Sunday 22 October 2017

অনীশ দেব চরণকমলেষু, এবং সবুজের অভিযান



পাঠকের কাছে রহস্য কাহিনির আকর্ষণ ঠিক কোথায়?
ঊনবিংশ শতকে ছাপার খরচ কমে যাওয়ায়, এবং সাক্ষরতার হার বেড়ে যাওয়ায় পশ্চিমে পত্র-পত্রিকার সংখ্যায় কার্যত বিস্ফোরণ ঘটে। তখনই সম্পাদকেরা বোঝেন যে পাঠকদের টেনে রাখার জন্য তাঁদের দরকার এমন ধরনের লেখা যাকে ইংরেজিতে বলে সেনসেশনাল, আর হিন্দিতে সনসনিখেজ! বাংলায় এই শব্দটির নিকটতম প্রতিশব্দ বোধহয় রোমাঞ্চকর।

আলেকজান্দার দুমা থেকে জুল ভের্ন হয়ে এই ঘরানা ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে ঢোকেচার্লস ডিকেন্স-এর চেয়েও উইলকি কলিন্স এটির প্রয়োগ করতে বেশি সফল হন। ইতিমধ্যে আটলান্টিকের অন্য দিকে একটি মানুষ আধুনিক ইংরেজিতে গথিক বা ভয়াল রসের সাহিত্যের সূচনা করার পাশাপাশি গোয়েন্দা গল্পেরও গোড়াপত্তন করেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই এডগার অ্যালেন পো প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক ও সমালোচক মহলে সম্ভ্রমের বদলে নাসিকা-কুঞ্চন উৎপাদনেই সফল হয়ে অকালে প্রয়াত হয়েছেন।
আমেরিকা ও ইউরোপ, দু’জায়গাতেই পেনি ড্রেডফুল জাতীয় পত্রিকা ও বই এরপর দারুণ জনপ্রিয় হয়। সাহিত্য নিয়ে এই পত্রিকাগুলোর কোনো মাথাব্যথা ছিল না। এদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল অপরাধের কথা বলে, ও সেই নিয়ে পুলিশি অনুসন্ধানের মোড়কে সমাজের উঁচু ও নিচু তলার মানুষদের নানাবিধ কেচ্ছা যথাসম্ভব রগরগে ভাষায় রঙ চড়িয়ে লিখে টু পাইস কামানো। অনেক কলমচিই এই ধারায় ‘লেখালেখি’ চালাতে উৎসাহ হয়েছিলেন
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর কলকাতায় রহস্যরোমাঞ্চ কাহিনির আবির্ভাব এই সময়েই।
ঠগীদমনের ফলে খ্যাত ও শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে গণ্য উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান-এর অধীনে দারোগা বরকতউল্লাহ-এর কার্যকলাপ ‘বাঁকাউল্লার দপ্তর’ তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল, যদিও তার প্রেরণা ছিল ফ্রান্সের গোয়েন্দা ভিডকের স্মৃতিচিত্রণ, যা সমকালীন ইউরোপ জুড়ে আগ্রহ ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। এরই মাঝে, পেনি ড্রেডফুল ঘরানার নির্ভুল আত্তীকরণ তথা বঙ্গীকরণ করে ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়-এর “হরিদাসের গুপ্তকথা” নানা নামে ও রূপে প্রকাশিত হয় ১৮৭০ থেকে ১৮৭৯ সাল অবধি। ১৮৮৮ সালে গিরিশচন্দ্র বসু ডাকাতি তথা অন্যান্য অপরাধ দমনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন ‘সেকালের দারোগার কাহিনি’।

রহস্য কাহিনি বলতে আমরা যা বুঝি সেটা হয়তো এভাবেই চলত, কিন্তু অবস্থাটা হঠাৎ বদলে গেল। শিল্প-বিপ্লবের ফায়দা তোলা ও সাম্রাজ্যবিস্তারের মাধ্যমে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা দেশটির রাজধানীতে এমন একঝাঁক খুন হল, বীভৎসতা ও দুর্বোধ্যতায় যাদের জুড়ি মেলা ভার।
১৮৮৮ সালের ৩১শে অগস্ট, ৮ই সেপ্টেম্বর, ৩০শে সেপ্টেম্বর (দু’বার!), এবং ৯ই নভেম্বর। লন্ডনের হলদেটে কুয়াশায় ভেজা স্যাঁতসেঁতে রাতে, হোয়াইটচ্যাপেল-স্পিটালফিল্ডস এলাকার পাঁচজন মহিলা, যারা প্রত্যেকেই ছিল দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টির শিকার, মদের খরচ তোলার জন্য যাদের ক্যাজুয়াল প্রস্টিট্যুশন (মাফ করবেন, এই শব্দবন্ধের যথাযথ বাংলা আমার জানা নেই)-এর রাস্তা বেছে নিতে হয়েছিল, আক্ষরিক অর্থেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল এক অজানা আততায়ীর ছুরিতে।
অজানা, কারণ লন্ডন, ইংল্যান্ড, ইউরোপ হয়ে সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই খুনিকে পুলিশ ধরতে পারেনি। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছিল জ্যাক দ্য রিপার নামে কুখ্যাত সেই খুনি। সিরিয়াল কিলার তার আগেও এসেছিল, পরেও এসেছে অনেক। কিন্তু রিপার কিলিংস আক্ষরিক অর্থেই ইতিহাস গড়েছিল।
কেন?
হঠাৎ প্রশাসন, পুলিশ, খবরের কাগজের এক-একটি সংস্করণ প্রকাশের ঘন্টাখানেকের মধ্যে কিনে ফেলা পাঠকেরা, এবং তাদের তথা বাজারের গতিপ্রকৃতি বুঝতে সদা সচেষ্ট প্রকাশনা শিল্প দুটো জিনিস বুঝতে পারল।
প্রথমত, ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ দিয়ে সব হত্যার নাগাল পাওয়া শক্ত। মানুষের মন সরলরেখায় চলে না, আর সেজন্যই খুনিকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করেও সন্দেহভাজনদের লম্বা তালিকা ছাড়া কিছুই জোগাড় করে উঠতে পারেনি পুলিশ বা প্রেস।
দ্বিতীয়ত, সব অপরাধের সমাধান করার ক্ষমতা, বা দক্ষতা পুলিশেরও নেই! রাষ্ট্র এই ধারণাটির স্বীকৃতি দেওয়ার আগেই পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝলেন এক মার্কিন প্রকাশক। পোর্টসমাউথে বসে পশার জমানোয় ব্যর্থ এক চিকিৎসক-এর লেখা একটি উপন্যাস ১৮৮৭-র ‘বিটন’স ক্রিসমাস অ্যানুয়াল’-এ প্রকাশিত হয়েছিল ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’ নামে। বই হয়ে বেরোনোর পরেও তেমন একটা মারমার-কাটকাট জনপ্রিয়তা পায়নি লেখাটা, কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম পেশাদার কনসাল্টিং ডিটেকটিভের আবেদন বুঝতে সাগরপাড়ের মানুষটির দেরি হয়নি। অতঃপর লেখকের সঙ্গে চুক্তি, সাউথ সি-তে নিজের ফাঁকা চেম্বারে বসে আর্থার কোনান ডয়েল-এর কলম সঞ্চালন, ফেব্রুয়ারি ১৮৯০-এ ‘লিপিনকট’স ম্যাগাজিন’-এ প্রকাশিত “দ্য সাইন অফ ফোর” নামক উপন্যাসে শার্লক হোমস নামক মানুষটির পুনরাবির্ভাব
বাকিটা ইতিহাস।
অ্যালান মুর তাঁর ‘ফ্রম হেল’ উপন্যাসে দাবি করেছেন, তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় পরস্পরবিরোধী অজস্র টানাপোড়েনের ফলে জ্যাক দ্য রিপারের মতো এক খুনির আবির্ভাব অবধারিত ছিল, যেমন অনিবার্য ছিল বিংশ শতকে অ্যান্টি-সেমিটিক ধ্যানধারণার প্রসারের ফলে হিটলারের উত্থান। অন্তত রহস্যরোমাঞ্চ সাহিত্যের ইতিহাস দেখলে এই কথাটা প্রমাণিত হয়, কারণ সমাজের দর্পণ হিসেবে সাহিত্য মানুষের ভয়ের জায়গাগুলো সব সময় ছুঁয়ে যেতে চায়। তাই বিংশ শতকেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ারের নারকীয়তা আর বিষাক্ত গ্যাসের ধোঁয়া পাওয়া যায় দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝে বিভিন্ন রহস্য কাহিনিতে খুনের উপকরণ হিসেবে বিষের ব্যবহারে। আমেরিকায় সমৃদ্ধি আর তার পরের ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’-এর প্রতিধ্বনি শোনা যায় এলেরি কুইনের হাস্যরস মিশ্রিত বুদ্ধিদীপ্ত গোয়েন্দা গল্পের যুগাবসান হয়ে ড্যাশেল হ্যামেট ও রেমন্ড শ্যান্ডলার-এর হার্ড বয়েল্ড ঘরানার অভ্যুদয়ের মাধ্যমে। এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর ঠাণ্ডা লড়াই তার লম্বা ছায়া ফেলে জেমস বন্ড থেকে ব্যাটম্যান, স্পেন্সার থেকে অ্যালেক্স ক্রস, এই সব রকমের গোয়েন্দার কীর্তিকলাপে।

বাংলায় রহস্যরোমাঞ্চ নিয়ে জনপ্রিয় ‘সাহিত্য’ রচনার ক্ষেত্রে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়-এর ‘দারোগার দপ্তর’-কে পথিকৃৎ বলা চলে। ১৮৯৩ সালে প্রথম খণ্ড প্রকাশের পর থেকেই বেস্টসেলার হয়ে যায় বইটি। কিন্তু এরপর আর পুলিশি গোয়েন্দাদের কেন্দ্রে রেখে বাংলায় বেশি লেখালেখি হয়নি। বেকার স্ট্রিটের খড়্গনাসা পাইপমুখো নিঃসঙ্গ গোয়েন্দাটির ধাঁচেই সেই সময়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক পাঁচকড়ি দে ১৮৯৯-এ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ‘মায়াবিনী’-তে আনেন গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয়-কে।
১৩০৬ বঙ্গাব্দে গোয়েন্দা গল্প লিখে কুন্তলীন গল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পান রজনীচন্দ্র দত্ত। দ্বিতীয় স্থানাধিকারী দীনেন্দ্রকুমার রায় পরবর্তী কালে তাঁর প্রটাগনিস্ট রবার্ট ব্লেক-কে কেন্দ্রে রেখে প্রচুর রহস্য গল্প লেখেন। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য-র হুকাকাশি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ঘরানার রহস্যভেদী হলেও হেমেন্দ্রকুমার রায়-এর জয়ন্ত (সঙ্গে মানিক ও সুন্দরবাবু) মোটামুটি হোমসীয় ধারাকেই অব্যাহত রাখে। তারপর, ‘মাসিক বসুমতী’ পত্রিকার মাঘ ১৩৩৯ সংখ্যায় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়-এর “পথের কাঁটা” গল্পে আত্মপ্রকাশ করে বাঙালির একান্ত নিজস্ব সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী।
ব্যোমকেশের কাহিনিগুলোয় চোর-পুলিশ খেলা, বা অপরাধী ও সত্যান্বেষীর মধ্যে ক্যাট অ্যান্ড মাউজ গেম-এর বদলে সমাজজীবনের সংকটগুলো ফুটে ওঠে স্পষ্ট ভাবে, অনুপম ভাষায়। শরদিন্দু সচেতনভাবে লেখাগুলোতে এক বৌদ্ধিক ব্যাপ্তি দিতে চেয়েছিলেন বলেই হয়তো ব্যোমকেশের গল্পগুলো এই বদলে যাওয়া সময়ে, যখন প্রাইভেট ডিটেকটিভ ধারণাটাই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, এবং সারভেইল্যান্স নামক বস্তুটির মাধ্যমে রাষ্ট্র বিগ ব্রাদার হয়ে আমাদের জান-মালের দায়িত্ব নেওয়ার নামে ঢুকে পড়ছে ঘরের কোণে, দারুণ ভাবে জনপ্রিয় রয়ে গেছে।

তাহলে, এই সময়ের এক নতুন লেখক যখন রহস্যকাহিনি লেখেন, তখন তাঁর লক্ষ্য কী হয়? এলেরি কুইন স্টাইলে ফেয়ার প্লে মিস্ট্রি লেখা, যেখানে সব ক্লু দেওয়া থাকে পাঠকের সামনে, আর তাঁকে চ্যালেঞ্জ করা হয় রহস্যটি সমাধান করার জন্য?
হোমস ঘরানার সঙ্গে অ্যাকশন মিশিয়ে, অর্থাৎ ১৯৬৫-৬৬-তে ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ ও ‘বাদশাহি আংটি’-তে প্রতিষ্ঠা করা শ্রী প্রদোষ চন্দ্র মিত্র-র গল্পগুলোর ধাঁচে নারীচরিত্র-বর্জিত শিশুপাঠ্য গল্প লেখা?
ব্যোমকেশের মতো এক সত্যান্বেষী নির্মাণ করা, যার চোখে ধরা পড়বে সমাজের ফাটলগুলো, যার বুদ্ধির ছটায় ছিন্নভিন্ন হবে সংস্কার আর উপেক্ষার মাকড়সার জাল?
নাকি তিনি আনবেন এক আউটসাইডার-কে, যাঁর বুদ্ধির দীপ্তি পুলিশকে সাহায্য করবে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে?
একথা বুদ্ধিমান মাত্রেই মানবেন যে আজকের সক্রিয় মিডিয়া এবং আইনি জটিলতা অধ্যুষিত সময়ে শেষেরটিই একমাত্র পথ। অপরাধ নিয়ে মাথা ঘামানোর ব্যাপারে পুলিশ, সি.বি.আই, ল’ইয়ার, এঁরা ছাড়া আর কারো অধিকার স্বীকার করে না রাষ্ট্র।
বাংলায় রহস্যরোমাঞ্চ সাহিত্যের কম্পমান শিখাটিকে দীর্ঘদিন নিজের দু’হাতের মাঝে সযত্নে লালন করেছেন যে অনীশ দেব, আজ তাঁরই জন্মদিন। তিনি যে সীমিত সংখ্যক গোয়েন্দা গল্প লিখেছেন, তাতেও রহস্যভেদে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন অধ্যাপক অশোক চন্দ্র গুপ্ত, তথা এ.সি.জি, যিনি তাঁর ছাত্র, বদরাগি পুলিশ অফিসার রঘুপতিকে সাহায্য করেন নানা অপরাধের কিনারা করে অপরাধীর বিরুদ্ধে কাস্ট-আয়রন কেস সাজাতে।
কাকতালীয় হলেও এটাই সত্যি যে আজ আমি মনোরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা যে রহস্যকাহিনির সংকলনটি পড়লাম, সেই “শোণিত ধারায় সাত”-এর সাতটির মধ্যে ছ’টিতেই রহস্যভেদীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন রসায়নের অধ্যাপক সুদর্শন ভট্টাচার্য।
কিন্তু বইটা হয়েছে কেমন?

বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক স্বজনপোষণ এবং ভাড়াটে সমালোচকদের অভিমতের দুষ্টচক্রকে তুশ্চু করে নতুন লেখকদের আত্মপ্রকাশের মঞ্চ গড়ে দেওয়ায় বিরাট ভূমিকা নিয়েছে যে নতুন প্রকাশনা সংস্থাগুলো, তাদের মধ্যে বিভা পাবলিকেশন অগ্রগণ্য। এই সংস্থা থেকে প্রকাশিত বইপত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিনের। প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মতো ধারালো এবং প্রথা-বহির্ভূত বিষয় নিয়ে গল্প রচয়িতার দু’টি গল্প-সংকলন-ই প্রকাশ করেছে বিভা। গত বছরের সেরা থ্রিলার, এবং বাংলায় একান্ত বিরল ইতিহাস-আধারিত টেকনো থ্রিলার-এর একমাত্র সার্থক নিদর্শন, দেবারতি মুখোপাধ্যায়-এর “ঈশ্বর যখন বন্দি”-ও প্রকাশ করে বিভা-ই। তাই তুলনামূলক ভাবে নবীন গল্পকার মনোরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়-এর সাতটি রহস্য গল্পের সংকলন যখন বিভা থেকেই প্রকাশিত হয়, তখন বইটি নিয়ে আমার প্রত্যাশা ছিল বিপুল।
কিন্তু বইয়ের গল্পগুলো নিয়ে আলোচনার আগে, যে খারাপ জিনিসগুলো আমাকে পদে-পদে দস্তুরমতো কষ্ট দিয়েছে, সেগুলোর কথা আগে লিখি: -
১. প্রত্যেক পাতায় অন্তত গোটা পাঁচেক ছাপার এবং/অথবা বানান ভুল।
২. ‘ওনার’/’উনার’-এর মতো অশুদ্ধ অভিব্যক্তিতে লেখাগুলো বোঝাই থাকা।
৩. কোথায় ‘ওঁর’ হয়, আর কোথায় ও’র হয়, সেই ধারণা না থাকা।
৪. অভিভাবকদের কথাবার্তা প্রসঙ্গে আপনি/উনি আর তুমি/সে গুলিয়ে ফেলা।
৫. ফরম্যাটিং-এর সময় রহস্যকাহিনির উপযোগী ছোটো-ছোটো অনুচ্ছেদে লেখাকে না ভেঙে একটানা লিখে যাওয়া, যার ফলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পাঠকের কাছে বিরক্তিকর ঠেকবে।
৬. অপ্রয়োজনীয় কথা, বিশেষত কেন্দ্রীয় চরিত্র কী করেন ও কেন করেন সেটা প্রত্যেক গল্পে ফলাও করে, বার-বার বলা।

এবার আসি গল্পগুলোর কথায়। সূচিপত্র অনুযায়ী নয়, বরং গল্পগুলো আমি যেভাবে পড়েছি সেইভাবেই লিখছি।
(১) অতীতের অস্ত্রোপচার: ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকায় জুলাই ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত এই গল্পটি ‘ওল্ড সিনস কাস্ট লং শ্যাডোজ’ ধারণাটির সার্থক রূপায়ন। রহস্যভেদে কয়েকটা ফাঁক থাকলেও, এবং অপরাধী বেশ সহজেই চিহ্নিত হয়ে গেলেও গল্পটা টাইট, এবং সুখপাঠ্য।
(২) অপরিমেয়: ‘আনন্দমেলা’-তে জুলাই ২০১৭-তেই প্রকাশিত হয় এই গল্পটি। কিঞ্চিৎ কষ্টকল্পিত হলেও অংকের ব্যবহা এই গল্পকে এমন একটি মাত্রা দিয়েছে যে এটিকে এই সঙ্কলনের শ্রেষ্ঠ গল্প বলাই চলে।
(৩) আলোছায়া স্টুডিও: বুদ্ধিদীপ্ত এবং কিছুটা নন-লিনিয়ার ধাঁচে লেখা হলেও একে গোয়েন্দা গল্প নয়, বরং রহস্য গল্প বলাই সঙ্গত। তথ্যপ্রমাণের বদলে অনুমান-উপমানের সাহায্যে এই গল্প যেখানে গিয়ে থেমেছে, সেখান থেকে আইনের চোখে ধৃত সন্দেহভাজনদের শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবলে ‘হানোজ দিল্লি দূর অস্ত’ কথাটাই মনে আসে।
(৪) পুরাতন খেলা: এই গল্পেও রহস্য আছে। “ওয়ান্স ইউ এলিমিনেট দ্য ইম্পসিবল, হোয়াটেভার রিমেইনস, নো ম্যাটার হাউ ইমপ্রবেবল, মাস্ট বি দ্য ট্রুথ” ম্যাক্সিম মেনে তার একটা সমাধানও আছে। কিন্তু আইনের হাত এখানেও অপরাধীর নাগাল পায়নি।
(৫) দুই শতাব্দী পরে: অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে এই গল্পটি। একটু যত্ন নিয়ে, আরেকটু গবেষণা আর জায়গা নিয়ে লিখলে, সর্বোপরি দুই শতাব্দীতে আমূল বদলে যাওয়া ভূগোলের বাধা এড়িয়ে কীভাবে গুপ্তধন পুনরুদ্ধার সম্ভব তা বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে উপস্থাপন করতে পারলে এই গল্পটি প্রয়াত গবেষক চিত্রা দেব-এর সৃষ্ট গোয়েন্দা সঞ্জয়-এর ইতিহাস ও অপরাধ মেশানো রহস্যভেদের কাহিনি ‘সিদ্ধিদাতার অন্তর্ধান’ ও ‘রূপমতীর মালা’-র সার্থক অনুসারী হতে পারত।
(৬) লালবাবুর নাতনি: একটি উৎকৃষ্ট সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার হয়ে উঠতে পারত এই গল্পটি, যদি লেখক ফরম্যাটিং এবং অনুচ্ছেদ-বিভাজনের মাধ্যমে গল্পটাকে ক্লাস ইলেভেনের রচনার মতো করে না লিখে আরো গতিময়, আরো টানটান করে সাজাতেন।
(৭) ঘাতক সম্মেলন: আগাথা ক্রিস্টির ‘কার্ডস অন দ্য টেবল’-এর মতো একটা ছকে শুরু হয়েও গল্পটা নিছক রহস্যভেদের কাহিনি হয়নি, বরং অত্যন্ত বুদ্ধির সঙ্গে লেখক ছকটিকে কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করে মনস্তত্ত্বের একটি জটিল দিক তুলে ধরেছেন, যাতে ‘ক্রাইম ডাজ নট পে’ কথাটি ফুটে উঠেছে জোরালো আকারে।

সামগ্রিকভাবে আমি দু’টি মাত্র কথা বলতে পারি।
প্রথমত, এই সময়ের অত্যন্ত ব্যতিক্রমী একটি রহস্য কাহিনির সঙ্কলন হল এই বইটি। এর প্রতিটি গল্প অন্যের চেয়ে আলাদা। এদের পেছনে লেখকের ভাবনার যে স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য ধরা পড়েছে তা দস্তুরমতো ঈর্ষণীয়। এমতাবস্থায়, মাত্র ১৪৪ টাকা দামের এই বইটি কিনতে দ্বিধাবোধ করলে পাঠকের লোকসান।
দ্বিতীয়ত, বিভা পাবলিকেশন অবিলম্বে একজন পেশাদার কপি এডিটর নিয়োগ না করলে, এবং সেই এডিটর সংসদ বা আকাদেমির বানানরীতি বিষয়ে অভিজ্ঞ না হলে, আমি তো বটেই, অন্য পাঠকেরাও এই প্রকাশনাকে হাবিজাবি পাবলিকেশন নামে ডাকতে শুরু করবে।


পাঠ শুভ হোক।

2 comments:

  1. অত্যন্ত তথ্যবহুল এই সমালোচনাটি। দুর্দান্ত উপভোগ করলাম। বইয়ের সমালোচনায় ঋজুবাবুর মতো দক্ষ সমালোচক বর্তমানে বিরল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অসংখ্য ধন্যবাদ। অনেক দিন ধরে আপনার লেখা পড়ার অপেক্ষায় আছি কিন্তু।

      Delete