Thursday, 27 January 2022

মেলানকোলির রাত

আজ থেকে দু'বছরেরও বেশি আগে, মানে এই মৃত ব্লগে শেষ পোস্টের মাসদুয়েক পরে, আমি একটা বইয়ের ভূমিকা লিখতে বসেছিলাম।

বইয়ের লেখক আমার ভাই। তার লেখা গল্পগুলো পড়তে গিয়ে একটা অব্যক্ত কষ্ট বুকের ভেতরে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। অথচ সেই গল্পগুলোরই সর্বাঙ্গে জড়িয়ে ছিল ভালোবাসার সুঘ্রাণ। তাই আমি... নিতান্ত না-লেখক অরসিক আমিও একটা ছোট্ট গল্প লিখে ফেলেছিলাম সেই ভূমিকায়।

গল্পটা ছিল~

"এই!"
"আরেহ! কখন এলে?"
"এই তো। সন্ধ্যাতারা ফুটল, কালীবাড়িতে কাঁসর-ঘণ্টা বাজল, আমিও পড়তে যাব বলে বেরিয়ে একদৌড়ে চলে এলাম বোসদের এই পুকুরটার পাশে।"
"কেন এলে মউ?"
"ও মা! এ আবার কী কথা? দিনে অন্তত একবার তোমায় না দেখলে আমার একদম ভাল্লাগে না।"
"আচ্ছা, তোমায় না দেখতে পেলেও কি কারও কষ্ট হয়?"
"হুঁউউউ। হয় বইকি।"
"তাই নাকি! কে সেই ভাগ্যবান? ধরে আনো তো তাকে আমার সামনে।"
"এই যে... আরেহ! এই! আমাকে ধরো! না...!"
একটা শরীর গড়িয়ে পড়ে যায় এঁদো পুকুরে। পানা আর ঝাঁঝির ফাঁসে বন্দি হয়ে সেটা তলিয়ে যায় সবুজ জলের নিরাপদ আশ্রয়ে।
আকাশ থেকে মুছে যাওয়া রঙের কষ্টে জ্বলজ্বল করে তারাদের চোখ।
শনশন হাওয়া আর ইতিউতি জোনাকির দলকে সাক্ষী রেখে পুকুরের ধার থেকে সরে আসে মৃত্যু। বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে চলে যায় অন্য কোনোখানে।

"মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান" গেয়ে ওঠা, মউ নামের মেয়েটা হারিয়ে যায় এই দুনিয়া থেকে দূরে, অনেক দূরে। তার যে সময় হয়েছিল চলে যাওয়ার।

আজ বড়ো বেশি করে এই গল্পটার কথা মনে পড়ছে।
ভালো মনের, চুপচাপ জীবনকে ভালোবাসা মউ-দের কি অকালেই চলে যেতে হয়?
অন্তত তারপর কি কেউ তাদের সঙ্গী হয় বাকি সময়টুকুর জন্য? কেউ কি তাদের বলে কল্পবিজ্ঞান বা ফ্যান্টাসি বা রহস্যের গল্প?
উত্তর পাওয়া যায় না এই প্রশ্নগুলোর। বাইরে ঘন হয় রাত।
মেলানকোলির রাত।

Monday, 30 September 2019

য়া দেবী!


মহালয়া এসে গেলেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দুটো ঢেউ আছড়ে পড়ে
একটা ঢেউ তোলেন বামপন্থী ও নারীবাদীরাএঁরা দুর্গাকে নানাবিধ অপশব্দে ভূষিত করে মহিষাসুরকে পরাভূত নায়কের স্থান দিতে সচেষ্ট হনএই ধারাতেই পোস্টিত হয় ‘আমার দুর্গা, তোমার দুর্গা…’ ইত্যাদি নানা চিৎকৃত ভাষ্য
দ্বিতীয় ঢেউয়ের লক্ষ্য হয় দুর্গাপূজার উৎস, রূপ, রূপান্তর, ইতিহাস – এই বিষয়ে যথাসাধ্য জানাচায়ের পেয়ালায় তুফান ওঠেদুর্গা আদৌ শাস্ত্রীয় দেবী কি না, তাই নিয়ে প্রায় লাঠালাঠি হয়
আমার আজকের পোস্ট এই দ্বিতীয় ঢেউ নিয়েইনিজের সীমিত সাধ্যের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করে আমি কয়েকটা বইয়ের সন্ধান পেয়েছি, যাদের অনুসরণ ও অনুধাবন করলে দুর্গাপূজার অতীত ও বর্তমান তথা তার শাস্ত্রীয় ও পৌরাণিক আখ্যান-ব্যাখ্যা অনেকটাই জানতে পারা যায়সেই বইগুলোর সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই এই পোস্টের মাধ্যমে



(১) শ্রীশ্রীদুর্গা তত্ত্বে ও কাহিনিতে~

স্বামী অচ্যুতানন্দের লেখা এই বইটির প্রকাশক দেব সাহিত্য কুটীরদুর্গাপূজার ধর্মীয় দিকটি সম্বন্ধে জানতে চাইলে মাত্র ১২০ পৃষ্ঠার এই বইটিকেই সবচেয়ে ভালো প্রাইমার বলা যেতে পারেযে-সব অধ্যায়ে এটি বিন্যস্ত, তাদের পরিচয় নীচে দিলাম:
-      শ্রীভগবতীর লীলা স্মরণ
-      মধুকৈটভ বধলীলা
-      মধুকৈটভনাশিনী মহাকালী
-      মহিষাসুরমর্দিনী
-      নারায়ণী স্তুতির ভাবানুবাদ
-      দেবী দুর্গার বহু রূপ ও বহু নাম
-      জয়ন্ত্যাদি শক্তি
-      নবদুর্গা
-      অষ্টশক্তি-অষ্টমাতৃকা
-      শুম্ভ-নিশুম্ভ কাহিনি
-      দেবতাদের স্তব
-      নানা রূপ ধরা দেবী
-      দেবীমাহাত্ম্য
-      শ্রীশ্রীদশমহাবিদ্যা
-      কে জানে কালী কেমন
-      কালীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ

(২) দেবীমাহাত্ম্য ও শ্রীশ্রীদেবী দুর্গা~

নবকুমার ভট্টাচার্য লিখিত এই শীর্ণকায় (মাত্র ৬৫ পৃষ্ঠা!) বইটির পরিবেশক পুস্তক বিপণিযাঁরা চণ্ডীপাঠ তথা মহামায়া’র আখ্যান প্রসঙ্গে দেবী দুর্গা’র সঙ্গে এই শক্তির সম্পর্কটি বুঝতে চান, তাঁরাই এই বইটির অভীষ্ট পাঠকগৌরচন্দ্রিকার পর এতে যে অধ্যায়গুলো রয়েছে, তাদের সূচি দেখলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে:
·        দেবীমাহাত্ম্য ও শ্রীশ্রীদেবী দুর্গা
·        চণ্ডী কে?
·        দেবীমাহাত্ম্য শ্রীশ্রীচণ্ডীতে মাতৃকা
·        দেবী-মহিষাসুর যুদ্ধের গতি প্রকৃতি ও যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র
·        অসুর দমনে সুরের কুমারী
·        নাম মাহাত্ম্যে দেবী চণ্ডী
·        দেবী আরাধনায় চণ্ডীপাঠ কেন?
·        চণ্ডীপাঠের নিয়ম-কানুন
·        চণ্ডীমণ্ডপ

(৩) মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা~

স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ রচিত, শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ থেকে প্রকাশিত Art & Culture Series-এর অন্তর্গত এই ৩৮২ পৃষ্ঠার বইটি দুর্গাপূজা নিয়ে ‘শাস্ত্রীয়, ঐতিহাসিক ও গবেষণামূলক আলোচনা’-র সংকলন২৬টি অধ্যায় ও পাঁচটি পরিশিষ্টতে বিন্যস্ত, প্রামাণ্য বিবলিওগ্রাফি-তে সমৃদ্ধ এই বইটিদেবী দুর্গার শাস্ত্রীয়, দার্শনিক, ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক ভিত্তি নিয়ে যদি জানতে চান, তাহলে এর চেয়ে ভালো রেফারেন্স বোধহয় পাওয়া যাবে নাএর গোটা সূচিপত্র তুলে দেওয়ার কথা ভেবেই হৃৎকম্প হচ্ছে, তবু লড়ে যাচ্ছিমা দুর্গার ব্যাপার বলে কথা!
প্রস্তাবনায় পাদপীঠরচনার সংক্ষিপ্ত-আলোচনা রয়েছে। তারপর শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ভাগ, অর্থাৎ গবেষণার আলোকে বিস্তৃত ও পূর্ণাঙ্গ-আলোচনাতাতে একে-একে এসেছে:
1.      ঋগ্বেদে দেবতা
2.     বিশ্বমাতৃত্বের ধারণা
3.    বেদে সপ্তমাতৃকা-প্রসঙ্গ
4.     শ্রীশ্রী চণ্ডীতে মাতৃকা ও মাতৃকাতত্ত্ব
5.    বিশ্বমাতৃকা ও মহাশক্তি ননা
6.    মহিষমর্দিনী-দুর্গা’র মূর্তিকল্পনায় বৈশিষ্ট্য
7.     পরমাপ্রকৃতি-বিশ্বজননী দুর্গা
8.    ভারতেতর-দেশে বিশ্বমাতৃত্বের ধারণা
9.     ক্রমবিকাশের পথে দেবী-ধারণায় শ্রীদুর্গা
10.       দেবী দুর্গা ও সূর্য বা মিত্রদেবতা
11.         দেবী দুর্গা’র জন্ম ও বিকাশরহস্য
12.        শিব ও শিবঘরণী-দুর্গা’র বিচিত্র রূপকল্পনা
13.       বাগ্‌দেবী সরস্বতী’র নামভেদ বৈদিকসাহিত্যে
14.        শ্রীশ্রীকাত্যায়নী দুর্গা
15.       আমাদের (গৌড়-বঙ্গে) দুর্গোৎসব
16.       শারদীয়া-শ্রীশ্রীদুর্গা’র অকালবোধন
17.        বৈদিকযুগে শরৎকালে রুদ্রযজ্ঞের অনুষ্ঠান
18.       অকালবোধনের কারণ, রহস্য ও তথ্য
19.        কাত্যায়নীতন্ত্র ও দেবীমাহাত্ম্য
20.      কূলচূড়ামণিতন্ত্রে মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা
21.        দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী ও দেবী দুর্গা
22.       দেবী দুর্গা’র মূর্তিরূপায়নের কথা
23.      মহিষরূপধারী মহিষাসুর ও দেবীকে অস্ত্র দান
24.       রূপে ও নাম-বৈচিত্র্যে দেবী দুর্গা
25.      দেবীর ধ্যান ও আরাধনা
26.      তন্ত্রে ও দর্শনে দেবী দুর্গা
পরিশিষ্টে স্থান পেয়েছে~ দেবী মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা’র স্বজন-পরিজন, রাজা কংসনারায়ণ ও বঙ্গে প্রথম দুর্গোৎসব, শ্রীশ্রীদুর্গাপূজায় সঙ্গীত ও রাগ-রাগিণী এবং দেবী দুর্গা’র স্নানমন্ত্রের সুর ও স্বরলিপি
দুর্গাপূজার দিনগুলোয় দেবীকে নিয়ে জানতে চাইলে ৩৮২ পৃষ্ঠার এই মহাগ্রন্থটি লা-জবাব

(৪) দুর্গা: বাংলার ঐতিহ্যে~

দীপঙ্কর ঘোষের সংকলনে ও সম্পাদনায়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত এ এক আশ্চর্য সুন্দর বই! দেবী দুর্গার রূপকল্পনায় সর্বভারতীয় ঐতিহ্য অনুসরণের পাশাপাশি বাঙালি শিল্পীরা এক নিজস্ব ভুবনও নির্মাণ করেছেনঅজস্র রঙিন ছবি ও আনুষঙ্গিক সংক্ষিপ্ত বিবরণ তথা আলোচনা দিয়ে এই বই সেই ভুবনটিকে ধরে রাখতে চেয়েছেসেই ছবিগুলো তুলে দিতে গেলে এই পোস্ট আয়ত্তের বাইরে চলে যাবেতাই আপাতত সূচিপত্র তুলে ধরলাম শুধু
§  প্রস্তাবনা: দীপঙ্কর ঘোষ
§  বাঙালির দুর্গা: গৌতম সেনগুপ্ত
§  ভাস্কর্য ও কারুশিল্প
§  চিত্র
§  প্রতিমাশিল্প
আমার সীমিত অভিজ্ঞতায় দুর্গা’র রূপকল্পনা ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ৭২ পৃষ্ঠার এই বইটির চেয়ে ভালো তথা দৃষ্টিনন্দন বই আর একটিও নেই

(৫) মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা~

সব পাঠকের জন্য, সবরকমের দৃষ্টিভঙ্গির ফসল হিসেবে জন্মানো অজস্র কৌতূহলের উত্তর দেওয়ার জন্য ‘ওয়ান স্টপ শপ’ হিসেবে যদি একটি বই চান, তাহলে ২৮৮ পৃষ্ঠার এই বইটির জবাব নেই‘নবকল্লোল’-এর বিভিন্ন শারদীয়া সংখ্যায় দুর্গা তথা শক্তির নানা রূপের উপাসনা নিয়ে যে-সব লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, তারাই স্থান পেয়েছে দেব সাহিত্য কুটীর থেকে প্রকাশিত এই সংকলনেএর সূচিপত্র দিতে গিয়েও হিমসিম খেতে হবে, তবু ‘জয় মা!’ বলে চেষ্টা করছি
1)     শক্তিপূজার উৎস সন্ধানে ~ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ
2)    দুর্গা: রূপে রূপান্তরে ~ স্বামী অচ্যুতানন্দ
3)    সপরিবারে দুর্গা ~ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ
4)    মাতৃসকাশে মিনতি ~ স্বামী জ্ঞানলোকানন্দ
5)    শক্তিদায়িনী মা দুর্গা’র অমৃতকথা ~ স্বামী বেদানন্দ
6)    অপরাশক্তি মা-মহামায়া ~ স্বামী অতীশানন্দ
7)    জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ~ স্বামী আত্মবোধানন্দ
8)    আদ্যাশক্তি দেবী মহামায়া ~ ব্রহ্মচারী নিত্যানন্দ
9)    দেবী হলেন দুর্গা ~ নন্দলাল ভট্টাচার্য
10)            বঙ্গে দুর্গোৎসব ~ রাধারমণ রায়
11)             দুর্গা-বিচিত্রা: বাংলার চালারীতির মন্দির-ভাস্কর্যে দুর্গা ~ মোহিত রায়
12)            দেবী’র আসা-যাওয়ার নেপথ্যে বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো ~ বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
13)            ভারতীয় দৃষ্টিতে মাতৃবন্দনা ~ পূর্বা সেনগুপ্ত
14)            দুর্গা: উৎস, বিস্তৃতি ও বৈচিত্র্য ~ মানস ভাণ্ডারী
15)            ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসব ~ পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
16)            দুটি প্রাচীন দুর্গাপূজা ~ দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
17)            সেকালের দুর্গোৎসবে একালের ঘটনা: সাহেব কলকাতার দুর্গোৎসব ~ বিদ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
18)            বর্গী বিতাড়ন ও সামন্তভূমের দুর্গাপূজা ~ শৈলেন চক্রবর্তী
19)            চিন্ময়ী থেকে মৃণ্ময়ী ~ অর্ক চৌধুরী
20)           ভিন্নরূপে দেবী দুর্গা ~ দেবযানী বসু
21)            দেবী দুর্গা’র রূপবৈচিত্র্য: একালের প্রেক্ষাপটে ~ প্রশান্ত দাঁ

মা দুর্গাকে নিয়ে আরও ভালোভাবে জানার জন্য এদের চেয়েও বেশি তথ্যনিষ্ঠ ও বিশ্লেষণাত্মক বই থাকতেই পারেতবে এই পথে হাঁটা শুরু করে অনেকদূর এগোনোর মতো পাথেয় এদের মধ্যে আপনি পেয়ে যাবেন – এ-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত
পুজো খুব-খুব ভালো কাটুক

Wednesday, 6 February 2019

অযুক্তি, না-তক্কো, ও হয়তো-গপ্পো


সব দোষ রাজা ভট্টাচার্য-র।
গতকাল এই মানুষটির সঙ্গে আড্ডা মারার ফাঁকে অরণ্যমন-এর স্টল থেকে বেরিয়ে চলে গেছিলাম বইমেলার আরেক মাথায় লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে। এরপর যা হয়। বাঁশবনে ডোম কানা হওয়ার মতো করে চারদিকে পত্র-পত্রিকার বিশাল সম্ভার দেখে আমি কেমন একটা দিশেহারা হয়ে গেলাম। এদিক-ওদিক ঘোরার ফাঁকে একটা ছোট্ট স্টলে ক’জন প্রবীণ মানুষকে একটা পত্রিকা নিয়ে বসে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম।
কেন?
কারণ তাঁদের সামনের টেবিলে রাখা ছিল ‘উন্মুক্ত উচ্ছ্বাস’ নামক একটি পত্রিকা-র ২০১৯ বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যা, যার প্রচ্ছদে বড়ো-বড়ো করে লেখা ছিল ‘রাজধানী দিল্লির নিজস্ব সাহিত্য পত্রিকা’। ইন্দ্রপ্রস্থের বাসিন্দা বাঙালিদের সাহিত্যচর্চার ওপর আমার সবিশেষ দুর্বলতা আছে। দেরি করা গেল না। মোটাসোটা সংখ্যাটা নিয়েই নিলাম। তারপর উদ্দেশ্যহীন কিঞ্চিৎ ঘোরাঘুরির পর পত্রিকাটা খুলে পড়তে শুরু করলাম। গল্প-কবিতা নিয়ে কিছু বলব না। সূর্য সেন-এর জীবন নিয়ে একটা আবেগজর্জরিত গল্প পড়েই মাথায় এক টন প্রশ্ন উদয় হল, যেগুলো নিয়ে পরে ঐশীকে জ্বালাতে হবে। কিন্তু আসল গুঁতোটা খেলাম পত্রিকার মূল অংশটি পড়তে গিয়ে, যা নিবেদিত হয়েছে এই সংখ্যার কেন্দ্রে থাকা মানুষটির জীবন ও কাজের নানা দিক নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনায়।
মানুষটি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।


বিদ্যাসাগর আমাদের কারও কাছে অজানা নন। আমার মতো গোদা লোকও তাঁকে নিয়ে একটা ছোটোখাটো রচনা লিখে কুড়িতে এগারো তুলে ফেলতে পারবে। তবু, নতুন করে মানুষটির কীর্তি, বিশেষত যে সাংঘাতিক বাধা ও শত্রুতা ঠেলে তাঁকে প্রতিটি ক্ষেত্রে এগোতে হয়েছিল তা পড়ে আমার আবার তব্দা লেগে গেল। কিন্তু মানুষটি এই হারকিউলিস-সম সংগ্রাম করে যা-যা আদায় করেছিলেন, তাদের বর্তমান অবস্থা কেমন?
আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে চলে যাওয়া মানুষটির অবিস্মরণীয় সিনেমাগুলোতে বহু মণিমুক্তো আছে। তাদের মধ্যে বাঙালি একটিকেই মিমযোগ্য বলে আঁকড়ে ধরেছে। সেটি অনুযায়ী যদি ভাবেন, বিশেষত ভাবা প্র্যাকটিস করাটা চালিয়ে যান, তাহলে দেখবেন~ নারীশিক্ষা তথা প্রাথমিক ও বুনিয়াদি স্তরের যথাসম্ভব মানুষের মনে সরল ও শুদ্ধভাবে মাতৃভাষা চর্চার স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেওয়ায় বাংলার অবস্থা এখনও শোচনীয়।
অথচ, আমরা আজও তাঁর মতো আরেকটি মানুষকে খুঁজে চলেছি। বিদ্যাসাগরের মতো, রামমোহনের মতো, দ্বারকানাথের মতো... কেউ তো আসুক! কোনো আলোর পথযাত্রী ঘর বাঁধুক এই অন্ধকার বালুচরে। ঈশ্বরের অবতার নয়, বরং এঁদের পুনর্জন্মের আশা বা খ্বোয়াইশ নিয়ে বাঁচি আমরা অনেকেই, তাই না? কিন্তু সে-সব ভাবতে গিয়েই আমার একটা কবিতার কথা মনে পড়ে গেল। কবিতাটা শেষ অবধি যেখানে পেলাম সেই সূত্রের শুদ্ধতা নিশ্চিত নয়, তাই ভুল থাকলে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

নচিকেতা
কেন ফিরে আস বার-বার?
স্মৃতির তুষার থেকে কেঁদে এসে শীতের তুষার
কেন হেঁটে পার হতে চাও?
এমন নির্জন রাতে সেই ভয়ে নক্ষত্র উধাও
অনন্ত আকাশ থেকে, সে-নির্মম মেঘের কুয়াশা
কোন্‌ সুখে বুকে টানো? এ-নরকে কীসের প্রত্যাশা?

তুমি কি জান না; যারা আসে
আকণ্ঠ পিপাসা নিয়ে সূর্যহীন এ সৌর আকাশে
চারদিকের মৃত গ্রহদের
কবর, প্রস্তর ভেঙে আসে; তারা নিজেরই রক্তের
পিপাসায় জ্বলে। কোনোখানে নেই একফোঁটা জল;
দীর্ঘশ্বাসে দ্বিখণ্ডিত এ মাটির অশ্রুই সম্বল।

কেন তবে সব ভুলে যাও?
এ-প্রেতপুরীর বুকে মুখ রেখে কোন্‌ সুখ পাও?
আসমুদ্রহিমাচল এই মহাশূন্যের কান্নায়
কেবল পশুর নখ দাগ কাটে; বিষাক্ত হাওয়ায়
সাপের খোলসগুলি ভাসে শুধু; আর
দিনরাত্রির বুকফাটা ‘নেই, নেই, নেই’-এর চিৎকার।

সে চিৎকারে স্বর্গ-মর্ত্য টলে
পাথরও চৌচির হত ভারতবর্ষের বন্ধ্যা পাথর না হলে।
জঠরের অসহ্য ক্ষুধায়
ধূমাবতী জন্মভূমি সন্তানের দুর্ভিক্ষের ভাত কেড়ে খায়,
এ-কী চিত্র! নরকের সীমা
চোখ অন্ধ করে দেয়, মুছে নেয় চেতনার সমস্ত নীলিমা।

তাই নিয়ে নচিকেতা, তবু তুমি গড়বে প্রতিমা?
অন্ধ হবে, বোবা ও অধীর
তবু ক্লান্তিহীন, মৃত্তিকায় পুনর্জন্মের অস্থির
জিজ্ঞাসায় মৃত্যুর তুষার
বার-বার হেঁটে হবে পার?
অগ্নিদগ্ধ দুই হাতে কতবার খুলবে তুমি যমের দুয়ার?
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

মেলার শেষ চারটে দিন অক্ষরের উৎসবের পাশাপাশি আগুনের পরশমণি হয়ে উঠুক আপনাদের সবার কাছে। ভালো থাকুন।

Thursday, 22 November 2018

দরজা বন্ধ ছিল...



কিশোর ভারতী শারদীয়া ১৪২৫-এ রহস্য-রোমাঞ্চ ঘরানার গ্র্যান্ড মাস্টার অনীশ দেব এই নামে একটা উপন্যাস লিখেছেন। লেখক এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, একটি সত্য ঘটনাত দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এটি লেখা শুরু করেন। কিন্তু তারপর লেখাটা স্বয়ংচালিত হয়ে একটা ‘লকড্‌ রুম মিস্ট্রি’-র আকার নেয়। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, এই পত্রিকাতেই আমাদের সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক সৈকত মুখোপাধ্যায় যে লেখাটি পেশ করেছেন (“খুনি ম্যাজিক”) সেটিও একটি লকড্‌ রুম মিস্ট্রি! এমন সমাপতনে আমার ‘কল্পনা উত্তেজিত হইয়া উঠিল’। ঠিক করে ফেললাম, আজ এই নিয়েই আপনাদের বোর করব।

লকড্‌ রুম মিস্ট্রি মানে কী? রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যে ‘ইম্পসিবল ক্রাইমস’ নামক একটি বৃহত্তর ঘরানা আছে। এতে তদন্তের ভারপ্রাপ্ত সরকারি গোয়েন্দা বা পুলিশ মাথা ও গতর খাটিয়ে রহস্যের সমাধান করতে অসমর্থ হন। এক কথায় বলতে গেলে রহস্য সাহিত্যের শুরু থেকে দেখলে সব কাহিনির সূত্রপাত এই দিয়েই হয়, যেখানে পুলিশ স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইগো বিসর্জন দিয়ে গোয়েন্দার সাহায্য চায়। কিন্তু এদের মধ্যে আমাদের বিচার্য সেই অপরাধগুলোই যেখানে:
(ক) একটা, বা একাধিক খুন, নিদেনপক্ষে গুরুতর অপরাধ হয়েছে।
(খ) নিহত ব্যক্তি(দে)-র বা অপহৃত বস্তুটির নাগাল পাওয়া আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব ছিল, কারণ~
·      দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
·      জানলা বন্ধ বা এমন গড়নের যা দিয়ে কারও পক্ষে কিছু করা বাস্তবে সম্ভব নয়, মানে টেলিপোর্টেশন, অকাল্ট মেথড, ইথারে ভাইব্রেশন তোলা (বাণ মারা?) এসব সমাধান চলবে না।
·      যাদের খুন করার মতো মোটিভ ছিল তারা সেই সময় কোনো তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে ছিলেন বলে অ্যালিবাই আপাতভাবে ওয়াটারটাইট। এই শেষের শর্তটি মানা হতেও পারে, নাও পারে, তবে হলে যে কেস জমে যায় তা সহজবোধ্য।
সংক্ষেপে বলতে গেলে এই রহস্য শুধুমাত্র হু-ডান-ইট্‌ নয়, বরং হাউ-ডান-ইট্‌-ই এক্ষেত্রে গোয়েন্দার মস্তিষ্কের পুষ্টি ঘটায় এবং তাকে তাড়িত করে।

বাংলায় মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য তাঁর গোয়েন্দা হুকাকাশি-কে দিয়ে অন্তত একটি ইম্পসিবল ক্রাইম সলভ করিয়েছেন। অনীশ দেব তাঁর হুনুর্‌ অশোকচন্দ্র গুপ্ত-কে দিয়ে একাধিক লকড্‌ রুম মিস্ট্রি সল্ভ করিয়েছেন। তবে এই ঘরানায় ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যে এমন বেশ কিছু গল্প ও উপন্যাস রয়েছে যাদের ক্লাসিক বলতে দ্বিধা হয় না। এদের মধ্যে যেগুলো আমি নিজে পড়েছি, তাদের সঙ্গে এই সুযোগে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। লেখাগুলো আমি কালানুক্রমিকভাবে সাজিয়েছি। আমার পছন্দের অর্ডার অনুযায়ী নয়।

(১) মার্ডার্স ইন দ্য রু মর্গ: ১৮৪৫ সালে এডগার অ্যালান পো-র একাধিক লেখার সংকলন ‘টেলস্‌’-এ প্রকাশিত এই গল্পটির সমাধান পড়ে আমার পিত্তি চটকে গেছিল। কিন্তু ইম্পসিবল ক্রাইম ব্যাপারটা কীভাবে সাজাতে হয়, তার টেমপ্লেট তৈরি হয় এই গল্পে।


(২) দ্য মিস্ট্রি অফ দ্য ইয়েলো রুম (১৯০৮): গথিক সাহিত্য তথা রহস্যের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন হিসেবে যে লেখাগুলো পরিগণিত হয়, তাদের মধ্যে একটি হল “দ্য ফ্যান্টম অফ দ্য অপেরা” (১৯০৯ ও ১৯১০-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত, ১৯১০-এ গ্রন্থবদ্ধ)। বহুবার চলচ্চিত্রায়িত এবং নানা রূপে মঞ্চে পরিবেশিত এই যথার্থ ক্লাসিকটি লিখেছিলেন গ্যাস্টন লারু। কিন্তু তার আগেই লারু লেখেন উপরোক্ত রহস্য উপন্যাসটি। রীতিমতো ম্যাপ দিয়ে, ঘটনার সময়ে বিভিন্ন চরিত্র কোথায় কী অবস্থায় ছিল সেগুলো তাতে চিহ্নিত করে লারু যা একটি জিনিস নামান তা পরবর্তীকালে এই ঘরানার লেখালেখি কীভাবে হওয়া উচিত, তার মডেল হয়ে দাঁড়ায়।


(৩) দ্য ওরেকল অফ দ্য ডগ (১৯২৬): জি.কে. চেস্টারটনের অমর সৃষ্টি ফাদার ব্রাউন-এর বেশ কিছু কাহিনি ‘দ্য ইনক্রেডুলিটি অফ ফাদার ব্রাউন’ নামের বইয়ে সংকলিত হয়। তাতে স্থান পাওয়া এই গল্পটির সামনে রহস্য-রোমাঞ্চের যেকোনো ভক্ত আভূমি নত হয়ে সেলাম ঠুকবে। শুধু এই গল্পটি নয়। এই বইয়েই আছে আরও খান তিনেক গল্প যাদের স্বচ্ছন্দে ইম্পসিবল ক্রাইম ঘরানায় রাজসভায় বসানো যেতে পারে। ইনফ্যাক্ট আমি গোটা ফাদার ব্রাউন সিরিজটাই অবশ্যপাঠ্য বলব।


(৪) দ্য গ্রিক কফিন মিস্ট্রি (১৯৩২): এলেরি কুইন নামক গোয়েন্দাকে কেন্দ্রে রেখে লেখা ইম্পসিবল ক্রাইম সিরিজের সেরা বই এটি নয়। তবে এই উপন্যাসটি ইম্পসিবল ক্রাইম-এর ক্ষেত্রে রীতিমতো সম্ভ্রমের সঙ্গে আলোচিত হয়। প্লট নিয়ে একটু লিখি। গল্পের শুরু খুবই স্বাভাবিকভাবে, যখন এক ধনকুবের স্বাস্থ্য ও বয়সের ধাক্কায় মারা যান। মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয়, তাঁর উইলসহ একটা বাক্স সিন্দুক থেকে গায়েব। সর্বত্র খুঁজেও সেটা পাওয়া গেল না। তখন বাধ্য হয়ে মৃতদেহটাই কবর থেকে তোলা হল এই ভেবে যে কেউ কফিনের মধ্যে বাক্সটা পাচার করে দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করতে চেয়েছে। না, সেখানেও বাক্সটা পাওয়া গেল না। তবে কফিন খুলে তার মধ্যে মৃতদেহের সঙ্গে আরও একটা লাশ পাওয়া গেল, যাকে খুন করা হয়েছে!


(৫) দ্য থ্রি কফিনস্‌, নামান্তরে দ্য হলো ম্যান (১৯৩৫): লকড্‌ রুম মিস্ট্রি-র ক্ষেত্রে যাঁকে সম্রাট বলে মনে করা হয় সেই জন ডিকসন কার-এর লেখা এই উপন্যাসটি রহস্যসাহিত্যে এটি প্রায় গীতা-টাইপের স্ট্যাটাস পায়। শুধু কাহিনির প্যাঁচালো প্রকৃতির জন্য নয়। এই উপন্যাসে রহস্যভেদী ডক্টর গিডিয়ন ফেল-এর মুখে লকড্‌ রুম মিস্ট্রির প্রকারভেদ ও তার সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে যে বক্তৃতাটি আছে সেটিকে এই ধারায় লেখালেখি করতে গেলে পাঠ্যপুস্তক ভাবা উচিত।


(৬) মার্ডার ফর ক্রিসমাস (১৯৩৮), নামান্তরে এরকুল পোয়ারো-জ ক্রিসমাস (১৯৩৯): ‘রহস্যের রানি আগাথা ক্রিস্টি’ (উপাধিটি নির্লজ্জভাবে প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত-র বই থেকে ঝেড়ে দিলাম। প্রসঙ্গত, ডেম আগাথা-কে নিয়ে কিছু জানতে চাইলে ওই নামের বইটির চেয়ে ভালো সোর্স বা রিসোর্স বাংলায় অন্তত পাবেন না, এটাও বলে রাখলাম।) এমন অনেক কাহিনিই লিখেছেন যা ইম্পসিবল ক্রাইম বলে বিচার্য। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত ‘মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’ বোধহয় জনপ্রিয়তা আর চলচ্চিত্রায়িত হওয়ার দিক দিয়ে কোনান ডয়েলের ‘দ্য হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস্‌’-কে টক্কর দেবে; তাতেও মাথা গুলিয়ে যাওয়ার পর্যাপ্ত উপকরণ আছে। একইভাবে ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত ‘অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়াজ নান’ ক্রিস্টির জনপ্রিয়তম উপন্যাসই শুধু নয়, এমনকি তাঁর নিরিখেও সেটি সবচেয়ে ‘কষ্টকল্পিত’ রহস্য বলে বিচার্য। কিন্তু যেটির কথা লিখলাম সেটি মানবসম্পর্কের আলো-ছায়া ফুটিয়ে তুলে, আমার মতে, আরও বিশুদ্ধ রহস্য হয়ে উঠতে পেরেছে।


(৭) দ্য কেস অফ দ্য কনস্ট্যান্ট সুইসাইডস (১৯৪১): জন ডিকসন কার্‌-এর লেখা প্রায় সব গল্প-উপন্যাসই লকড্‌ রুম মিস্ট্রির পাঠকদের কাছে টেক্সট-তুল্য। এই বইটিও ব্যতিক্রম নয়। স্কটিশ হাইল্যান্ডে একটি কাসলে জমায়েত হয় বেশ কয়েকটি মানুষ। সেই কাসলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা অপমৃত্যুর কিংবদন্তির সঙ্গেই জুড়ে যেতে থাকে একের পর এক মৃত্যু, যাদের দেখে আত্মহত্যা মনে হলেও ব্যাপারটা, লালমোহনবাবু-র ভাষায়, হাইলি সাসপিশাস। ডক্টর গিডিয়ন ফেল এবারেও ফেল করেননি। কত রকমভাবে বন্ধ ঘরের মধ্যে একজনকে খুন করা যেতে পারে সেই নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি খুনিকেও চিহ্নিত করেন তিনি।


(৮) রিম অফ দ্য পিট (১৯৪৪): হেক টেলবট-এর লেখা এই উপন্যাসটি শুধু লকড্‌ রুম মিস্ট্রি নয়। খুনের পাশাপাশি বরফে আপাতভাবে অদৃশ্য কারও পায়ের দাগ, লোকালয় থেকে বহু দূরে বরফবন্দি একটি বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে জমে ওঠা ভয়, টেনশন, সন্দেহ, রোমান্স, এবং ম্যাজিক মিশিয়ে একটি দারুণ উপভোগ্য রহস্য পরিবেশন করে। নামজাদা সম্পাদক থেকে পাঠক, প্রায় সবাই এই উপন্যাসটিকে ভূরি-ভূরি নম্বর দিয়েছেন। এখনও ভোটাভুটি হলে সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম লকড্‌ রুম মিস্ট্রির তালিকায় এটি প্রথম পাঁচে থাকে।


(৯) দ্য ফোর্থ ডোর (১৯৮৭): জন ডিকসন কার্‌-এর সার্থক উত্তরসূরী হিসেবে গণ্য ফরাসি লেখক পল হল্টার-এর প্রথম উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয় ২০১০-এ, কিন্তু ততদিনে এটি স্বনামে এবং ‘দ্য হুডিনি মার্ডারস’ নামেও ক্লাসিক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। সত্যি বলছি, এমন মাথা-গুলিয়ে-দেওয়া লেখা আমি আমার জীবনে আজ অবধি একটিও পড়িনি। বইটা শেষ করার পর একদম ‘বুঝভোম্বল’ স্টাইলে ভেবেছিলাম, “কেসটা কী হল?” প্রসঙ্গত, এই উপন্যাস আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছে, কেন এই ধরনের রহস্য সমাধান করতে গেলে ম্যাজিক তথা ইল্যুশন সম্বন্ধে জ্ঞান এত গুরুত্বপূর্ণ।


(১০) দ্য ডক্টর্স কেস (১৯৮৭): এই গল্পটি তিনটি কারণে ঐতিহাসিক। প্রথমত, এটি স্টিফেন কিং-এর লেখা একমাত্র হোমসিয়ান প্যাস্টিশ, যা হোমসের আত্মপ্রকাশের শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত ‘দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার্স অফ শার্লক হোমস’-এ স্থান পেয়েছিল। দ্বিতীয়ত, এটি কিং-এর লেখা এযাবৎ একমাত্র লকড্‌ রুম মিস্ট্রি। তৃতীয়ত... গল্পের নামটা থেকে কি কিছু বুঝতে পারছেন? বাকিটা বুঝতে গেলে আপনাকে গল্পটা পড়তে হবে। কিং-এর গল্প-সংকলন ‘নাইটমেয়ার্স অ্যান্ড ড্রিমস্কেপস্‌’-এ গল্পটা পাবেন। জন জোসেফ অ্যাডামস্‌ সম্পাদিত প্যাস্টিশ সংকলন ‘দ্য ইমপ্রোবেবল অ্যাডভেঞ্চার্স অফ শার্লক হোমস’-এও এটি পাওয়া যাবে।


না। আর লিহুম না। ল্যাহনের কিসু নাই। খালি পড়নের আসে। যদি এই ধারায় পড়াশোনা করে মগজাস্ত্রে ধার দিতে চান, তাহলে ঝটপট বইগুলো জোগাড় করে পড়ে ফেলুন। আর এতগুলো বই কেনার মতো অবস্থায় যদি না থাকেন, অথচ আলোচনাটা কৌতূহলোদ্দীপক বলে মনে হয়, তাহলে মার্টিন এডওয়ার্ডস্‌ সম্পাদিত ‘মিরাকুলাস মিস্ট্রিজ’ নামক গল্প-সংকলনটি জোগাড় করুন এবং পড়ে ফেলুন। 

আটলান্টিকের ওপারের লেখাজোখা এতে নেই, কারণ বইটি প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ লাইব্রেরি ক্রাইম ক্লাসিক্স সিরিজে। সেইসব গল্প পড়তে চাইলে অটো পেঞ্জলার সম্পাদিত একটি অতিবৃহৎ সংকলন আছে বটে, তবে তাতে জালি গল্প প্রচুর।
তবে হ্যাঁ, এই নিয়ে পড়াশোনা শুরুর আগে একটি বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ লিখে দিই। এই গল্পগুলো আদ্যন্ত কৃত্রিম, এবং যতটা না রহস্যভেদ, তার চেয়ে বেশি ইন্টেলেকচুয়াল এক্সারসাইজ। মগজাস্ত্রে শান দেওয়াই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে পোলিস প্রোসিডিওরাল পড়া ভালো, কারণ সেগুলো বাস্তবকে অনেক বেশি প্রতিফলিত করে। আর যদি বাস্তব থেকে পালিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ ইত্যাদি চান, তাহলে লুক নো ফারদার। রহস্যপ্রেমীদের কাছে এসকেপিস্ট এন্টারটেনমেন্টের পরাকাষ্ঠা এই লেখাক’টি পড়ে দেখলে ভালো লাগতেই পারে।
পাঠ শুভ হোক।