Saturday 20 January 2018

অ্যাডভেঞ্চার!


শব্দটা পড়ামাত্র কি আপনার রক্ত-চলাচল দ্রুততর হয়ে উঠেছে?
আপনি কি এমন কোনো জায়গার কথা ভাবছেন, যার সম্বন্ধে অনেক কিছু লেখা হয়েছে কয়েকশো বছর ধরে, যার সন্ধানে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেছেন অনেক অভিযাত্রী... কিন্তু, আজও যা রয়ে গেছে তথাকথিত সভ্য পৃথিবীর নাগালের বাইরে?
“চাঁদের পাহাড়”, “হিরেমানিক জ্বলে”, “পাহাড় চূড়ায় আতংক”-র চেয়ে বেশি কিছু পড়ার একটা হালকা ইচ্ছে কি শীতের রোদের মতো আপনার পিঠ, কান হয়ে মাথায় পৌঁছতে চাইছে?

১৮৭১ সাল। ওয়েলশ সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলি ফিরে এলেন আফ্রিকার গহনতম অরণ্য থেকে। নীল নদের উৎস খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া স্কটিশ মিশনারি ডেভিড লিভিংস্টোন-কে খুঁজে বের করেছেন তিনি! সেই বৃত্তান্তই প্রকাশিত হল খবরের কাগজে।
‘ডার্ক কন্টিনেন্ট’ নামে পরিচিত আফ্রিকার অন্দরমহলের সবুজ অন্ধকারের একটা স্পষ্ট ছবিও ফুটে উঠতে থাকল বাইরের পৃথিবীর চোখে।
নীল নদের পশ্চিম তীরে, থেবেস-এর উলটোদিকে অবস্থিত ‘ভ্যালি অফ দ্য কিংস’ খনন করে তখন নতুন করে লেখা হচ্ছে ইতিহাসের অনেক কথা।
মধ্য আমেরিকার জঙ্গলের বুক থেকে মাথা তুলছে মায়া সভ্যতার বিভিন্ন পরিত্যক্ত স্থাপত্য।
এমনকি, হোমারের বর্ণনায় পড়া যে ট্রয় তখনও স্রেফ কিংবদন্তির বিষয় হয়ে ছিল, তাকেও ততদিনে খুঁজে পাওয়া গেছে আনাতোলিয়ার বিগা উপদ্বীপে!

এবার ভাবুন এক রোমান্টিক তরুণের কথা। সে জুলু যুদ্ধ ও বোয়র যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। জঙ্গলের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া গ্রেট জিম্বাবোয়ে সভ্যতার ভাঙাচোরা অবশেষ নিজের চোখে দেখেছে সে। তার ওপর এসবের কেমন প্রভাব পড়তে পারে?
হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের মাথায় সাহিত্যের পোকাটা কামড় বসিয়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু ১৮৮৩ সালে অন্য একটা ঘটনা ঘটল। ওই বছর প্রকাশিত হল রবার্ট লুই স্টিভেনসন-এর লেখা সুপারহিট উপন্যাস ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’। কথায়-কথায় হ্যাগার্ড ভাইয়ের সঙ্গে পাঁচ শিলিং-এর বাজি ধরে ফেললেন— এর থেকেও ভালো বই তিনি লিখে দেখাবেন! লোথার ছাড়া এ-জগতে সবাই টের পেয়েছে, করাটা বলার চেয়ে ঢের কঠিন। তাই হ্যাগার্ড লেগে পড়লেন। স্কটিশ অভিযাত্রী জেমস থমসন-এর জনপ্রিয় বই ‘থ্রু মাসাই ল্যান্ড’ থেকে তথ্য নিয়ে, বিখ্যাত ব্রিটিশ হোয়াইট হান্টার ফ্রেডরিক হেনরি সেলাস-এর আদলে কেন্দ্রীয় চরিত্র অ্যালান কোয়াটারমেইন-কে গড়ে হ্যাগার্ড একটা রোমহর্ষক উপন্যাস লিখলেন
সেপ্টেম্বর ১৮৮৫-তে ‘দ্য মোস্ট অ্যামেজিং বুক এভার রিটেন’ তকমা গায়ে এঁটে আত্মপ্রকাশ করল— “কিং সলোমন’স মাইনস।”




“কিং সলোমন’স মাইনস” এতটাই জনপ্রিয় হয় যে প্রকাশক বইটা ছেপে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। শুধু জনপ্রিয়ই নয়, সাহিত্যে একটি আস্ত জঁর তৈরি হয় এই বইয়ের সৌজন্যে, যাকে হারানো জাতি/সভ্যতা-র সন্ধান নামে চিহ্নিত করা যায়।
কিন্তু কী এমন ছিল ওই বইয়ে, যা আর কোনো পেনি-ড্রেডফুলেও পাওয়া যায়নি?
একটা মানচিত্র সম্বল করে যাত্রা— এ জিনিস আরও অনেক বইয়ে পাওয়া যায়। কিন্তু কয়েকজন বন্ধু ও এক পোড়খাওয়া অভিযাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে অজানার অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া আপনজনকে খুঁজে বের করার চেষ্টা— এটা স্পেশাল। পদে-পদে আসা বিপদের সঙ্গে সাহস আর বুদ্ধি দিয়ে বোঝাপড়া করা— এ জিনিস অন্যত্র পাওয়া যায়। কিন্তু অব্যাখ্যাত রহস্য, বিশ্বাসঘাতকতা, ট্র্যাজেডি-র এমন সমন্বয়? নাহ! এতগুলো উপাদান দিয়ে সাজানো বই এর আগে পাঠকেরা পাননি।

সাহিত্যের সীমা ছাড়িয়েও প্রভাব বিস্তার করেছিল "কিং সলোমন'স মাইনস।" সাম্রাজ্যবিস্তারের বাসনা হোক বা ভৌগোলিক অনুসন্ধিৎসা— অজানার আহ্বানে সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেককে উৎসাহিত করে এই বইটি। তাঁদের মধ্যে যে মানুষটি সত্যিই ইতিহাস গড়ে দেন তিনি হলেন— লেফটেন্যান্ট কর্নেল পার্সিভ্যাল হ্যারিসন ফসেট




১৮৮৬ সালে রয়্যাল আর্টিলারি-তে লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেন ফসেট। ১৯০১ সালে তিনি রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটি-র সদস্য হন অভিযান চালানো আর ম্যাপ বানানোর কৌশল আয়ত্ত করতে।
কেন?
যাতে, সার্ভেয়ার-এর ছদ্মবেশে উত্তর আফ্রিকায় ঘোরাঘুরি করে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস-এর হয়ে তথ্য সংগ্রহ করার সময় তাঁর নকল চেহারাটা যেন ধরা না পড়ে!
অভিযাত্রী হিসেবে ফসেটের দক্ষতা রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটিকে মুগ্ধ করেছিল। ১৯০৬ সালে ব্রাজিল-বলিভিয়া সীমান্তে একটি দুর্গম জঙ্গুলে জায়গার ম্যাপ বানানোর জন্য তাঁকেই পাঠানো হয়। মাত্র ৩৯ বছর বয়সী ফসেট সেই অভিযান চলাকালীন ম্যাপ তো বানিয়েইছিলেন। সেই কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন অনেক তখনও অবধি অজানা পশু-পাখি। এতেও শেষ নয়! প্রাণের দায়ে ওই অভিযানে ফসেট মেরেছিলেন একটি ৬২ ফুট লম্বা অ্যানাকন্ডা!


সাহস, ধৈর্য, স্থানীয় উপজাতিদের সঙ্গে ভদ্র ও সম্মানজনক ব্যবহার, মনের জোর— এগুলোই ছিল ফসেটের সম্বল। এদের ভরসাতেই ১৯০৬ থেকে ১৯২৪-এর মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকায় মোট সাতটি অভিযান চালিয়েছিলেন ফসেট। সেই বিবরণ ঠাঁই পেয়েছিল ‘এক্সপ্লোরেশন ফসেট’ বইয়ে। রিও ভার্দে এবং হিথ নদীর উৎসও খুঁজে বের করেছিলেন তিনি
আমাজন অববাহিকা থেকে লন্ডনে এসে পৌঁছোতে থাকে ফসেটের নানা ডিসপ্যাচ ও রিপোর্ট। তাঁর অনমনীয় ব্যক্তিত্বের প্রভাবও পড়তে থাকে তৎকালীন সাহিত্যজগতে। যাঁদের ওপর এই প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছিল, তাঁদের  মধ্যে ছিলেন সেই সময়ে দুনিয়ার জনপ্রিয়তম লেখকদের একজন। দুঃসাহসী, রগচটা, মারপিটে সিদ্ধহস্ত, অথচ হার-না-মানা— এমন এক চরিত্রকেই খুঁজছিলেন তিনি। রোগা, লম্বা, বরফশীতল মস্তিষ্কের যে নায়ক তাঁর অন্য সব লেখাকে ঢেকে রেখেছিল, তার ছায়া থেকে দূরে গিয়ে রোমহষর্ক কিছু লিখতে চাইছিলেন সেই লেখক।
তারপরেই জন্ম নেয় সেই অবিস্মরণীয় লেখা!




হ্যারি রুনট্রি’র অলঙ্করণে সমৃদ্ধ হয়ে, ১৯১২-র এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাস জুড়ে ‘স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিন’-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের অদ্বিতীয় উপন্যাস “দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড”। ফসেটের আদলে ডয়েল জন্ম দেন প্রফেসর জর্জ এডোয়ার্ড চ্যালেঞ্জার-এর। মেপল হোয়াইট ল্যান্ডের উদ্দেশে বেরিয়ে, প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের সঙ্গে চ্যালেঞ্জার, লর্ড রক্সটন, সাংবাদিক ম্যালোন-এর সাক্ষাতের সেই রোমহর্ষক কাহিনি পড়েননি, এমন কেউ কি আছেন?



অজানা জগতের মানচিত্র গড়া, সেইসব জায়গা ও তার মানুষদের লোকচক্ষুর সামনে নিয়ে আসা— এই দুটিই ছিল তখনও অবধি বিজ্ঞানজগতে ফসেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কিন্তু এত কিছুর পরেও অদম্য মানসিকতা তাঁকে নিশ্চেষ্ট ঘরবন্দি হতে দেয়নি।
কেন?
সে এক টালমাটাল সময়। বিশ্ব জুড়ে বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। চলছে হত্যালীলা। যুদ্ধ থামার পরেও মৃত্যুর করাল দংষ্ট্রা ইনফ্লুয়েঞ্জা এপিডেমিকের আকার নিয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে অসংখ্য জীবনদীপ। তবু, অতীতের পাতা উলটিয়ে অজানা সভ্যতা মানুষের চোখের সামনে আসাও তো থেমে থাকেনি।

২৪শে জুলাই ১৯১১ মার্কিন ঐতিহাসিক হিরাম বিংহ্যাম গোটা দুনিয়াকে চমকে দিলেন। পেরু-র মাচুপিচু অঞ্চলে পাহাড়ের ওপরে ছিল ইনকাদের রাজধানী। ষোড়শ শতাব্দীতে পরিত্যক্ত হয়েছিল অতুলনীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের সাক্ষ্য দেওয়া ওই দুর্গশহর বা সিটাডেল। বিংহ্যাম সেটিকে খুঁজে পাওয়ামাত্র সভ্য পৃথিবীর নজর সরে আসে আমাজনের অন্ধকার জঙ্গল থেকে আন্দিজের ওই পাহাড়চুড়োয়।

১৯১৯-২০-তে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র ওয়েস্টার্ন ডিভিশন সিন্ধুনদের কাছে লারকানা জেলায় একটা খোঁড়াখুঁড়ি করছিল। সুপারিন্টেন্ডিং আর্কিওলজিস্ট রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল সেখানে মোহেঞ্জোদারো নামের জায়গায় একটা ধ্বংসস্তূপ খুঁজে পেয়েছিলেন। তার ধাক্কায় এক ঝটকায় উপমহাদেশের ইতিহাস পিছিয়ে গেছিল কয়েক হাজার বছর!

ভ্যালি অফ দ্য কিংস-এর ‘কেভি ৬২’ নামে চিহ্নিত জায়গাটিতে লর্ড কারনাভন-এর উদ্যোগে, হাওয়ার্ড কার্টার-এর নেতৃত্বে খনন চলছিল। ৪ঠা নভেম্বর ১৯২২ সেই দলটা কয়েকটি সিঁড়ির ধাপ খুঁজে পায়। সেই ধাপ ধরে নেমে সভ্য পৃথিবী নাগাল পায় এমন এক কক্ষের, যেখানে আছে— অতুল সম্পদ, অজস্র রহস্য, এমনকি অভিশাপে ঘেরা তুতানখামেনের মমি!
সোনা আর রহস্যের ওই আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায় সব্বার। ইতিমধ্যে আমেরিকা আর ইংল্যান্ডের বেশ কিছু মানুষ ফসেটের ডিসপ্যাচ পড়ে একটা জায়গার কথা জেনেছিলেন। বহু-বহু বছর ধরে সেটা গুজব আর কিংবদন্তি হয়েই ছিল। তাঁরাও এতদিন তাকে ঠিক গুরুত্ব দেননি। কিন্তু এবার, ফসেটের ডিসপ্যাচের ভিত্তিতেই, তাঁরা একেবারে কোমর বেঁধে নেমে পড়েন।
কী বলেছিলেন ফসেট?


ব্রাজিলের মাতো গ্রসো এলাকায় এবং আমাজন অববাহিকায় অভিযান চালিয়েছিলেন ফসেট। সেই সময় স্থানীয় একাধিক উপজাতির মুখে তিনি অরণ্যের গভীরে লুকিয়ে থাকা একটি শহরের কথা শুনেছিলেন। শহরটিকে তিনি ‘লস্ট সিটি অফ জেড (Z)’ নাম দেন।
ইতিমধ্যে, ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ব্রাজিল-এ ফসেট একটি ডকুমেন্ট (ম্যানুস্ক্রিপ্ট ৫১২-পার্ট)-ও পেয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর এক পর্তুগিজ ভাগ্যান্বেষী জোয়াও ডা সিলিভা গিমারেজ ছিলেন ওই ডকুমেন্টের রচয়িতা। বাহিয়া প্রদেশে ১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ডা সিলভা নিজের একটি পরিত্যক্ত শহর দেখেছিলেন— এমনটাই বলা হয়েছিল তাতে। ডকুমেন্টে ছিল বিভিন্ন মূর্তি, চিত্রলিপিতে ঠাসা একটা ভাঙা মন্দির, ইত্যাদির বর্ণনাও।
ফসেটের ডিসপ্যাচে নথিভুক্ত এই কথাগুলো তুতানখামেনের সমাধি আবিষ্কারের পর হঠাৎই সবার মনে পড়ে গেল। ১৫৩৭ সালে স্পেনের কনকুইস্তাদরদের শোনা ‘এল ডোরাডো’-র গল্পগুলোও নতুন করে ফিরে এল আলোচনায়।
কী ছিল সেই গল্পগুলোতে?
ছিল স্থানীয় এক উপজাতির কথা। তাদের প্রধান বিশেষ কোনো তিথিতে সর্বাঙ্গে সোনার গুঁড়ো মেখে এক বিশেষ হ্রদের জলে স্নান করতেন।
ক্রমে সেই গল্পটা পল্লবিত হতে-হতে হয়ে যায় এমন এক শহরের আখ্যান— যেখানে সবকিছু সোনা দিয়ে তৈরি!

ফসেটের কাঠখোট্টা ডিসপ্যাচ হঠাৎ করে সেই শহরের অস্তিত্বকে বাস্তব করে তোলার ইঙ্গিত দেয়। লোকে জানত যে এই শহরের সন্ধান চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন অজস্র অভিযাত্রী। এই মারীচের খোঁজে বেরিয়ে অরণ্যের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে আস্ত এক-একটা বাহিনী। তবু, সোনার হরিণের চেয়েও অনেক বড়ো আবিষ্কার হত এই শহর— তাই না?

১৯২৫ সালে লন্ডনের একঝাঁক সম্পন্ন মানুষের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য জোগাড় করলেন ফসেট। তারপর তিনি ‘জেড’-এর সন্ধানে একটি সুপরিকল্পিত অভিযান চালালেন। তাতে তাঁর সঙ্গী ছিলেন তাঁর ছেলে ও ছেলের বন্ধু। বিশ্বাসী, অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু এবং সক্ষম দুই সঙ্গীকে নিয়ে ফসেট আমাজনের দক্ষিণপূর্ব দিকের একটি উপনদী— আপার জিঙ্গু পার হওয়ার সময় ‘ডেড হর্স ক্যাম্প’ নামের একটি শিবিরে পৌঁছোন। সেখান থেকে তিনি ২৯শে মে, ১৯২৫ তারিখে নিজের স্ত্রীকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠির বক্তব্য অনুযায়ী ফসেট রীতিমতো আশাবাদী ছিলেন অভিযানের সাফল্য নিয়ে। তিনি লিখেছিলেন যে তাঁরা সঠিক পথেই এগোচ্ছেন।
ব্যস!
এরপর ফসেট আর তাঁর দুই সঙ্গীর কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি।



রয়েল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটি তো বটেই, আরো অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এরপর দশকের-পর-দশক ফসেটের কথিত ‘সিটি অফ জেড’ তথা ফসেটের সন্ধানে বেরিয়ে ব্যর্থ হন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, বিশেষত তারপরের ঠান্ডা লড়াই তথা পারমাণবিক মহাসমরের সম্ভাবনা সব হিসেব গুলিয়ে দেয়। হারানো শহর বা সভ্যতার সন্ধান চলে যায় অনেক পেছনের সারিতে।
সাহিত্যের আঙিনাতেও এর প্রতিফলন ঘটে। রোমহর্ষক কাণ্ডকারখানা যা কিছু এরপর হতে থাকে তার বেশিরভাগই গুপ্তচরবৃত্তি বা মার্কিন-সোভিয়েত শিবিরের মধ্যে লড়াই নিয়েই।

অবশেষে, ১৯৮০ সালে, বিখ্যাত সাহিত্যিক মাইকেল ক্রিকটন পাঠকদের ফিরিয়ে আনেন এই জগতে। তাঁর লেখনীতে আমরা পাই এমন একটি উপন্যাস, যা ঘোষিতভাবেই ছিল ‘কিং সলোমন’স মাইনস’-এ কথিত রাজা সলোমনের হিরের খনির সন্ধান তথা হারানো শহর/জাতি নিয়ে লেখা। দারুণভাবে সমকালীন এবং তথ্য-তত্ত্ব-উত্তেজনায় ঠাসা এই উপন্যাসটি ছিল— “কংগো।”


রত্ন হিসেবে মূল্য না থাকলেও সেমিকন্ডাক্টর হিসেবে ইলেকট্রনিক্স-এর জগতে বিপ্লব এনেছিল টাইপ টু-বি ডায়মন্ড। সেই জিনিস খুঁজতে গিয়ে কংগোর ভিরুঙ্গা এলাকায় ক্যাম্প করা একদল বৈজ্ঞানিক ও অভিযাত্রীর একটি দল একদল ধূসররঙা গোরিলার হাতে আক্রান্ত হয়এবার শুরু হয় বিভিন্ন দেশের একটি কনসর্টিয়াম এবং ই.আর.টি.এস (মানে যারা প্রথম দলটিকে পাঠিয়েছিল)-এর আরেকটি দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা। দুই দলেরই লক্ষ্য হয় ওই জায়গায় আগে পৌঁছে ওই বিশেষ ধরনের হিরের খনির ওপর নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠা করা। দুর্ঘটনা, অন্তর্ঘাত, ওই এলাকার দেশগুলোতে চলা গৃহযুদ্ধ ও সামরিক অভ্যুত্থান— এমন নানা বিপদ সামলে বৈজ্ঞানিক কারেন রস-এর নেতৃত্বে এগিয়ে যায় দলটি। পথপ্রদর্শক হয় স্থানীয় এক অভিজ্ঞ ভাড়াটে সৈন্য চার্লস মুনরো। আরও থাকে একটি বুদ্ধিমান ও সাইন-ল্যাংগুয়েজে পারঙ্গম গোরিলা অ্যামি এবং তার ট্রেইনার পিটার ইলিয়ট।
ই.আর.টি.এস-এর দলটি ওই এলাকায় পৌঁছে দেখে, বেণীর সঙ্গে মাথা-র মতো হিরের খনির পাশাপাশি অন্য কিছুও পেয়েছে তারা— কিংবদন্তির হারানো শহর ‘লস্ট সিটি অফ জিনজ (ZINJ)’!
তারপর?
তারপর কী হল, তা জানতে হলে বইটা পড়তে, বা বইটার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া কিঞ্চিৎ কমজোরি সিনেমাটা দেখতে, অবিলম্বে তৎপর হউন!

সলোমনের খনি আর ফসেটের জেড-কে মিশিয়ে দেওয়া এই দুরন্ত উপন্যাস লিখে ক্রিকটন পাঠকের মনে আবার হারানো জাতি/শহর নিয়ে বিপুল আগ্রহের জন্ম দেন।
হলিউড পিছিয়ে থাকেনি। রহস্যময় জিনিসের সন্ধানে পৃথিবীর নানা বিপদসংকুল জায়গায় পাড়ি জমানো প্রত্নতাত্ত্বিক ডক্টর ইন্ডিয়ানা জোন্স-এর কীর্তিকলাপ পর্দায় হাজির হয়
রেলিক হান্টার বা টুম্ব রেইডার গোছের ভিডিও গেমসও ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে এইসময়।

১৯৯৫, সালে ডগলাস প্রেস্টন ও লিংকন চাইল্ড টেকনো থ্রিলার ঘরানাতেই একটি উপন্যাস লেখেন। সেটি ছিল— "রেলিক।"



এর কাহিনি শুরু হয় আমাজন অববাহিকার আপার জিংগু অঞ্চলে। আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি-র ডক্টর জুলিয়ান হুইটলসে’র নেতৃত্বে সেখানে একটি অভিযান চালানো হয়েছিল। তার লক্ষ্য ছিল কিংবদন্তির উপজীব্য ‘কোথোগা’ জাতি এবং তাদের উপাস্য ‘লিজার্ড গড’ মবয়ুন (Mbwun)-এর সন্ধান। সেই অভিযান মাঝপথেই পরিত্যক্ত হয়। হুটলসে-ও নিখোঁজ হয়ে যান।মিউজিয়ামের উদ্দেশে হুইটলসে যে-সব প্যাক করা ক্রেট পাঠিয়েছিলেন সেগুলো প্রথমে ব্রাজিলের বেলেমে পড়ে থাকে, তারপর জাহাজে চেপে গন্তব্যে এসে পৌঁছয়।
কিছুদিন পরের ঘটনা। মিউজিয়ামে তখন চলছে এক বিশাল অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। তার কয়েকদিন আগেই এক নিরাপত্তা রক্ষী আর বন্ধ হওয়া মিউজিয়ামে থেকে যাওয়া দুটি বাচ্চা ছেলে নৃশংসভাবে খুন হয়।
পুলিশ আসে, সঙ্গে আসেন ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের স্পেশাল এজেন্ট অ্যালয়সিয়াস পেন্ডারগাস্ট।
এই শেষোক্ত চরিত্রটিকে গড়া হয়েছিল পুরোপুরি শার্লক হোমসের আধুনিক তথা ‘কুলেস্ট পসিবল’ সংস্করণ হিসেবে। তাঁর কাছ থেকেই আমরা জানতে পারি যে বেলেমে একটি এবং ক্রেটগুলো বয়ে আনা জাহাজে একাধিক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে। অতঃপর শুরু হয় খুনি কে বা কী— তা জানার এবং তাকে আটকানোর চেষ্টা।
তারপর কী হল?
এক আদিম রহস্যের সঙ্গে আজকের শার্লক হোমসের টক্করের এই শ্বাসরোধী কাহিনিতে এরপর কী হল, তা জানতে চাইলে অবিলম্বে হস্তগত করুন ও পড়ে ফেলুন রেলিক” নামের এই বইটি!

কিন্তু তার পরেও তো কেটে গেছে আরো দু-দুটো দশক! হারানো জাতি বা শহরের সন্ধানে গিয়ে মাথা-খারাপ-করা রহস্য কি আর নেই? প্রাণপাখি-ওড়ানো বিপদের মোকাবিলা করা ছেড়ে দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা কি তাহলে ঘরে বসে টিভি দেখাতেই মনোনিবেশ করেছেন?
না, তা হয়নি। হ্যাগার্ড, ডয়েল, ক্রিকটন-এর ঘরানার যথার্থ উত্তরসূরি হিসেবে ইতিমধ্যেই এসে গেছিলেন জেমস রলিন্স। তাঁর উপন্যাস “আমাজনিয়া” প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে।


শুধু জনপ্রিয় নয়, রহস্য, রোমাঞ্চ, কল্পবিজ্ঞান, এবং অ্যাকশন পছন্দ-করা পাঠকদের কাছে বইটি কাল্ট ক্লাসিক হয়ে যায় প্রকাশের পরেই।
কেন?
আমাজনের গভীরে নিখোঁজ হয়ে গেছিল র‍্যান্ড সায়েন্টিফিক এক্সপিডিশন। সেই দলের এক সদস্য ছিলেন স্পেশাল ফোর্সের একজন প্রাক্তন সৈন্য। বেশ কয়েকবছর পর ক্ষতবিক্ষত ও মুমূর্ষু অবস্থায় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, অভিযান শুরুর আগেই তাঁর একটা হাত কাটা গিয়েছিল। কিন্তু জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসার পর দেখা গেল, তাঁর দুটো হাত-ই আছে!
এই রহস্যের সমাধান করার জন্য একটি অভিযাত্রী দল পাঠানো হয়। তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা, সৃষ্টিরহস্যের এক নতুন ব্যাখ্যা— এর পরেও এই উপন্যাস ক্লাসিক হবে না কেন?

ইতিহাস, বিজ্ঞান, অ্যাকশন, সম্ভব-অসম্ভবের মাঝে দোলানো ভাবনা— এই উপাদানগুলো দিয়ে ঠাসা রচনার জগতে মুকুটহীন সম্রাটই হয়ে ওঠেন জেমস রলিন্স। তিনি যে শুধু এই একটি বই লিখেই থেমে থাকেননি— এ-কথা বলাই বাহুল্য। তাঁর একাধিক লেখাতেই পূর্বসূরিদের উদ্দেশে নরম স্যালুট স্পষ্ট হয়েছে।
অ্যাডভেঞ্চারের জগতে রলিন্সের নিজস্ব সংযোজন হল— 'সিগমা ফোর্স।' এটি মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি গোপন শাখা, যার সদস্যেরা আবার দুর্ধর্ষ বিজ্ঞানীও বটে। এদের নানা কাহিনিতেই প্রাচীন রহস্যকে আধুনিক পৃথিবীতে জাগিয়ে তোলা হয়েছে অতুলনীয়ভাবে। তাদের মধ্যে দুটি লেখার কথা বলতেই হচ্ছে।


২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘দ্য সিক্সথ এক্সটিংশন” নামের এই টেকনো-থ্রিলারটি। কী আছে এতে?
আছে জীবজগতের কিছু আদিমতম রহস্য। আছে বেশ কিছু ‘যদি এমন হয়’ বা ‘হোয়াট ইফ’ পরিস্থিতি।আছে আন্টার্কটিকার তুহিন অবাচী থেকে আমাজনের গভীর জঙ্গলের মধ্যে এক ‘টেপুই’ বা টিলা জুড়ে ছড়ানো এক ষড়যন্ত্র। অবশ্যই আছে সেই মারাত্মক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঠেকাতে সিগমা ফোর্স ও অন্যান্যদের প্রাণপণ প্রয়াস।
এই 'মা কসম!' উপন্যাসটি যদি এখনও না পড়ে থাকেন, তবে সেই ত্রুটি দ্রুত সংশোধন করতে অনুরোধ করব। তবে হ্যাঁ, পড়ার সময় অন্তত ঘন্টা ছয়েক ফাঁকা রাখবেন, নইলে জীবনে প্রগাঢ় অশান্তি গ্যারান্টিড।


২০১৫-য় প্রকাশিত হয় রলিন্স-এর উপন্যাস “দ্য বোন ল্যাবাইরিন্থ।” আকর্ষণীয় উপাদানের দিক দিয়ে এই বইটিকেও সলোমনের খনির সঙ্গেই তুলনা করা যায়।
কী-কী আছে এতে?
আছে মানবজাতির ইতিহাসের একটি গূঢ় রহস্য। আছে মধ্যযুগের প্রত্নতত্ত্ব ও বিজ্ঞানচর্চা। আছে আটলান্টিস নামক হারানো সভ্যতার বাস্তবতা নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব। আছে প্রাণের উদ্ভব ও বিবর্তন নিয়ে ‘গোল্ডিলকস এনিগমা’ নামে খ্যাত প্রহেলিকা। আর এদের সব্বাইকে জুড়ে রেখেছে সমকালীন রাজনীতি ও বিজ্ঞানের পটভূমিতে আক্ষরিক অর্থে দম-আটকানো একটি অ্যাডভেঞ্চার।
সবচেয়ে বড়ো কথা কী জানেন?
এই কাহিনির ক্লাইম্যাক্স সংঘটিত হয়েছে মধ্য আমেরিকার এক রহস্যময় জঙ্গলে।
আর... কাহিনিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে সাইন-ল্যাংগুয়েজে দক্ষ ও অনেক মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান, ‘বাকো’ নামের একটি গোরিলা!
বৃত্তটা সম্পূর্ণ হল কি না, বলুন?

জানি না বইগুলো কত তাড়াতাড়ি জোগাড় করতে পারবেন। তবে ব্রাউসারের নিরাপদ আশ্রয়ে আধুনিক 'আমাজন অভিযান' সেরে ফেলতে পারলেই বইগুলো চলে আসবে আপনাদের হাতের মুঠোয়। আর তারপরেই জমবে...
অ্যাডভেঞ্চার!