যাঁ, বন্ড তাই-ই) যখন হারিয়ে যায় রক্তলাল ঘূর্নির মধ্যে, তখনকার অবস্থার সঙ্গে ‘দিস ইজ দ্য এন্ড’ গানটা যে কতটা মিলে যায়, তা আমরা কেউই এভাবে বুঝিনি। ইনফিনিটি ওয়ারে স্পাইডারম্যানকে মুছে যেতে দেখে, বা অ্যাভেঞ্জার্স ফোর-এর পর ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা-কে আর দেখতে পাব না জেনে যে অনুভূতিটা হয়েছিল, তার প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম ছ’বছর আগে রিলিজ হওয়া গানটায়।
দ্বিতীয়ত, বন্ড যখন সিলভা-র পেছনে ছুটে স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাওয়া টিউবের পেছনটা আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করে, আর সেটা দেখে এক যাত্রী বলেন ‘হি ইজ রিয়্যালি কিন টু গো হোম আর্লি।’ বা সেই অবস্থায় গার্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ট্রেনে ঢুকে যখন বন্ড নিজের পরিচয় দেয় ‘হেলথ অ্যান্ড সেফটি। ক্যারি অন।’ বলে, তখন শুধু আমি নয়, আমার মেয়েও হেসে উঠেছিল। এই কুইন্টেসেনশিয়ালি ব্রিটিশ হিউমার আর কোথায় পাব?
তৃতীয়ত, একের পর এক ঘটনা দেখে আমার মেয়ে বলল, “বাবা, ও (মানে ভিলেইন) বন্ডকে আসলে মারতে চায় না, তাই না? ও চায়, বন্ড বেঁচে থাকুক।” আমার মনে পড়ে গেল ‘কিংসম্যান’-এ স্যামুয়েল এল জ্যাকসন আর কলিন ফর্থ-এর সংলাপ, যেখানে দু’জনেই বলে যে তারা সেইসব সিনেমার ভক্ত যেখানে ভিলেইন হিরোকে অসম্ভব, অবাস্তব নানা উপায়ে মারার প্ল্যান করে, আর সেই ফাঁকে হিরো বেরিয়ে যায়। প্রসঙ্গত, ‘কিংস্যম্যান’ ফ্রাঞ্চাইজ বন্ড-এর প্রতি হোমাজ, তবে স্পুফ নয়। স্পুফ বা প্যারডি চাইলে আপনাকে দেখতে হবে লেসলি নিলসেন অভিনীত ‘স্পাই হার্ড’ বা রোয়ান অ্যাটকিনসন অভিনীত ‘জনি ইংলিশ’।
চতুর্থত, সিনেমার ক্লাইম্যাক্সে সিলভা যখন বিকৃত মুখে এম-কে ছেড়ে সোজা হয়, এবং আমরা দেখি তার পিঠ থেকে বেরিয়ে আছে একটা ছুরির বাঁট, আর অনেকটা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বন্ড, তখন আমার মেয়ে বলল, “দ্য ওল্ড ওয়ে!” বন্ডকে ছুরিটা দেওয়ার সময় কিংকেড, মানে ওই এস্টেটের গেমকিপার ঠিক এভাবেই জিনিসটার পরিচয় দিয়েছিল। তারপর মৃতপ্রায় সিলভার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বন্ড বলে, “লাস্ট র‍্যাট স্ট্যান্ডিং।” এবং আমার মেয়ে জোড়ে, “ও অন্যটাকে খেয়ে ফেলেছে।” আমি বুঝি, দীক্ষা কমপ্লিট।
এখন থেকে ‘স্কাইফল’ আমার ফেভারিট। আর আপনার?

2 comments:

  1. অসাধারণ লেখা। হাতের একটা কাজ সেরে আজই দেখে ফেলব।

    ReplyDelete
  2. একদম। দারুণ কাটবে সময়টা। গ্যারান্টিড।

    ReplyDelete