Thursday 26 October 2017

আলোহান: একটি রূপকথার জন্ম



বিভা পাবলিকেশন থেকে সদ্য প্রকাশিত, রনিন লিখিত, ১২৮ পৃষ্টার, ১৪৪/- টাকা দামের এই পেপারব্যাক উপন্যাসটি নিয়ে কিছু লেখার আগে বইটির মুদ্রণ নিয়ে লিখতেই হচ্ছে।

সুমন্ত মল্লিক-এর অসামান্য প্রচ্ছদে শোভিত, আপাতভাবে সুমুদ্রিত এই বইটিতেও বিভা পাবলিকেশন-এর যাবতীয় দুর্বলতা, কিছু কম হলেও, প্রকট হয়েছে। রয়েছে বিস্তর বানান ভুল, এবং মোক্ষম টাইপো।
এই অবধারিত দুর্বলতাগুলো ছাপিয়ে মূল গল্পের কথা ভাবলে বইটা কেমন লাগে?

“আমাদের এই বইয়ের কাহিনি এমন এক সময়ের, এমন এক পৃথিবীর, যেখানে চলছে ঘোর দুর্দিন”।
আমি জানি আপনি কী ভাবছেন। মানুষ বাঘ-ভালুকের হাত থেকে বাঁচার, আর দু’মুঠো খেয়ে গুহার ভেতরে লুকোনোর ব্যবস্থা করার পর থেকেই নিজের আশপাশের দুনিয়াটা সম্বন্ধে এই কথাটা ভেবে আসছে, তাই না?
সভ্যতার ঊষালগ্নেও সাহিত্য বলতে যা রচিত হয়েছে তাতে মানুষের বিশ্বাস উৎপাদন করার জন্য, তার সাহসের মরুভূমিতে এক চিলতে সবুজ লালনের আশায় এমন পটভূমি তৈরি করা হয়েছে, যেখানে নায়ক (ও তার সঙ্গীদের) যেতে হয় এক দুরূহ যাত্রায়। আজও এমন লেখা হয়, শুধু তাকে আমরা ধর্মগ্রন্থ না বলে ফ্যান্টাসি বলি।
আলোচ্য বইয়েও খুব সহজ, কবিতার হালকা স্পর্শমাখা গদ্যে বলা হয়েছে এমন এক পৃথিবীর কথা, যেখানে দেবতাদের ক্ষমতালোভী যুবরাজের খেয়ালে পৃথিবী ধ্বংস হতে বসেছে। উজাড় হয়ে আসা পৃথিবীর এই ধুলোখেলায় অসহায় ক্রীড়নক হয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে মত্ত, বা লুট-তরাজের মাধ্যমে অবশিষ্ট মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে পশুর অধম হয়ে পড়ছে মানুষ।
একটি ছেলে ছাড়া।
নিজের পরিবার, নিজের ভালোলাগা, সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে সেই ছেলেটি। তাকে যেতে হবে বহু-বহু দূরে, যেখানে আছে এক মিনার, যার কাছে নাকি দেবতাদের দেখা মেলে।
নিষ্করুণ মরুভূমি, হিংস্র ও প্রতিহিংসাপরায়ণ দস্যুদল, মাটির নিচের বাসিন্দা ‘নরমাংসভোজী’ মানুষেরা, তুষারের ঝড়, ঈর্ষাকাতর দেবতার পাঠানো একের পর এক টোপ বা মৃত্যুবাহী ছোবল, এইসব অতিক্রম করে ছেলেটি কি পৌঁছতে পারবে সেই মিনারের কাছে?
কেউ কি থাকবে তার সঙ্গে শেষ অবধি?
কী হবে তার এই যাত্রার শেষে?
সুধী পাঠক মাত্রেই জানেন, শুধু একটি ‘কোয়েস্ট’ বা একটি চরিত্রের দুঃসাহসিক প্রয়াস কখনোই ফ্যান্টাসির উপজীব্য হয় না। এই বইয়েও লেখক দক্ষতার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন জীবন সংগ্রামের সার সত্য: বিপদে হাল না ছেড়ে বরং নিজের দেহ ও মনকে মজবুত করে প্রত্যাঘাত করতে হয়। তার সঙ্গেই এসেছে আমাদের অতি পরিচিত মহাকাব্যে পড়া পুত্রস্নেহ ও রাজকর্তব্যের দ্বন্দ্ব। এসেছে বিশ্বাসে ভর দিয়ে কতটা পথ চলা যায়, সেই প্রসঙ্গ।
তা বলে লেখাটা কি নিখুঁত? মোটেই নয়। এদের যে দুর্বলতাগুলো আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেগুলো হল:
(১) সবকিছু ঘটেছে ভীষণ সরলরৈখিক পথে।
(২) সব চরিত্র, বিশেষত খল চরিত্ররা এতটাই একমাত্রিক যে তারা মনে দাগ কাটতে পারে না।
(৩) ডিস্টোপিয়ান পৃথিবীতে সবচেয়ে আগে বিপন্ন হয় যে ইউনিটটি, সেই সংসারের বাঁধন একেবারে অটুট রেখে দিয়েছেন লেখক, যা অসম্ভাব্য।
(৪) লেখার শেষটায় বড়ো বেশি ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’ ভাব এসে গেছে, যেটা টোকিয়েন ও অন্যান্য কিংবদন্তি সাহিত্যিকের লেখায় দেখা যায় না।
কিন্তু তাও, সব মিলিয়ে, খুব সহজ ভাষায়, মূলত ইয়ং অ্যাডাল্ট বা কিশোর পাঠকদের জন্য লেখা এই ফ্যান্টাসিটি পড়লে দুটো কারণে আশাবাদী হওয়াই যায়:
১. এক নতুন লেখকের অনাড়ষ্ট কলমের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় হল এই বইয়ের মাধ্যমে।
২. এই মুহূর্তে বাংলায় ছোটোদের জন্য বিবেক কুণ্ডু-র লেখায় বুমবুম সিরিজ, এবং বড়োদের জন্য কল্পবিজ্ঞানের মোড়কে মল্লিকা ধর-এর কিছু লেখা ছাড়া ফ্যান্টাসি তেমন নেই। ওপার বাংলায় শরীফুল হাসান তাঁর অসামান্য “সাম্ভালা” ট্রিলজিতে একই সঙ্গে এনেছিলেন মিথ, হরর, থ্রিলার, কোয়েস্ট, এবং ফ্যান্টাসির ক্লিফনোটস কৃত সংজ্ঞার বাস্তবায়ন (ফ্যান্টাসি ফিকশন হল এমন এক জঁর যাতে বর্ণিত ঘটনাবলি কখনোই বাস্তবে সম্ভবপর নয়)। আলোচ্য উপন্যাস সেই স্তরে পৌঁছতে পারেনি, হয়তো পৌঁছতে চায়ওনি। কিন্তু আগামী দিনে সুযোগ পেলে লেখক তাঁর কল্পনাশক্তি এবং সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে নিঃসন্দেহে আমাদের আরো ব্যাপক, আরো গভীর, আরো ধারালো লেখা উপহার দেবেন।
অন্তত এটাই আমার বিশ্বাস।
পাঠ শুভ হোক।

No comments:

Post a Comment