Thursday 22 November 2018

দরজা বন্ধ ছিল...



কিশোর ভারতী শারদীয়া ১৪২৫-এ রহস্য-রোমাঞ্চ ঘরানার গ্র্যান্ড মাস্টার অনীশ দেব এই নামে একটা উপন্যাস লিখেছেন। লেখক এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, একটি সত্য ঘটনাত দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এটি লেখা শুরু করেন। কিন্তু তারপর লেখাটা স্বয়ংচালিত হয়ে একটা ‘লকড্‌ রুম মিস্ট্রি’-র আকার নেয়। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, এই পত্রিকাতেই আমাদের সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক সৈকত মুখোপাধ্যায় যে লেখাটি পেশ করেছেন (“খুনি ম্যাজিক”) সেটিও একটি লকড্‌ রুম মিস্ট্রি! এমন সমাপতনে আমার ‘কল্পনা উত্তেজিত হইয়া উঠিল’। ঠিক করে ফেললাম, আজ এই নিয়েই আপনাদের বোর করব।

লকড্‌ রুম মিস্ট্রি মানে কী? রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যে ‘ইম্পসিবল ক্রাইমস’ নামক একটি বৃহত্তর ঘরানা আছে। এতে তদন্তের ভারপ্রাপ্ত সরকারি গোয়েন্দা বা পুলিশ মাথা ও গতর খাটিয়ে রহস্যের সমাধান করতে অসমর্থ হন। এক কথায় বলতে গেলে রহস্য সাহিত্যের শুরু থেকে দেখলে সব কাহিনির সূত্রপাত এই দিয়েই হয়, যেখানে পুলিশ স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইগো বিসর্জন দিয়ে গোয়েন্দার সাহায্য চায়। কিন্তু এদের মধ্যে আমাদের বিচার্য সেই অপরাধগুলোই যেখানে:
(ক) একটা, বা একাধিক খুন, নিদেনপক্ষে গুরুতর অপরাধ হয়েছে।
(খ) নিহত ব্যক্তি(দে)-র বা অপহৃত বস্তুটির নাগাল পাওয়া আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব ছিল, কারণ~
·      দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
·      জানলা বন্ধ বা এমন গড়নের যা দিয়ে কারও পক্ষে কিছু করা বাস্তবে সম্ভব নয়, মানে টেলিপোর্টেশন, অকাল্ট মেথড, ইথারে ভাইব্রেশন তোলা (বাণ মারা?) এসব সমাধান চলবে না।
·      যাদের খুন করার মতো মোটিভ ছিল তারা সেই সময় কোনো তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে ছিলেন বলে অ্যালিবাই আপাতভাবে ওয়াটারটাইট। এই শেষের শর্তটি মানা হতেও পারে, নাও পারে, তবে হলে যে কেস জমে যায় তা সহজবোধ্য।
সংক্ষেপে বলতে গেলে এই রহস্য শুধুমাত্র হু-ডান-ইট্‌ নয়, বরং হাউ-ডান-ইট্‌-ই এক্ষেত্রে গোয়েন্দার মস্তিষ্কের পুষ্টি ঘটায় এবং তাকে তাড়িত করে।

বাংলায় মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য তাঁর গোয়েন্দা হুকাকাশি-কে দিয়ে অন্তত একটি ইম্পসিবল ক্রাইম সলভ করিয়েছেন। অনীশ দেব তাঁর হুনুর্‌ অশোকচন্দ্র গুপ্ত-কে দিয়ে একাধিক লকড্‌ রুম মিস্ট্রি সল্ভ করিয়েছেন। তবে এই ঘরানায় ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যে এমন বেশ কিছু গল্প ও উপন্যাস রয়েছে যাদের ক্লাসিক বলতে দ্বিধা হয় না। এদের মধ্যে যেগুলো আমি নিজে পড়েছি, তাদের সঙ্গে এই সুযোগে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। লেখাগুলো আমি কালানুক্রমিকভাবে সাজিয়েছি। আমার পছন্দের অর্ডার অনুযায়ী নয়।

(১) মার্ডার্স ইন দ্য রু মর্গ: ১৮৪৫ সালে এডগার অ্যালান পো-র একাধিক লেখার সংকলন ‘টেলস্‌’-এ প্রকাশিত এই গল্পটির সমাধান পড়ে আমার পিত্তি চটকে গেছিল। কিন্তু ইম্পসিবল ক্রাইম ব্যাপারটা কীভাবে সাজাতে হয়, তার টেমপ্লেট তৈরি হয় এই গল্পে।


(২) দ্য মিস্ট্রি অফ দ্য ইয়েলো রুম (১৯০৮): গথিক সাহিত্য তথা রহস্যের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন হিসেবে যে লেখাগুলো পরিগণিত হয়, তাদের মধ্যে একটি হল “দ্য ফ্যান্টম অফ দ্য অপেরা” (১৯০৯ ও ১৯১০-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত, ১৯১০-এ গ্রন্থবদ্ধ)। বহুবার চলচ্চিত্রায়িত এবং নানা রূপে মঞ্চে পরিবেশিত এই যথার্থ ক্লাসিকটি লিখেছিলেন গ্যাস্টন লারু। কিন্তু তার আগেই লারু লেখেন উপরোক্ত রহস্য উপন্যাসটি। রীতিমতো ম্যাপ দিয়ে, ঘটনার সময়ে বিভিন্ন চরিত্র কোথায় কী অবস্থায় ছিল সেগুলো তাতে চিহ্নিত করে লারু যা একটি জিনিস নামান তা পরবর্তীকালে এই ঘরানার লেখালেখি কীভাবে হওয়া উচিত, তার মডেল হয়ে দাঁড়ায়।


(৩) দ্য ওরেকল অফ দ্য ডগ (১৯২৬): জি.কে. চেস্টারটনের অমর সৃষ্টি ফাদার ব্রাউন-এর বেশ কিছু কাহিনি ‘দ্য ইনক্রেডুলিটি অফ ফাদার ব্রাউন’ নামের বইয়ে সংকলিত হয়। তাতে স্থান পাওয়া এই গল্পটির সামনে রহস্য-রোমাঞ্চের যেকোনো ভক্ত আভূমি নত হয়ে সেলাম ঠুকবে। শুধু এই গল্পটি নয়। এই বইয়েই আছে আরও খান তিনেক গল্প যাদের স্বচ্ছন্দে ইম্পসিবল ক্রাইম ঘরানায় রাজসভায় বসানো যেতে পারে। ইনফ্যাক্ট আমি গোটা ফাদার ব্রাউন সিরিজটাই অবশ্যপাঠ্য বলব।


(৪) দ্য গ্রিক কফিন মিস্ট্রি (১৯৩২): এলেরি কুইন নামক গোয়েন্দাকে কেন্দ্রে রেখে লেখা ইম্পসিবল ক্রাইম সিরিজের সেরা বই এটি নয়। তবে এই উপন্যাসটি ইম্পসিবল ক্রাইম-এর ক্ষেত্রে রীতিমতো সম্ভ্রমের সঙ্গে আলোচিত হয়। প্লট নিয়ে একটু লিখি। গল্পের শুরু খুবই স্বাভাবিকভাবে, যখন এক ধনকুবের স্বাস্থ্য ও বয়সের ধাক্কায় মারা যান। মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয়, তাঁর উইলসহ একটা বাক্স সিন্দুক থেকে গায়েব। সর্বত্র খুঁজেও সেটা পাওয়া গেল না। তখন বাধ্য হয়ে মৃতদেহটাই কবর থেকে তোলা হল এই ভেবে যে কেউ কফিনের মধ্যে বাক্সটা পাচার করে দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করতে চেয়েছে। না, সেখানেও বাক্সটা পাওয়া গেল না। তবে কফিন খুলে তার মধ্যে মৃতদেহের সঙ্গে আরও একটা লাশ পাওয়া গেল, যাকে খুন করা হয়েছে!


(৫) দ্য থ্রি কফিনস্‌, নামান্তরে দ্য হলো ম্যান (১৯৩৫): লকড্‌ রুম মিস্ট্রি-র ক্ষেত্রে যাঁকে সম্রাট বলে মনে করা হয় সেই জন ডিকসন কার-এর লেখা এই উপন্যাসটি রহস্যসাহিত্যে এটি প্রায় গীতা-টাইপের স্ট্যাটাস পায়। শুধু কাহিনির প্যাঁচালো প্রকৃতির জন্য নয়। এই উপন্যাসে রহস্যভেদী ডক্টর গিডিয়ন ফেল-এর মুখে লকড্‌ রুম মিস্ট্রির প্রকারভেদ ও তার সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে যে বক্তৃতাটি আছে সেটিকে এই ধারায় লেখালেখি করতে গেলে পাঠ্যপুস্তক ভাবা উচিত।


(৬) মার্ডার ফর ক্রিসমাস (১৯৩৮), নামান্তরে এরকুল পোয়ারো-জ ক্রিসমাস (১৯৩৯): ‘রহস্যের রানি আগাথা ক্রিস্টি’ (উপাধিটি নির্লজ্জভাবে প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত-র বই থেকে ঝেড়ে দিলাম। প্রসঙ্গত, ডেম আগাথা-কে নিয়ে কিছু জানতে চাইলে ওই নামের বইটির চেয়ে ভালো সোর্স বা রিসোর্স বাংলায় অন্তত পাবেন না, এটাও বলে রাখলাম।) এমন অনেক কাহিনিই লিখেছেন যা ইম্পসিবল ক্রাইম বলে বিচার্য। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত ‘মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’ বোধহয় জনপ্রিয়তা আর চলচ্চিত্রায়িত হওয়ার দিক দিয়ে কোনান ডয়েলের ‘দ্য হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস্‌’-কে টক্কর দেবে; তাতেও মাথা গুলিয়ে যাওয়ার পর্যাপ্ত উপকরণ আছে। একইভাবে ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত ‘অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়াজ নান’ ক্রিস্টির জনপ্রিয়তম উপন্যাসই শুধু নয়, এমনকি তাঁর নিরিখেও সেটি সবচেয়ে ‘কষ্টকল্পিত’ রহস্য বলে বিচার্য। কিন্তু যেটির কথা লিখলাম সেটি মানবসম্পর্কের আলো-ছায়া ফুটিয়ে তুলে, আমার মতে, আরও বিশুদ্ধ রহস্য হয়ে উঠতে পেরেছে।


(৭) দ্য কেস অফ দ্য কনস্ট্যান্ট সুইসাইডস (১৯৪১): জন ডিকসন কার্‌-এর লেখা প্রায় সব গল্প-উপন্যাসই লকড্‌ রুম মিস্ট্রির পাঠকদের কাছে টেক্সট-তুল্য। এই বইটিও ব্যতিক্রম নয়। স্কটিশ হাইল্যান্ডে একটি কাসলে জমায়েত হয় বেশ কয়েকটি মানুষ। সেই কাসলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা অপমৃত্যুর কিংবদন্তির সঙ্গেই জুড়ে যেতে থাকে একের পর এক মৃত্যু, যাদের দেখে আত্মহত্যা মনে হলেও ব্যাপারটা, লালমোহনবাবু-র ভাষায়, হাইলি সাসপিশাস। ডক্টর গিডিয়ন ফেল এবারেও ফেল করেননি। কত রকমভাবে বন্ধ ঘরের মধ্যে একজনকে খুন করা যেতে পারে সেই নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি খুনিকেও চিহ্নিত করেন তিনি।


(৮) রিম অফ দ্য পিট (১৯৪৪): হেক টেলবট-এর লেখা এই উপন্যাসটি শুধু লকড্‌ রুম মিস্ট্রি নয়। খুনের পাশাপাশি বরফে আপাতভাবে অদৃশ্য কারও পায়ের দাগ, লোকালয় থেকে বহু দূরে বরফবন্দি একটি বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে জমে ওঠা ভয়, টেনশন, সন্দেহ, রোমান্স, এবং ম্যাজিক মিশিয়ে একটি দারুণ উপভোগ্য রহস্য পরিবেশন করে। নামজাদা সম্পাদক থেকে পাঠক, প্রায় সবাই এই উপন্যাসটিকে ভূরি-ভূরি নম্বর দিয়েছেন। এখনও ভোটাভুটি হলে সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম লকড্‌ রুম মিস্ট্রির তালিকায় এটি প্রথম পাঁচে থাকে।


(৯) দ্য ফোর্থ ডোর (১৯৮৭): জন ডিকসন কার্‌-এর সার্থক উত্তরসূরী হিসেবে গণ্য ফরাসি লেখক পল হল্টার-এর প্রথম উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয় ২০১০-এ, কিন্তু ততদিনে এটি স্বনামে এবং ‘দ্য হুডিনি মার্ডারস’ নামেও ক্লাসিক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। সত্যি বলছি, এমন মাথা-গুলিয়ে-দেওয়া লেখা আমি আমার জীবনে আজ অবধি একটিও পড়িনি। বইটা শেষ করার পর একদম ‘বুঝভোম্বল’ স্টাইলে ভেবেছিলাম, “কেসটা কী হল?” প্রসঙ্গত, এই উপন্যাস আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছে, কেন এই ধরনের রহস্য সমাধান করতে গেলে ম্যাজিক তথা ইল্যুশন সম্বন্ধে জ্ঞান এত গুরুত্বপূর্ণ।


(১০) দ্য ডক্টর্স কেস (১৯৮৭): এই গল্পটি তিনটি কারণে ঐতিহাসিক। প্রথমত, এটি স্টিফেন কিং-এর লেখা একমাত্র হোমসিয়ান প্যাস্টিশ, যা হোমসের আত্মপ্রকাশের শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত ‘দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার্স অফ শার্লক হোমস’-এ স্থান পেয়েছিল। দ্বিতীয়ত, এটি কিং-এর লেখা এযাবৎ একমাত্র লকড্‌ রুম মিস্ট্রি। তৃতীয়ত... গল্পের নামটা থেকে কি কিছু বুঝতে পারছেন? বাকিটা বুঝতে গেলে আপনাকে গল্পটা পড়তে হবে। কিং-এর গল্প-সংকলন ‘নাইটমেয়ার্স অ্যান্ড ড্রিমস্কেপস্‌’-এ গল্পটা পাবেন। জন জোসেফ অ্যাডামস্‌ সম্পাদিত প্যাস্টিশ সংকলন ‘দ্য ইমপ্রোবেবল অ্যাডভেঞ্চার্স অফ শার্লক হোমস’-এও এটি পাওয়া যাবে।


না। আর লিহুম না। ল্যাহনের কিসু নাই। খালি পড়নের আসে। যদি এই ধারায় পড়াশোনা করে মগজাস্ত্রে ধার দিতে চান, তাহলে ঝটপট বইগুলো জোগাড় করে পড়ে ফেলুন। আর এতগুলো বই কেনার মতো অবস্থায় যদি না থাকেন, অথচ আলোচনাটা কৌতূহলোদ্দীপক বলে মনে হয়, তাহলে মার্টিন এডওয়ার্ডস্‌ সম্পাদিত ‘মিরাকুলাস মিস্ট্রিজ’ নামক গল্প-সংকলনটি জোগাড় করুন এবং পড়ে ফেলুন। 

আটলান্টিকের ওপারের লেখাজোখা এতে নেই, কারণ বইটি প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ লাইব্রেরি ক্রাইম ক্লাসিক্স সিরিজে। সেইসব গল্প পড়তে চাইলে অটো পেঞ্জলার সম্পাদিত একটি অতিবৃহৎ সংকলন আছে বটে, তবে তাতে জালি গল্প প্রচুর।
তবে হ্যাঁ, এই নিয়ে পড়াশোনা শুরুর আগে একটি বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ লিখে দিই। এই গল্পগুলো আদ্যন্ত কৃত্রিম, এবং যতটা না রহস্যভেদ, তার চেয়ে বেশি ইন্টেলেকচুয়াল এক্সারসাইজ। মগজাস্ত্রে শান দেওয়াই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে পোলিস প্রোসিডিওরাল পড়া ভালো, কারণ সেগুলো বাস্তবকে অনেক বেশি প্রতিফলিত করে। আর যদি বাস্তব থেকে পালিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ ইত্যাদি চান, তাহলে লুক নো ফারদার। রহস্যপ্রেমীদের কাছে এসকেপিস্ট এন্টারটেনমেন্টের পরাকাষ্ঠা এই লেখাক’টি পড়ে দেখলে ভালো লাগতেই পারে।
পাঠ শুভ হোক।

Thursday 25 October 2018

বন্ড। জেমস বন্ড।

আমার ‘বন্ড’-এজ শুরু হয়েছিল যুগান্তরের পাতায় য়ারোস্লাভ হোরাকের আঁকা দুর্দান্ত কমিক স্ট্রিপগুলো পড়ে। ওগুলোতে রাজনীতির কূটকচাল খুব কম থাকত, বেশি থাকত অসাধারণ সাদা-কালো দাগে ফুটিয়ে তোলা গতি, এস্পিওনাজ জগতের আলো-অন্ধকার, আর স্বল্পবসনা নারীদের লাস্যময়ী বিভঙ্গ। পরে বুঝি, ওই সাদা, কালো, বাদামি শরীরগুলো এই গোত্রের সিনেমা-তে প্রপস বা আই ক্যান্ডি ছাড়া বিশেষ ভূমিকা নেয় না। এরপরেই আমার, এই সিনেমাগুলোর জন্য আশৈশব লালিত ফিক্সেশন তথা নিষিদ্ধ আকর্ষণ কেটে যেতে থাকে। বরং, বন্ড মানেই যে “এন্টারটেইনমেন্ট, এন্টারটেইনমেন্ট, অ্যান্ড ওনলি এন্টারটেইনমেন্ট” (সৌজন্যে: বিদ্যা বালান), এটা মগজস্থ হয়। স্বাভাবিকভাবেই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ড হন রজার মুর। মুর-অভিনীত অবাস্তব, ওভার-দ্য-টপ সিনেমাগুলোর বিনোদনমূল্য বাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর মুখের উইটি সংলাপ, এবং মেট্রোসেক্সুয়াল চার্ম। দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ড মুভি-ই ছিল ‘লিভ অ্যান্ড লেট ডাই’, যা বন্ডের সিনেমা বলতে আমরা ততদিন যা-যা বুঝতাম, তার একেবারে সেরা-সেরা জিনিসে ঠাসা ছিল। প্লাস, মুরের ডায়লগগুলো আমি জাস্ট ভুলতে পারিনি!


ছিল। এখন আর নয়। এখন আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ড মুভি ‘স্কাইফল’।
কেন? সেই নিয়েই তো এই পোস্ট!

কাল সন্ধেবেলা শ্রীমতী বাড়ি ছিলেন না। অপ্রত্যাশিতভাবে রিমোটের মালিকানা পেয়ে আমি, এবং ‘পড়্‌!পড়্‌!’ থেকে স্বাধীনতা পেয়ে আমার মেয়ে কিঞ্চিৎ দিশেহারা হয়ে পড়ি। কন্যারত্ন কোনো একটা রমকম দেখার চেষ্টায় ছিলেন, কিন্তু স্টার এইচডি-তে সিনেমাটা চলছে দেখে আমি অনুনয়-বিনয় করে ওকে সেখানে নিয়ে এলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সেও আঠা হয়ে গেল। বিজ্ঞাপনের জন্য সিনেমা দেখায় সমস্যা হচ্ছে বলে দু’জনেরই মাথা গরম হল। টিভি ছেড়ে ডিভিডি-টা চালানো হল। তারপর...!
সিনেমাটা নিয়ে আমি বিশেষ কিছু লিখব না। যাঁরা সিনেমাটা দেখেননি, তাঁরা মহাপাতক করেছেন। আপনি নারীবাদী, মার্ক্সবাদী, বাদি, বিবাদী যা খুশি হোন, কিন্তু এই সিনেমাটাকে বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদী অবক্ষয় ভেবে, বা সিংগল স্ক্রিন সিনেমাহলের আশারদের পেটে অন্ন জোগানোয় মদত দেওয়া হবে না ভেবে যদি ত্যাগ করে থাকেন, তাহলে মারাত্মক ভুল করেছেন। এই সিনেমাটা আসলে কী নিয়ে জানেন? ওপরে বিদ্যা বালানের কোটেশনটি দেখুন।
তবে আমার কাছে সিনেমাটা ফেভারিট একাধিক কারণে।
প্রথমত, অ্যাডেল আমাদের দু’জনেরই প্রিয় শিল্পী। তাঁর লেখা ও গাওয়া টাইটেল ট্র্যাক-টা আমাদের দু’জনেরই অন্যতম প্রিয় গান। কিন্তু এক সুপারহিরো (হ্যাঁ, বন্ড তাই-ই) যখন হারিয়ে যায় রক্তলাল ঘূর্নির মধ্যে, তখনকার অবস্থার সঙ্গে ‘দিস ইজ দ্য এন্ড’ গানটা যে কতটা মিলে যায়, তা আমরা কেউই এভাবে বুঝিনি। ইনফিনিটি ওয়ারে স্পাইডারম্যানকে মুছে যেতে দেখে, বা অ্যাভেঞ্জার্স ফোর-এর পর ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা-কে আর দেখতে পাব না জেনে যে অনুভূতিটা হয়েছিল, তার প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম ছ’বছর আগে রিলিজ হওয়া গানটায়।
দ্বিতীয়ত, বন্ড যখন সিলভা-র পেছনে ছুটে স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাওয়া টিউবের পেছনটা আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করে, আর সেটা দেখে এক যাত্রী বলেন ‘হি ইজ রিয়্যালি কিন টু গো হোম আর্লি।’ বা সেই অবস্থায় গার্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ট্রেনে ঢুকে যখন বন্ড নিজের পরিচয় দেয় ‘হেলথ অ্যান্ড সেফটি। ক্যারি অন।’ বলে, তখন শুধু আমি নয়, আমার মেয়েও হেসে উঠেছিল। এই কুইন্টেসেনশিয়ালি ব্রিটিশ হিউমার আর কোথায় পাব?
তৃতীয়ত, একের পর এক ঘটনা দেখে আমার মেয়ে বলল, “বাবা, ও (মানে ভিলেইন) বন্ডকে আসলে মারতে চায় না, তাই না? ও চায়, বন্ড বেঁচে থাকুক।” আমার মনে পড়ে গেল ‘কিংসম্যান’-এ স্যামুয়েল এল জ্যাকসন আর কলিন ফর্থ-এর সংলাপ, যেখানে দু’জনেই বলে যে তারা সেইসব সিনেমার ভক্ত যেখানে ভিলেইন হিরোকে অসম্ভব, অবাস্তব নানা উপায়ে মারার প্ল্যান করে, আর সেই ফাঁকে হিরো বেরিয়ে যায়। প্রসঙ্গত, ‘কিংস্যম্যান’ ফ্রাঞ্চাইজ বন্ড-এর প্রতি হোমাজ, তবে স্পুফ নয়। স্পুফ বা প্যারডি চাইলে আপনাকে দেখতে হবে লেসলি নিলসেন অভিনীত ‘স্পাই হার্ড’ বা রোয়ান অ্যাটকিনসন অভিনীত ‘জনি ইংলিশ’।
চতুর্থত, সিনেমার ক্লাইম্যাক্সে সিলভা যখন বিকৃত মুখে এম-কে ছেড়ে সোজা হয়, এবং আমরা দেখি তার পিঠ থেকে বেরিয়ে আছে একটা ছুরির বাঁট, আর অনেকটা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বন্ড, তখন আমার মেয়ে বলল, “দ্য ওল্ড ওয়ে!” বন্ডকে ছুরিটা দেওয়ার সময় কিংকেড, মানে ওই এস্টেটের গেমকিপার ঠিক এভাবেই জিনিসটার পরিচয় দিয়েছিল। তারপর মৃতপ্রায় সিলভার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বন্ড বলে, “লাস্ট র‍্যাট স্ট্যান্ডিং।” এবং আমার মেয়ে জোড়ে, “ও অন্যটাকে খেয়ে ফেলেছে।” আমি বুঝি, দীক্ষা কমপ্লিট।
এখন থেকে ‘স্কাইফল’ আমার ফেভারিট। আর আপনার?

Monday 3 September 2018

আমার শার্লকিয়ানা ~ সেরা পাঁচ প্যাস্টিশ


লন্ডন, ১৮৯৫। ২২১বি বেকার স্ট্রিটের জানলার বাইরে পাক খাচ্ছে হলদেটে কুয়াশা। ফায়ারপ্লেসের কাছে চেয়ারটা টেনে নিয়ে ল্যান্সেটের পাতায় লন্ডনকে নড়িয়ে দেওয়া সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের নির্মোহ বিবরণ পড়ায় মগ্ন ডক্টর ওয়াটসন। ঘরের অন্য বাসিন্দা তখন লম্বা টেবিলে রাখা অসংখ্য শিশি-বোতলের মাঝে ঝুঁকে বকযন্ত্র থেকে ঝরে পড়া তরলটার রঙ-বদলানো খুঁটিয়ে দেখছেন। হঠাৎ রাস্তা থেকে ভেসে এল হইচই আর চিৎকারের শব্দ। পাথরে বাঁধানো পথে ক্লপ-ক্লপ আওয়াজ তুলে এসে দাঁড়াল একটা হ্যানসম। দুমদাম করে দরজা পেটানোর শব্দ এসে পৌঁছল ওপরে, দোতলার এই ঘরেও। ওয়াটসন উৎকর্ণ হয়ে বুঝলেন, মিসেস হাডসন দরজাটা খোলা মাত্র তাঁকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ছুটে আসছে কেউ! ভারী জুতো আর জোরালো নিঃশ্বাসের আওয়াজটা দরজার কাছে এসে একটু থামল।
ঘরের দুই বাসিন্দাই দরজার দিকে তাকালেন। “তোমাকে আমার বোর হওয়া নিয়ে আর ভাবতে হবে না ওয়াটসন।” ব্যঙ্গাত্মক গলাটা ভেসে এল কেমিক্যাল-বোঝাই টেবিলটার দিক থেকে, “কোকেনের চেয়ে ভালো জিনিস এসে গেছে আমার কাছে।” দড়াম করে খুলে গেল দরজাটা। হাঁফ ধরা গলায় বলে উঠলেন নীল পোশাক পরা পুলিশ অফিসারটি, “আর একটা খুন হয়েছে। আপনাকে এখনই একবার আসতে হবে মিস্টার হোমস!”
বাকিটা পড়তে চান?
সখেদে জানাই, দ্য গ্রেট ডিটেকটিভের কোনো ধুঁয়াধার অ্যাডভেঞ্চার আমি লিখতে বসিনি। তবে শার্লক হোমসকে নিয়ে ফিকশন লেখালেখির একটি বিশেষ দিক নিয়েই লেখার জন্য আজকের ব্লগিং।

শার্লক হোমসকে নিয়ে ভক্তদের উন্মাদনা দেখে কিছুটা অসহায় ও অনেকটা ঈর্ষান্বিত হয়ে আর্থার কোনান ডয়েল তাঁকে রাইখেনবাখে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে জনতার হোমস-উন্মাদনা কমেনি। সুধী পাঠক জানেন, লোকজন হাতে কালো রঙের আর্মব্যান্ড পরে হোমসের জন্য শোকজ্ঞাপন তো করেইছিলেন, সঙ্গে ডয়েলকে খুনি তকমাও দিয়েছিলেন! এরপর কী কারণে ও কীভাবে ডয়েল হোমসকে পুনরুজ্জীবিত করেন, সে ইতিহাস অন্য কখনও আলোচনা করা যাবে। আপাতত আসি হোমস-কে নিয়ে লেখালেখির বর্গীকরণে।
কোনান ডয়েল শার্লক হোমসকে নিয়ে মোট ৫৬টি গল্প, এবং চারটি উপন্যাস লিখেছিলেন। প্রথমটি, ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট নামক উপন্যাস, প্রকাশিত হয় ১৮৮৭-র বিটনস ক্রিসমাস অ্যানুয়াল-এ। শেষ গল্প দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ শসকম্ব ওল্ড প্লেস প্রকাশিত হয় স্ট্র্যান্ড পত্রিকার এপ্রিল ১৯২৭ সংখ্যায় ও সংকলিত হয় হোমসকে নিয়ে লেখা ডয়েলের শেষ সংকলন দ্য কেস বুক অফ শার্লক হোমস-এ। হোমসিয়ান বা শার্লকিয়ানরা এই ৬০টি লেখাকে ক্যানন বলে অভিহিত করেন।
কিন্তু, আর্থার কোনান ডয়েলের আরও বেশ কিছু লেখায় এমন চরিত্র এসেছে যাদের নাম হোমস না হলেও চলন-বলন অনেকটাই শার্লক হোমসকে মনে করিয়ে দেয়। বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, এই গল্পগুলো ছিল হোমসকে নিয়ে ডয়েলের মজাকিয়া মনোভাবের প্রকাশ। আগাথা ক্রিস্টিও এমনটা করেছেন কিন্তু মাউজট্র্যাপ-এ, যেখানে একটি নেগেটিভ চরিত্র এরকুল পোয়ারো-র আদলে গড়া!
এক্সট্রাক্যাননিকাল ওয়ার্কস নামে পরিচিত ডয়েলের এই লেখাগুলো হল:
(ক) ১৮৯৬-তে প্রকাশিত দ্য ফিল্ড বাজার’, যাকে হোমসকে নিয়ে লেখা প্রথম প্যারডি বলা চলে;
(খ) ১৮৯৮-এ প্রকাশিত দ্য লস্ট স্পেশাল’;
(গ) ১৮৯৮-তেই প্রকাশিত দ্য ম্যান উইথ দ্য ওয়াচেস’;
(ঘ) রানি মেরি-র পুতুলবাড়ি (ডলস হাউস)-র লাইব্রেরিতে রাখার জন্য সেই সময়ের সেরা ব্রিটিশ সাহিত্যিকেরা অনেকেই এক-একটি ক্ষুদ্র বইয়ে পূর্ণাঙ্গ কাহিনি লিখে দিয়েছিলেন (চিরঞ্জীৎ সেখান থেকে পয়েন্ট ব্রাভো-র আইডিয়া পায়নি তো? ভাববার বিষয়!)। ডয়েলও সেই উপলক্ষে একটি বই লেখেন। বইটি দ্য ফিল্ড বাজার-এর মতোই একটি প্যারডি, নাম হাউ ওয়াটসন লার্নড দ্য ট্রিক
(ঙ) ১৮৮৯-তে লেখা নাটক এঞ্জেলস অফ ডার্কনেস’, যা আদতে আ স্টাডি ইন স্কারলেট-এর মার্কিন অধ্যায়গুলোর ভিন্নতর, হোমসবর্জিত কিন্তু ওয়াটসন-সমৃদ্ধ, আরও বেশি রঙ-চড়ানো রূপ, এবং যেটি ২০০০ অবধি চেপে রাখা হয়েছিল!
(চ) ১৯০২-এ লেখা নাটক দ্য স্টোনার কেস’, যা আদতে ফেব্রুয়ারি ১৮৯২-এ প্রকাশিত গল্প দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য স্পেকলড ব্যান্ড-এর কিছুটা ভিন্নতর রূপ।
(ছ) ১৯২১-এ লেখা নাটক দ্য ক্রাউন ডায়মন্ড’, যা দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য মাজারিন স্টোন-এর চেহারা নিয়ে স্ট্র্যান্ড পত্রিকা, অক্টোবর ১৯২১-এ আত্মপ্রকাশ করে।
(জ) ১৯২৩ সালে ডয়েল দ্য রিটার্ন অফ শার্লক হোমস নামে আরেকটি নাটক লেখেন, যাতে তিনি দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য এম্পটি হাউস’, ‘দ্য ডিস্যাপিয়ারেন্স অফ লেডি ফ্রান্সিস কারফ্যাক্স’, ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ চার্লস অগাস্টাস মিলভার্টন’, এবং দ্য রেড-হেডেড লিগ থেকে মালমশলা নিয়েছিলেন।

ডয়েল যে হোমস-কে নিয়ে খুব একটা সিরিয়াস ছিলেন না, এটা সবচেয়ে আগে বুঝেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকার ও অভিনেতা উইলিয়াম জিলেট। ডয়েলের অনুমতি এবং সাহায্য নিয়ে ১৮৯৯ সালে শার্লক হোমস: আ ড্রামা ইন ফোর অ্যাক্টস নামক নাটকটি লিখতে ও মঞ্চস্থ করতে গিয়ে (এই প্রসঙ্গে আবার ক্রিস্টির লেখা নাটক মাউসট্র্যাপ-এর কথা বলতে হচ্ছে। শুধু ওটিই যে বহু-বহু বছর চলেছিল তাই নয়, জিলেটের লেখা নাটকটিও ইতিহাস তৈরি করেছিল জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে।) জিলেট জানতে চান, নাটকে হোমসের বিয়ে দেওয়ানো যাবে কি না। ডয়েলের উত্তর ছিল, হোমসকে নিয়ে যা-খুশি-তাই করাতে পারেন জিলেট, এমনকি হোমসকে খুন করালেও ডয়েল নাকি অখুশি হতেন না! ফলে আ স্টাডি ইন স্কারলেট’, ‘দ্য সাইন অফ ফোর’, ‘আ স্ক্যান্ডাল ইন বোহেমিয়া’, ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য এম্পটি হাউস’, ‘দ্য বসকম্ব ভ্যালি মিস্ট্রি’, ‘দ্য গ্রিক ইন্টারপ্রেটর’, ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য নাভাল ট্রিটি’, এসব কাহিনি থেকে প্লটের অংশবিশেষ নেওয়ার পাশাপাশি জিলেট সম্পূর্ণ নিজের মতো করে অনেক কিছু জুড়েছিলেন। আর হ্যাঁ, ক্যাননের ৬০টি লেখায় না থাকলেও ওই নাটকের সৌজন্যে তিনটি জিনিস আমাদের মাথায় পাকাপাকি গেঁথে গেছে:
১] হোমসের ক্যালাবাশ পাইপ। ক্যাননে হোমস সবচেয়ে বেশি করে যে পাইপের সাহায্যে ধূমপান করেছেন সেটি হল ক্লে পাইপ (৬টি গল্পে), তারপরেই এসেছে ব্রায়ার পাইপ (৪টি গল্পে), চেরি-উড পাইপ (১টি গল্পে) । কিন্তু এই নাটকে যাতে সবচেয়ে দূরে বসা দর্শকও হোমসের মুখে পাইপটি দেখতে পান, সেজন্য জিলেট নিজের মুখে বসিয়ে নেন এই বিশেষ বাঁকা পাইপটি।
২] ঘরের মধ্যেও ডিয়ারস্টকার হ্যাট পরে থাকা।
৩] “এলিমেন্টারি, মাই ডিয়ার ওয়াটসন”! আজ্ঞে হ্যাঁ, গোটা ক্যাননে কোথাও এই লাইনটি লেখেননি স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, কিন্তু এখন আমরা হোমস বলতেই এটা ভাবি, তাই না?
১৯০৫-এ জিলেট তাঁর অন্য একটি নাটকের আগে কার্টেন-রেইজার হিসেবে পরিবেশনযোগ্য একটি কমেডি লেখেন। দ্য পেইনফুল প্রেডিকামেন্ট নামক সেই ক্ষুদ্র নাটিকাটি দর্শকের প্রশংসা পায়। এই সাফল্য দেখে উৎসাহিত, অথচ ব্রিটিশ আইনকানুন সম্পর্কে ভীত এক উদ্যোগী লেখক অনামা থেকেই ১৯১৩-তে গ্রিক হেলাস পত্রিকায় শার্লক হোমস সেভিং মিস্টার ভেনিজেলোস নামক একটি গ্রিক ভাষায় লেখা উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন।
আর এইভাবেই শুরু হয় ডয়েল ছাড়া অন্যান্য লেখকদের হোমসকে নিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখা, যাকে আমরা প্যাস্টিশ (pastiche) নামক একটি আলাদা গোত্রে ফেলি। ১৯১৪ সালেই অ্যালফ্রেড হুইটেকার নামের এক ভদ্রলোক “দ্য কেস অফ দ্য ম্যান হু ওয়াজ ওয়ান্টেড” নামে একটি প্যাস্টিশ লিখে ডয়েলকে পাঠান। সেটা ডয়েলের এতই ভালো লাগে যে তিনি সেটি কিনে নেন ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য! ডয়েলের মৃত্যুর পর যখন প্রকাশকদের মধ্যে অপ্রকাশিত হোমস-এর জন্য উন্মাদনা বেড়ে চলেছে, তখন তাঁর কাগজপত্রে এই লেখাটি পাওয়া যায়, এবং তুলকালাম হয়। অনেক পরে শার্লকিয়ান হেসকেথ পিয়ারসন মূল লেখককে চিহ্নিত করায় এটি প্যাস্টিশ হিসেবেই শেষ অবধি স্বীকৃতি পায়।
আমার আজকের পোস্ট, আমার মতে, সেরা পাঁচ হোমস প্যাস্টিশ নিয়ে।

১৯৪৪ সালে এলেরি কুইন-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় হোমসকে নিয়ে লেখা তিরিশটিরও বেশি প্যারডি কাহিনির সংকলনদ্য মিসঅ্যাডভেঞ্চার্স অফ শার্লক হোমস। পাঠক বইটি তখন, ও এখন যথেষ্ট উপভোগ করলেও কোনান ডয়েলের উত্তরাধিকারীরা ব্যাপারটা মোটেই ভালোভাবে নেননি। তাঁদের তরফে আরোপিত কপিরাইট-জড়িত আইনি বিধিনিষেধের ফলে হোমসকে নিয়ে প্যাস্টিশ লেখাটা বে-আইনি হয়ে যায়। এর পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৪৫-এ কোনান ডয়েলের অথরাইজড বায়োগ্রাফি লেখার জন্য ডয়েল এস্টেট লকড রুম মিস্ট্রি-র জগতে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক জন ডিকসন কার-এর সঙ্গে চুক্তি করে। এই কাজটি করতে গিয়ে কোনান ডয়েলের ছেলে অ্যাড্রিয়ান কোনান ডয়েল ঠিক করেন, ‘নতুন হোমস কাহিনি-র জন্য পাঠকদের মধ্যে থাকা এমন চাহিদার ফায়দা ডয়েল এস্টেটেরই তোলা উচিত। ফলে তাঁর ও জন ডিকসন কার-এর, কিঞ্চিৎ অস্বস্তিকর কোলাবরেশনের ফসল হয়ে এরপর লাইফ পত্রিকায় একটি,কোলিয়ারস ম্যাগাজিন-এ এগারোটি প্যাস্টিশ প্রকাশিত হয়। এই প্যাস্টিশগুলোর মাধ্যমেই শুরু হয় ক্যাননে উল্লিখিত হোমসের নানা অগ্রন্থিতঘটনা নিয়ে গল্প লেখার ধারাটি। ১৯৫৪-তে এই এক ডজন প্যাস্টিশ সংকলিত হয় “দ্য এক্সপ্লয়েটস অফ শার্লক হোমস” নামে। বইটি তখন পাঠক বা সমালোকচকদের অনুগ্রহ পায়নি। তবে এখনকার সহনশীল পাঠকেরা এই বইটিকে শুধু ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, বরং পাঠযোগ্যতার দিক দিয়েও সরেস বলে মনে করেন। তাই আমার প্রথম বই এটিই।
এতে থাকা গল্পগুলো হল:
(১) দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য সেভেন ক্লক্স;
(২) দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য গোল্ড হান্টার;
(৩) দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ওয়্যাক্স গ্যাম্বলার্স;
(৪) দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য হাইগেট মির‍্যাকল;
(৫) দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ব্ল্যাক ব্যারনেট;
(৬) দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য সিলড রুম;
(৭) দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ফোকস রথ;
(৮) দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য আব্বাস রুবি;
(৯) দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ডার্ক এঞ্জেলস’;
(১০) দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য টু উইমেন;
(১১) দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ডেপ্টফোর্ড হরর;
(১২) দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য রেড উইডো।
অদ্রীশ বর্ধন এই গল্পগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু এখন আর তাদের...!

শার্লক হোমসকে নিয়ে নতুন গল্প লেখাটা সমস্যা তৈরি করলেও ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৬-এর মধ্যে বেসিল রথবোন-কে হোমস, এবং নাইজেল ব্রুস-কে ডক্টর ওয়াটসন বানিয়ে যে ১৪টি সিনেমা তৈরি হয়, তাদের সঙ্গে ডয়েলের মূল লেখার সম্পর্ক ছিল খুবই সামান্য, বা ছিলই না। ১৯৬৫ সালে এই ধারাতেই হলিউড আনে জেমস হিল পরিচালিত, জন নেভিল ও ডোনাল্ড হিউস্টন অভিনীত সিনেমা আ স্টাডি ইন টেরর। হোমসের দ্বারা জ্যাক দ্য রিপার চিহ্নিত হওয়া নিয়ে প্রথম সিনেমা এটিই। যাঁরা সিনেমাটি দেখেননি তাঁদের সনির্বন্ধ অনুরোধ করব সেটি দেখে নিতে। তবে আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে এই সিনেমাটি। ১৯৬৬-তে প্রকাশিত এর সমনামী নভেলাইজেশন-এ ফ্রেমিং ডিভাইস হিসেবে আসে এই সময়ে এলেরি কুইনের একটি অ্যাডভেঞ্চার, আর তার সমান্তরালে চলতে থাকে পল.ডব্লিউ. ফেয়ারম্যান-এর লেখায় ১৮৮৯-এর লন্ডনে জ্যাক দ্য রিপারের পিছু নেওয়া শার্লক হোমসের একটি অ্যাডভেঞ্চার! আমার দ্বিতীয় বাছাই এই টু-ইন-ওয়ান প্যাস্টিশটি, যাতে হোমস ও এলেরি কুইন, দুজনেরই বুদ্ধির ঝলক দেখার সুযোগ মেলে।

শার্লক হোমসকে নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে বাঁধ ভেঙে দাও এফেক্টের জন্য যদি কাউকে ধরতে হয়, তাহলে তিনি হলেন ফিল্মমেকার ও নভেলিস্ট নিকোলাস মেয়ার। ১৯৭৪ সালে মেয়ার লেখেন একটি উপন্যাস, যার নাম~ “দ্য সেভেন পার্সেন্ট সলিউশন: বিইং আ রিপ্রিন্ট ফ্রম দ্য রেমিনিসেন্সেস অফ জন এইচ ওয়াটসন, এম.ডি”।
সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সাহায্য নিয়ে হোমসের কোকেনের নেশা কাটানো, হোমসের ছোটোবেলার এক অন্ধকার অধ্যায় ও তার মরিয়ার্টি-ফিক্সেশনের আসল কারণ উন্মোচন, চলন্ত ট্রেনের ছাদে অ্যাকশনের মাধ্যমে হোমসের ইউরোপীয় যুদ্ধ ঘটাতে চলা ভিলেইনদের পরাস্ত করা... এইসব মণিমুক্তোয় ঠাসা এই বইটির জন্য প্রতিক্রিয়া আজকের ফেসবুকীয় পাঠকের পরিভাষায় একটিই মাত্র শব্দে ব্যক্ত করা চলে: চুমু! স্বাভাবিকভাবেই আমার তৃতীয় পছন্দের বই এটিই। এটি নিয়ে ১৯৭৬ সালে হলিউড একটি সিনেমাও বানায়, তবে সেটার কপালে চন্দনের বদলে আধলাই জুটেছে বেশি। এই উপন্যাসের পর মেয়ার আরও দুটি উপন্যাস লেখেন, যেগুলো আমার কাছে মাঝারি স্তরের মনে হয়েছে। কিন্তু তাঁকে দেখে এরপর এমন কিছু প্যাস্টিশ লেখা হয় যার মধ্যে অসম্ভব খারাপ, ও অসম্ভব ভালো, এই দুই-ই আছে।

১৯৭৯ সালে মাইকেল ডিবডিন লেখেন তাঁর বিস্ফোরক, চরম বিতর্কিত প্যাস্টিশ দ্য লাস্ট শার্লক হোমস স্টোরি। এই বইটির ছত্রে-ছত্রে ছড়িয়ে আছে জ্যাক দ্য রিপার, মরিয়ার্টি, এবং অবশ্যই শার্লক হোমস। অত্যন্ত সুলিখিত, এবং দারুণভাবে ডয়েলের লেখার ধরন অনুসরণ করেও স্তম্ভিত করে দেওয়া এক অনিঃশেষ অন্ধকারের গল্প এটি। 
পোস্ট-মডার্ন ডি-কনস্ট্রাকশন বা অবিনির্মাণ তত্ত্বের উদাহরণ হিসেবে এই বইটি নিয়ে একদা দেশ-এ আলোচনা করেছিলেন গৌতম ভদ্র, এবং আমিও তাঁর সঙ্গে একমত। অবিস্মরণীয়, রিপার ও হোমসের কথা একসঙ্গে ভাবলেই ভাবতে বাধ্য হওয়া এই উপন্যাসটিকে নিজের পছন্দের প্যাস্টিশের তালিকায় চার নম্বর হিসেবে রাখলেও এটি আমি অবশ্যপাঠ্য হিসেবে রেকমেন্ড করব না।
হোমস-বনাম-রিপার নিয়ে এরপর লেখা, এবং পাঠক ও সমালোচকের দ্বারা বিপুলভাবে প্রশংসিত বই হল ২০০৯-এ প্রকাশিত লিন্ডসে ফে-র লেখা “ডাস্ট অ্যান্ড শ্যাডো: অ্যান অ্যাকাউন্ট অফ দ্য রিপার কিলিংস বাই ডক্টর জন এইচ ওয়াটসন”। বরং এই বইটিকে, হে পাঠক, যদি জোগাড় করতে পারেন, তাহলে অবশ্যই পড়বেন। আর হ্যাঁ, সঙ্গে দেখে নেবেন ১৯৭৯-তে বানানো ক্রিস্টোফার পামার ও জেমস ম্যাসন অভিনীত ব্রিটিশ-ক্যানাডিয়ান ফিল্ম মার্ডার বাই ডিক্রি। এই সিনেমাটি স্টিফেন নাইটের রিপার সংক্রান্ত তত্ত্ব মেনে বানানো হয়েছিল।

২০১১ সালে কোনান ডয়েল এস্টেট তাদের ইতিহাসে প্রথমবার ডয়েলছাড়া অন্য কারও লেখা প্যাস্টিশকে অনুমোদন দেয়। ইয়ং অ্যাডল্ট হরর ও মিস্ট্রি লেখার জন্য বিখ্যাত অ্যান্থনি হরোউইৎজ লেখেন “দ্য হাউজ অফ সিল্ক”। একেবারে খাঁটি কোনান ডয়েলের মতো করে শুরু হয় এই গল্পটি। চরিত্রদের সঙ্গে পরিচয় হয় আমাদের। হোমসের কাছে একটি সমস্যা নিয়ে আগমন হয় একজনের...
আর এরপরেই গল্পটা সাংঘাতিক দিকে বাঁক নেয়!
একটি বিশেষ বাড়ির ওপর নজর দেওয়ার জন্য মোতায়েন হওয়া হোমসের নিজস্ব খবরি বাহিনী তথা বেকার স্ট্রিট ইররেগুলার্স-এর এক সদস্য নৃশংসভাবে খুন হয়। খুনের দায়ে ফেঁসে হোমসের ঠাঁই হয় জেলে! এবং এই সবকিছুর পেছনে ফিসফিস করে উঠে আসে যে নামটা তা হল দ্য হাউজ অফ সিল্ক!
তারপর কী হল?
এই গল্প ডয়েল লিখতেন না। লিখতে পারতেন না বলব না, কারণ মানুষটি জীবনের অন্ধকার দিকের সঙ্গেও যে সবিশেষ পরিচিত ছিলেন, তা আমরা জানি। কিন্তু এই কাহিনির ক্রূরতা, এবং এর কেন্দ্রে থাকা অপরাধের প্রকৃতি তিনি কাগজে ফুটিয়ে তুলতেন না কিছুতেই!
এর সেজন্যই আমি এই বইটিকে অবশ্যপাঠ্য বলব। দ্য গ্রেট ডিটেকটিভযে শুধুই ভূতুড়ে কুকুর, দড়ি বেয়ে নামা সাপ, বা বনেদি চোর-ডাকাত নয়, বরং আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভয়ংকরতম অন্ধকারের মোকাবিলাও করতে পারেন, তা জানার জন্যই এই বইটা পড়বেন। প্লিজ।

কিন্তু, লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, যে লেখাটির কথা এতক্ষণ আমি উল্লেখ করিনি সেটির প্রসঙ্গে পান পরাগ-এর সেই কিংবদন্তি বিজ্ঞাপনে শম্মি কাপুরের মতো বলতে হয়, “হাম তো আসলি বাত কহনা ভুলহি গয়েঁ!”
সেটা কী?
আমার মতে, হোমসকে নিয়ে লেখা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্যাস্টিশ কোনো নভেল নয়, বরং একটি গল্প। সেও এমন এক গল্প, যার কোথাও হোমসের নাম নেই। কিন্তু যে গল্পটা পড়ার পর হোমস, মরিয়ার্টি, ইতিহাস, লাভক্র্যাফটের থুলু মিথোস, এগুলোকে আপনি নতুন চোখে দেখতে ও পড়তে বাধ্য হবেন। সেই লেখাটির নাম: “আ স্টাডি ইন ইমার‍্যাল্ড”, লেখক নিল গেইম্যান (যাঁকে আমেরিকান গডস, কোরালিন, দ্য গ্রেভইয়ার্ড বুক, স্টারডাস্ট ইত্যাদির রচয়িতা হিসেবে আপনি নিশ্চয় চেনেন।)।
২০০৪ সালে এই গল্পটি প্রকাশিত হয় শ্যাডোজ ওভার বেকার স্ট্রিট সংকলনে। অতঃপর আসে ২০০৪-এর হিউগো ও ২০০৫-এর লোকাস পুরস্কার, প্রশংসার প্লাবন, ইত্যাদি ইত্যাদি। এখনও পর্যন্ত ঠিক কটি সংকলনে এই গল্পটা স্থান পেয়েছে, জানি না। শুধু আমার কাছেই থাকা গোটা পাঁচেক বইয়ে এটা আছে, এবং আশঙ্কা হচ্ছে রবার্ট ব্লকের চিরকালীন ক্লাসিক “ইওর্স ট্রুলি, জ্যাক দ্য রিপার”-এর মতো এটাও গোটা পঞ্চাশেক সংকলনে জায়গা পাবে! এটি নিয়ে একটি মন-ধাঁধানো গ্রাফিক নভেল প্রকাশ করেছে ডার্ক হর্স কমিক্স
আমি প্রস্তাব করব, এই গ্রাফিক নভেলটি, বা গেইম্যান-এর অসামান্য গল্প-সংকলন ফ্রেজাইল থিংস জোগাড় করে এই গল্পটি পড়ে নিন। আর শুধু এটা নয়, শার্লক হোমসের এই পাঁচটি প্যাস্টিশই অবিলম্বে পড়ে ফেলার আহ্বান তথা অনুরোধ জানিয়ে আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি।
নমস্কার।