Sunday 28 December 2014

রাজভাষা, রাজধানী আর ঢেঁকি ও ধান

প্রায় মাসখানেক ধরে গুয়াহাটি তথা অফিসের ঘানি পিষতে পিষতে যখন নিজেকে বেশ একটা গার্হস্থ্য আর বাণপ্রস্থের মাঝামাঝি স্তরের আশ্রমিক ভাবতে শুরু করেছি, তখনই সমন (শমনও বলা চলে) এসে পৌঁছল ক'দিন আগে। রাজভাষা (একে নিছক হিন্দি বললে চলবে না। হিন্দি বলা হয় বলিউডি মশলাদার সিনেমায়। সরকারি কাজে যে দুর্বোধ্য এবং কার্যত অর্থহীন ভাষাটি ব্যবহার করতে কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তর এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করা হয়, এ হল সেই ভাষা।) বিষয়ক সংসদীয় সমিতি আগামীকাল ২৯শে ডিসেম্বর আরও পাঁচটি সংস্থার সঙ্গে আমাদের অফিসেও কাজকর্মে রাজভাষার ব্যবহার নিয়ে নিরীক্ষণ (হুঁ হুঁ বাবা, গোদা ভাষায় ইন্সপেকশন বললে কি আর এমন একটা শিরদাঁড়া-দিয়ে-হিমেল-স্পর্শ গোছের অনুভূতি হত?) করবেন। তবে সাংসদদের দয়ার শরীর, তার ওপর অসম এই মুহূর্তে বেড়াবার পক্ষে মোটেই সুবিধের নয়। তাই এই নিরীক্ষণ হবে রাজধানী-তে। অতঃপর বাঙালের রাজধানী আগমন, সকাল থেকে কুয়াশা আর শীত উপেক্ষা করে বধ্যভূমি (মানে কাল যেখানে যেতে হবে) খুঁজে বের করা এবং মিটিং করা। এই সব করতেই বেলা দু'টো বাজলো। লাঞ্চ সেরে মনে হল যে হোটেলে পড়ে থেকে কচু হবে। তারপর, দস্যু মোহনের ভাষ্য ঝেড়ে বললে: "কী হইতে কী হইয়া গেল!", দেখলাম যে আমি বেঙ্গল এসোসিয়েশন দ্বারা আয়োজিত চতুর্দশ বইমেলার সামনে পৌঁছে গেছি। আর তারপর যা হবার তাই হল। দু হাতে মোট সাতটা প্যাকেট আর মুখে লাজুক হাসি (আজ্ঞে হ্যাঁ, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে, সর্বত্র বই কিনলে আমার একটু লজ্জা করে, বাড়িতে গিয়ে শ্রীমতীর সামনে পড়ার সম্ভাবনা থাকলে ভয়ও করে) নিয়ে যখন গাড়িতে বসলাম, তখন আমার সঙ্গে থাকা প্রবীণ অ্যাসিস্টেন্ট ডাইরেক্টর আব্দুল হাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আগের বার বুকশেলফ গুলো ওনার পরিচিত দোকান থেকেই নিয়েছিলাম তো......।

তবে, যদিও এই মেলায় আমার এই প্রথম আসা, মেলাটার বেশ কয়েকটা বিশেষত্ব আমার নজরে পড়ল। ভুল হবার সম্ভাবনা খুব বেশি, তবু আমার মনে হল: -
১) কলকাতার মেলা যদিও তৃণমূলের একটা শিবিরে পরিণত হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে, এই মেলার চরিত্রটা কিন্তু এখনও বামপন্থী রয়েছে। এই বামপন্থা সি.পি.এম বা ফরোয়ার্ড ব্লকের শেষ দিককার ধান্দাবাজি আর লুম্পেন-ভিত্তিক রাজনীতি নয়, বরং মুক্তচিন্তা আর সংস্কৃতি-নির্ভর সেইসব চিন্তার কম্পন বহন করছে, একসময় আমরা যার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম।
২) এই মেলায় বিভিন্ন স্টলের দায়িত্ব যাঁদের কাছে ছিল, তাঁরা পেশাদার বিক্রেতা নন। তাই স্টলের তুলনায় অনেক সময়েই তাঁদের মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছিল পাশের মঞ্চে চলতে থাকা ক্যুইজ, যাতে বাঙালির একেবারে প্রাণের বিষয় নিয়ে চলছিল প্রশ্নোত্তর। তবে আমার সেটা ভালই লাগছিল, কারণ আমি নিজেও সোৎসাহে কান পেতেছিলাম ওই দিক তাক করেই। মাঝে যখন "এই পথ যদি না শেষ হয়" গানটা কোন সিনেমার, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে বেশ কয়েকটি দল ব্যর্থ হল, তখন "নামিয়ে দিন" বলে আমিও চেঁচিয়েছিলাম।

যাইহোক, বইমেলার উদ্দেশ্যে তো আর "আবার এসো মা" বলা যায়না। তাই বইগুলো ব্যাগে ভরি (প্লেনে এই অতিরিক্ত ওজনটা কীভাবে চেক-ইন্ করানো যায়, সেটাও ভাববার বিষয়), আর আজকের দুপুর-গড়িয়ে-সন্ধে কাটান সময়টা মনে রেখে দিই।

Wednesday 3 December 2014

দাড়ি-গোঁফ এবং ডিসেম্বর রাতের স্বপ্ন

ছেলে/পুরুষ-এর যদি দাড়ি-গোঁফ না থাকে, তবে তার অবস্থা যে কি করুণ হয়, তা সকলেই জানেন| কোথাও একটা পড়েছিলাম যে ভীমসেন [জোশি নন, মধ্যম পাণ্ডব-এর কথা বলছি (অবশ্য তিনিও যথেষ্ট ‘জোশি’ ছিলেন বলেই জানা যায়)] মাকুন্দ ছিলেন| তারপরেও যে তিনি শুধু দুর্যোধন-দুঃশাসন-কীচক প্রমুখের ওপরেই নিজের বাহুবল দেখিয়েছিলেন, কোনো মাস-মার্ডারার হয়ে যাননি, এ থেকেই তাঁর সংযমের প্রভূত পরিচয় পাওয়া যায় [এও বোঝা যায় যে মহাপ্রস্থানের পথে তাঁর পতন তাঁর অতিভোজনের জন্যে নয়, অন্য কোনো কারণে হয়েছিলো| সি.বি.আই না এস.আই.টি? হমমমম...]| কিন্তু একবার গজালে, এবং গজাতে থাকলে, দুটি বস্তুই ‘কাফি তকলিফ’-দেয়| গোঁফ-কে অনেক যত্নে রাখতে হয়, যাতে তার একদিকের দৈর্ঘ্য/প্রস্থ অন্যদিকের থেকে আলাদা না হয়, যাতে তাতে ক্রমে দৃশ্যমান হওয়া সাদা/ধূসর কেশ (অন্য কী টার্ম ব্যবহার করা যায় তা বুঝে পেলাম না| মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু আমরা...) খুব বাজে একটা এফেক্ট না আনে, ইত্যাদি-ইত্যাদি| আর দাড়ি মানে এক বিদিকিচ্ছিরি ব্যাপার| রোজ সকালে ফেনা-জল-সময়ের শ্রাদ্ধ করে ওটিকে নির্মূল না করলে গাল কুটকুট করবেই; একমাত্র রেহাই মিলতে পারে যদি ওটিকে নির্বিবাদে বাড়তে দেওয়ার অভ্যাসটি বজায় রাখা যায়| অনেক মুসলিমকে দেখেছি এই সমস্যাটার মোকাবিলা করার জন্যে গোঁফ উড়িয়ে শুধু দাড়ি লম্বা করতে (এর পেছনে কি কোনো ধর্মীয় কারণ আছে? হতেও পারে| একাধিক মানুষের মুখে শুনেছি যে ইসলাম নাকি সবথেকে বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম| তাতে হয়তো পুরুষের এই দ্বিবিধ সমস্যার এই বিশেষ সমাধান করে দেওয়া আছে|), কিন্তু আমার যেহেতু ওই লুক-টা অসহ্য লাগে, তাই ওই বিশেষ সমাধানটাও আমার কোনোকালেই মনঃপূত হয়নি| এদিকে শীতের সকালে রোজ এই হাঙ্গামা আর পোষাচ্ছিলো না| তাই কাল রাতে শুতে যাওয়ার আগে এর সমাধান ভাবার চেষ্টা করছিলাম|

আমার এয়ারফোর্স প্রত্যাগত বাবা এই সমস্যার সমাধান করেছিলেন দাড়ি ও গোঁফ দুইই কামিয়ে| সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, উত্তম কুমার, সৌরভ গাঙ্গুলি: এঁরা প্রত্যেকেই সেই পথেই হেঁটেছেন| কিন্তু এঁদের মুখের এমন একটা ব্যাক্তিত্ব আছে যে গোঁফ ছাড়াও এঁদের ভালো লাগে| আমি গোঁফ কামালে নিজেই নিজের মুখের দিকে তাকাতে পারবো না, বাকিরা যে কী পরিমাণ হাসাহাসি করবে তা তো সহজেই অনুমেয়| অতঃপর একটিই উপায়: গোঁফ ও দাড়ি দুটিকেই অবাধে বাড়তে দেওয়া| এই সমাধানটা আমার বেশ পছন্দ হলো| একদিকে রবীন্দ্রনাথের শান্ত-সৌম্য মুখ, অন্যদিকে আমার একগাল দাড়ি দেখে শ্রীমতীর মেজাজ কেমন হবে, এই নিয়ে ভেবে বেশ মুচকি-মুচকি হেসে ঘুমের সাধনা করলাম| কিন্তু তারপর....?

কোনো একটা বই-এ পড়েছিলাম (এইসব নাম মনে রাখতে পারলে ফুটনোট-টীকা সহযোগে এগুলোকে প্রবন্ধ বানানো যেতো, কিন্তু আমার আলসেমি নিয়ে আর কীই বা বলার আছে?) যে স্বপ্নে নাকি অবচেতন মন আমাদের এমন অনেক সত্যের সন্ধান দেয়, যা আমরা সচেতন ভাবে ভাবতে পারিনা| ঠিক তাইই হলো কাল রাতের স্বপ্নে| আমার ক্রম-পশ্চাদগামী কেশরেখা (গোদা বাংলায়: রিসিডিং হেয়ারলাইন)-র কথাটা আমি খেয়াল রাখিনি বা রাখতে চাইনি| স্বপ্নে দেখলাম যে আমাকে দেখতে রবীন্দ্রনাথ নয়, শুভাপ্রসন্নের মতো দেখাচ্ছে!

ঘুম ভাঙার পর যে টুথব্রাশ-এর বদলে শেভিং রেজর হাতে উঠেছিলো, একে কি অস্বাভাবিক বলা যায়?

Monday 1 December 2014

কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান: পূজাবার্ষিকী ২০১৪

আমাদের ছোটবেলায় সবথেকে সম্ভ্রমের চোখে যে শারদীয়া সংখ্যাটাকে দেখা হতো, সেটা হলো “কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান”| এখনকার ছোটরা এই পত্রিকাটিকে ঠিক কী চোখে দেখে তা আমার জানা নেই, কারণ, খুবই দুঃখের সঙ্গে হলেও স্বীকার করতেই হচ্ছে যে আমার চেনা-পরিচিতের মধ্যে আমি একটিও ‘ছোটো’ মানুষকে চিনি না (আমার মেয়ে সহ) যে পূজাবার্ষিকী পড়ে| তবে এই পত্রিকার এবছরের পূজাবার্ষিকী পড়ে আমার মতামত নিচে পেশ করলাম:
1.      যে পত্রিকার সবথেকে আকর্ষণীয় বিষয় হলো সতজিত রায়-এর “স্বপ্নদ্বীপ” (সুচিপত্রে তাও আবার ভুল বানানে ছাপা হয়েছে), সিদ্ধার্থ ঘোষ-এর “ঝন্টুমামার ছাঁকনি” আর সুধীন্দ্র সরকার-এর “প্রফেসর ব্রহ্ম ও কালোচিতা” [দুটিই এই পত্রিকার বছর ত্রিশেক পুরনো সংস্করণ থেকে নিয়ে আবার ছাপানো], তার অবস্থা নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই|
2.      নতুন লেখকদের মধ্যে শান্তনু বসু-র “অনাদি অধিকারীর একোয়াস্কোপ” আর নবকুমার দাস-এর “বক্সা রহস্য” সম্পাদকীয় স্পর্শ পেলে আরও উপভোগ্য হতো, এবং এঁদের আরও লেখা পড়ার ইচ্ছে রইলো|
3.      রাজেশ বসু-র নানা “গুণ”-এর কথা এর আগে অন্যান্য লেখকদের কাছ থেকে জেনেছি, তবে যেটা সত্যিই কৌতূহল উদ্রেক করে সেটা হলো: কোন লবির জোরে এই লোকটির লেখা বাংলার প্রায় সব ক’টি পাবলিশিং হাউস ছেপেই চলে, যেখানে সত্যিকারের ভালো এবং পাঠক-সমাদৃত লেখা পড়ে থাকে ছাপাখানা আর সম্পাদকের টেবিলের মাঝের ব্ল্যাক হোল-এ?
4.      পার্থজিত গঙ্গোপাধ্যায় (ইনিও আর একজন “শক্তিশালী” লেখক, যাঁর সম্পূর্ণভাবে খড়-ভুষি-তুল্য লেখাও পত্র ভারতী থেকে বই আকারে প্রকাশিত)-কে খুব ঠান্ডা মাথায় বোঝানো দরকার যে মাধ্যমিকের জন্যে লেখা রচনা ছাপাতে হলে (এই সব বিদ্বদজনের যা লবি থাকে তাতে এঁদের ধোপার জন্যে বানানো তালিকাও ছাপা হবে) তাকে “বিজ্ঞানভিত্তিক উপন্যাস” বলে মিথ্যা-ভাষণের কোনো প্রয়োজন নেই| বাংলার অভাগা খোকাখুকুরা রচনা-জ্ঞানেই ওই লেখা পড়ে ফেলবে|

সামগ্রিকভাবে আমি এই কথাই বলবো যে গত বছরের শারদীয়া সংখ্যাতেও রাবিশ বোঝাই ছিলো, তবে সৈকত মুখোপাধ্যায়-এর নিপুণ “সোনালি পশম” আর অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী-র “নিয়ম যখন ভাঙে” পড়ে মুখ থেকে বেরিয়েছিলো: “বাঃ”| এবারের সংখ্যাটি পড়ে যা বেরিয়েছে তা লেখার কোনো প্রয়োজন নেই| আমি এই পত্রিকাটির শারদীয়া সংখ্যা আর পড়বো না|

Thursday 20 November 2014

কিশোর ভারতী: শারদীয়া ১৪২১

এবারের শারদীয়া কিশোর ভারতী পত্রিকাটা অনেকদিন ধরে, বেশ ঠাণ্ডা মাথায় পড়ে, আজ শেষ করলাম|

পত্রিকাটির যে লেখাগুলো খুব-খুব ভালো লেগেছে সেগুলোর নাম এবং মন্তব্য আগে দেওয়া যাক: -

1.      ডাঃ সায়ন পালের গ্রাফিক নভেল “বঙ্কু ডাক্তার আর দক্ষিন রায়”: কিশোর ভারতীর মাধ্যমে পরিচিত হওয়া চরিত্রগুলোর এই দুর্দান্ত এডভেঞ্চার সত্যিই উপভোগ্য|
2.      ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর “দ্বীপের নাম কালাডেরা”: জগুমামার আর একটি দুর্দান্ত এডভেঞ্চার যাতে বিজ্ঞান, রহস্য, আর হিংস্রতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে|
3.      অনুরূপ চক্রবর্তীর ছবি ও গল্পে স্রেফ ফাটাফাটি কমিক্স “মৌমাছি হইতে সাবধান”|
4.      অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী-র “রহস্য যখন মাইক্রোস্কপিক”: কল্পবিজ্ঞান, সন্ত্রাসবাদ, রোমাঞ্চ, এবং প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই, এই চারটি রঙের সুতো দিয়ে যে ঠাসবুনোট নকশাটি লেখক তাঁর সহজ অথচ স্মার্ট ভাষায় গেঁথেছেন, তার বর্ণনা দিতে পারবো না, শুধু সব্বাইকে এটি পড়তে বলবো|
5.      হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্তের “কত কক্ষে কাগজ পোড়ে”: এডভেঞ্চার সাহিত্যের জন্যে যে লেখকের এমন নামযশ, তাঁর কলমে ভারতের ইতিহাসের এক রক্তক্ষয়ী এবং বিভীষিকাময় অধ্যায় এতোটাই সজীব ও বাস্তব হয়ে চোখের সামনে ফুটে উঠছিলো এই উপন্যাসটি পড়ার সময়, যে মাঝে-মাঝে সংশয় জাগছিলো, ইনিই সেই লেখক কি না| অতুলনীয় লেখা|
6.      ডাঃ শ্যামল চক্রবর্তী-র “বাঙালি ডাক্তারের ওষুধ আবিষ্কার”: এক অবহেলিত ও উপেক্ষিত বাঙালির বিজ্ঞান সাধনা ও তাঁর আবিষ্কারকে ধুলো ঝেড়ে আমাদের সবার সামনে আনার জন্যে লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই| এই লেখাটি সব্বার পড়া উচিত| তরুণ বন্দোপাধ্যায়ের “বিজ্ঞানী সন্ন্যাসী”-ও একই কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য|

এবার বলি সেগুলোর কথা যেগুলো ভালো লেগেছে, কিন্তু বারবার পড়ার মতো বলে মনে হয়নি: -
1.      শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়-এর “অষ্টাঙ্গপুরের বৃত্তান্ত”: পুরোপুরি না হলেও শীর্ষেন্দু এই গল্পের মাধ্যমে তাঁর জাদুকরি কলমের কিছুটা ঝলক আবার দেখিয়েছেন| আশা করা যায় যে ওনার কলম এবার পুরনো ফর্ম খুঁজে পাবে|
2.      চন্ডী লাহিড়ীর কমিক্স “জিরাফ কথা বললো”|
3.      ছড়া-কবিতা: এই অংশটা যদিও খুব ছোটদের কথা ভেবেই সাজানো হয় (যদিও আজকের ছোটরা ছড়া পড়ে কি না, সেই নিয়ে আমার প্রভূত সংশয় আছে), কিন্তু এর লেখাগুলোয় এমন একটা সরল আর অকৃত্রিম খুশির ভাব আছে, যেটা রক্ত আর হিংস্রতার মাঝে আমার বড্ড ভালো লেগেছে|
4.      তপন বন্দোপাধ্যায়-এর “সন্ন্যাসীস্যার ও ঘোড়াভূত”|
5.      জুরান নাথের চিত্রকাহিনি “বগলা এন্ড কোং”|
6.      সৈকত মুখোপাধ্যায়-এর “জিংকো একা জঙ্গলে”|
7.      বিনোদ ঘোষাল-এর “ভেকুর কেরামতি”|
8.      স্বপন বন্দোপাধ্যায়-এর “দীপেশ এবং তার দিদি”|
9.      নির্বেদ রায়-এর “জন্মদিনের ‘উপহার’”|
10.  সুদর্শন সেনশর্মা-র “দেড় কিলো রাবড়ি, পাঁচটি আনারস এবং...”|
11.  কমলবিকাশ বন্দোপাধ্যায়-এর “11 -এর জালে নিল আর্মস্ট্রং”|
12.  কৌশিক মজুমদার-এর “এক অবিশ্বাস্য সংকেত”|
13.  জয়ন্ত দে-র “খড়ের বাছুর”|
14.  অশোককুমার সেনগুপ্তের “চরণদাসের গৃহত্যাগ”|
15.  ঝিমলি মুখার্জি পাণ্ডে-র “রাজরহস্য”|
16.  দীপান্বিতা রায়-এর “ডুপ্লিকেট চাবি”|
কুমকুম সমাদ্দারের “ভাসা গুড়গুড়ের লাটের পথে” গল্পটি সুলিখিত, কিন্তু আজ থেকে তিরিশ বছর আগের কোনো শারদীয়া পত্রিকাতেই লেখাটি মানাতো|

পত্রিকাটির যে লেখাগুলো পড়ে তাদের লেখক/লেখিকাদের বয়কট করার বাসনা জেগেছে সেগুলো নিয়ে আমি আলাদা করে কোনো মন্তব্য করবো না| লেখাগুলোর প্রসঙ্গে একটাই কথা বলার আছে: সম্পাদক যদি লেখকদের নাম বা খুঁটির জোর ছাড়া, অন্য কোনো কারণে এই লেখাগুলোকে এই পত্রিকার অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন, তাহলে তাঁর অবিলম্বে কিছুদিনের জন্যে বনবাসে গিয়ে মাথা সাফ করে আসা অত্যন্ত প্রয়োজন| এই লেখাগুলো হলো: -
1.      সমরেশ মজুমদারের “অর্জুন এবং কৌটোর প্রেত”|
2.      প্রফুল্ল রায়ের “রামভরোসার মোটরগাড়ি” (দ্বিতীয় ভাগ)|
3.      কাবেরী রায়চৌধুরীর “রাসেলের বাণিজ্যযাত্রা”|
4.      অনীশ দেব-এর “গোলাপি, নরম এবং ঠান্ডা”|
5.      শান্তিপ্রিয় বন্দোপাধ্যায়-এর “মৃত্যুপুরী”|
6.      কিন্নর রায়-এর “সামিটের আগে”|
7.      বিকাশ মুখার্জি-র “অভিজ্ঞতা”|

যে লেখাগুলো পড়ে ভালো বা মন্দ, কোনো রকম ভাবনাই আলাদাভাবে মনে আসেনি, সেগুলোর কথা লিখছি না| এছাড়া যে লেখাগুলো ঘোষিত ভাবেই সংশ্লিষ্ট লেখকদের [যাঁদের ‘সেলিব্রিটি’ নাম দিয়ে ভূষিত করা হয়েছে] নামের জোরে (এবং খুব সম্ভবত আজকের কর্কটরোগাক্রান্ত বাংলায় ভাঙচুরের হাত থেকে সুসজ্জিত শো-রুমটিকে বাঁচাতে) এই বই-এ স্থান পেয়েছে এবং যেগুলো না পড়লে কিছুমাত্র ক্ষতি হবে না, সেগুলোর কথাও উল্লেখ করার দরকার নেই|


তাহলে শেষ বিচারে আমার মূল্যায়ণ কী? অচল মুদ্রার তুলনায় যে পত্রিকায় সচল টাকা বেশি, যার মাঝে কয়েকটি বার-বার পড়ার মতো মণিমুক্তো-ও, সেই পত্রিকাকে মন খুলেই ভালো বলা উচিত| আমিও বলছি: শারদীয়া কিশোর ভারতী আমার ভালো লেগেছে, তবে ২০১৬-র পরেও যদি ‘সেলিব্রিটি’-ঘেঁষা ‘সাহিত্য’ (??) এই পত্রিকায় দেখি তবে আর পত্রিকা না কিনে বইমেলায় বই-আকারে আলাদা ভাবেই ভালো লেখাগুলো কিনতে হবে|

Monday 28 July 2014

নিমেষতরে ইচ্ছে করে....!

ঈদ-এর সকাল| অফিস নেই| রাস্তায় গাড়ির বিকট কনসার্ট আজ প্রায় না থাকারই মতো; মনে হচ্ছে যেন বাজনদারেরা পয়সা পাবার ব্যাপারে খুব একটা নিশ্চিত নয়| এরকম অবস্থায় আমি একই সঙ্গে খুউব খুশি (কারণ ফাইল-ফ্যাক্স-মেইল-ফোন-“ম্যাডাম ইয়াদ কর রহে হ্যায়”-“ইউনিয়ন-ওয়ালে মিলনে কে লিয়ে বাহার বৈঠে হ্যায়”-“আজ বিকেল চারটেয় আপনার মিটিং আছে”: এই দশচক্র থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দ সত্যিই অতুলনীয়), এবং খুউব বিরক্ত (সারাদিন আমি তাহলে কী নিয়ে থাকবো?)| না-পড়া বই-এর চাপে বিড়ম্বিত বুকশেলফ ডাকে আয়-আয়, না-দেখা সিনেমায় বোঝাই ডিভিডি-র তাক ডাকে আয়-আয়| এর যে-কোনটার ডাকে আমি সাড়া দিতেই পারি, কিন্তু কেন দেবো? শক্তি চট্টোপাধ্যায় পরলোক থেকে এসে আমাকে কিছু সুভাষিত-বচন শোনাবার আগেই আমি বরং অন্য প্রসঙ্গে চলে যাই, আর সেটা হলো: কেন হঠাত আজ এই ব্লগিং?

আমার কাছে আমার ছোটবেলাটা একটা বিভীষিকা-তুল্য, যেটা পেরিয়ে আসাটা স্রেফ ঈশ্বরের আশীর্বাদ-এর জোরে (এবং জীবনবিজ্ঞানের শর্ত মেনে) সম্ভব হয়েছে বলেই মনে হয়| মশা-লোডশেডিং-জঞ্জাল-পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠদের অকারণ (এবং পাতি ইল্লিগাল) জ্যাঠামো-একটা নারকীয় স্কুল (রামকৃষ্ণ মিশন, কিন্তু অকপটে স্বীকার করি: ওই স্কুলে পড়ার পর রামকৃষ্ণ আর বিবেকানন্দ-র নামে অভক্তি এসে গেছিলো)-একটা অকহতব্য ‘বন্ধু’ (???)-মহল (যারা ঠিক সেই ব্যাপারগুলোতেই দক্ষ ছিলো যেগুলোয় আমি ছিলাম এক্কেবারে অক্ষম)-নিজের কনফিউজড অবস্থা (আশির দশক মানে সেক্সুয়ালি রিপ্রেসড ভণ্ডামির দশক): এই ভয়ংকর জায়গাটা কিঞ্চিত সহনীয় হতো মাত্র দু’টি জিনিসের সৌজন্যে| প্রথমতঃ, ব্যারাকপুর গার্লসের শাড়ি-পরা মেয়েদের দেখে (সেদিন গেছে, ওই স্কুলের হতভাগিনীরা এখন বীভত্স ডিজাইনের সালোয়ার-কামিজ পরে)| দ্বিতীয়তঃ, “আনন্দমেলা” পড়ে| পাক্ষিক “আনন্দমেলা”-য় তখন ফাটাফাটি সব লেখা বেরোতো, কিন্তু তাও একেবারে ম্লান হয়ে যেতো যখন পূজাবার্ষিকী “আনন্দমেলা” বেরোতো| ওই বিশেষ বইটি নিয়েও (যথারীতি) নানাবিধ স্যাডিস্ট-এর অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে: “আগে আমি পড়বো”, “স্কুল খুললেই না পরীক্ষা, এখন গল্পের বই পড়তে হবে না”, “****-এর মা বলছিলো যে এই ছুটিতে ও’র ....... শেষ হয়ে গেছে, আর তুই এখনো গল্পের বই নিয়ে পড়ে আছিস”, ইত্যাদি-ইত্যাদি| কিন্তু তবুও, সব কিছুর পরেও, যখন পূজাবার্ষিকী “আনন্দমেলা” নিয়ে বিছানায় কাত হতে পারতাম (ওই অভ্যেসটা কাটাতে পারিনি, এখনো আমার বই পড়ার ক্ষেত্রে ফেভারিট পোজ ও’টাই), কখনো কাকাবাবু-কখনো প্রফেসর শংকু-কখনো অর্জুন-এর সঙ্গে আমি পাড়ি দিতাম অনেক-অনেক দূরে| মনে হতো যেন রাস্তার ধারে জমে থাকা আবর্জনা, আর একই রকম ময়লা মনের মানুষদের শহরটা থেকে আমি চলে গেছি এক কল্পলোকে|
তারপর বয়স বাড়লো, আগে নিষ্কৃতি পেলাম ওই স্কুলটা থেকে, প্রায় একই সঙ্গে গেলো সেই ‘বন্ধু’-রা| আর তারপর ফেলে এলাম ব্যারাকপুর, কালিবাড়ির মাঠের ঘন্টাধ্বনি আর ফুচকা, নগেনের তেলেভাজা, জলুয়ার কচুরি, মন্টুর মিল্ককেক, স্টেশন-চত্বরের লস্যি আর রোল, আর নিজের ক্ষত-বিক্ষত ছেলেবেলাটাকে| কিন্তু “আনন্দমেলা” রয়ে গেলো আমার সঙ্গে| বেকার থাকার সময়ে যেমন আমার একমাত্র বন্ধু, আমার একমাত্র ‘কমরেড’ (সি.পি.এম-এর লুম্পেনদের গলায় বিকৃত হয়ে যাওয়া মানেটা নয়, আমি সহযোদ্ধা অর্থে বলছি) ছিলো সিগারেট [বিয়ের আগে ও’টাকে ছেড়ে দিয়েও অনেকদিন ভেবেছি, আমি কি বেইমানি করলাম?]| ঠিক সেইভাবেই, এই মধ্য বয়সেও, একটা রামধনুর দেশে পৌছবার ঠিকানা আমি খুঁজে বেড়াই “আনন্দমেলা”-য়| কিন্তু ভাবছি, এবার ছেড়ে দেওয়াই ভালো (চাটুজ্যেমশাই মনে হচ্ছে আমায় বেশ শক্ত করেই ধরেছেন আজ)| গত বেশ কয়েক মাস ধরেই পাক্ষিক “আনন্দমেলা”-য় প্রকাশিত লেখার মাণ দ্রুতবেগে নিম্নগামী, এবং ইতিমধ্যেই “কিশোর ভারতী” লেখার ব্যাপারে “আনন্দমেলা”-কে ছাপিয়ে গেছে (মুদ্রণ এবং বিপণন-এ আর একটু যত্নবান হলে মার্কেট শেয়ার-এও ছাপাবে, যদি এমন অবস্থাই চলে)| তবুও, অভ্যাসবশতঃ এবং “আশায়-আশায়” আমি পত্রিকাটা পড়া চালিয়ে যাচ্ছিলাম| কিন্তু পূজাবার্ষিকী “আনন্দমেলা”-র সৌজন্যে এবার একটা এসপার-ওসপার টাইপের সিদ্ধান্ত নিতেই হচ্ছে|

এবারের পূজাবার্ষিকী “আনন্দমেলা” বই আকারে বেরিয়ে গেছে এমন সময়ে যখন পুজোর গন্ধমাখা নীল আকাশের বদলে কালো মেঘের ছোপ লাগানো ময়লা আকাশের নিচে জল-কাদায় প্যাচপেচে শহরে পাঠকেরা এসাইনমেন্ট-ক্লাস-ওয়ার্কশপ নিয়ে নাস্তানাবুদ| একে কি “ক্যাচ দেম ইয়ং”-এর আক্ষরিক অনুপালন বলা যেতে পারে? কী বলা যেতে পারে তা নিয়ে ভাববার আগেই বইটা হু-হু করে বিকোতে শুরু করলো (আরে বাবা, এ-হলো সেই প্রকাশনার বই, যা পড়তে হয়, নাহলে পিছিয়ে পড়তে হয়!), এবং ফেসবুক-এর পেজে-পেজে পেঁজা তুলোর মতো নরম ভাষার বদলে দস্তুরমতো থান ইটের মতো ভাষায় লেখাগুলোর তুলো-ধোনাও শুরু হয়ে গেলো| অধিকাংশ লেখাই এই নিয়ে যে তথাকথিত নামজাদা লেখক-লেখিকারাও এবার প্রতিষ্ঠানের স্নেহধন্য উদীয়মান লেখক-লেখিকাকে জোর টক্কর দিয়েছেন “কে কতো ঝুল লিখতে পারে” সেই রেস্-এ| আমি এই বিশেষ প্রতিযোগিতায় মার্কিং করবো না, বরং কষ্ট করে নিজের বা বাবা/মা’র পয়সায় যাঁরা এই বইটি কিনেছেন, আমি তাদেরকেই আহ্বান জানাবো তাঁদের বুদ্ধিমত্তার এই অবমাননার সমুচিত জবাব দিতে| আমি শুধু সেই লেখাটা নিয়ে কিছু বলবো যেটা এই আবর্জনার স্তুপেও আমায় অনেক আগে পড়তে পাওয়া ভালো লেখাগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে: অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর “একটাই দিন”|

মাত্র তিন পাতায় লেখা এই গল্পটার বিষয়বস্তু নিয়ে কিছু বলতে গেলে যাঁরা গল্পটা পড়েন নি, তাঁদের সঙ্গে ঘোরতর অন্যায় করা হবে| শুধু এটুকুই বলতে পারি যে লেখার যেসব গুণের জন্যে আমি এই লেখকের লেখার একজন অনুরাগী (নির্মেদ গদ্য, নিপুণ বর্ণনা, অসাধারণ চরিত্র-চিত্রণ. টানটান গতি, ধাপে-ধাপে ক্লাইম্যাক্স-এর দিকে গল্প ও পাঠককে নিয়ে যেতে পারা, এবং মানবিকতার নির্মল স্পর্শ), তাদের প্রত্যেকটিই এই গল্পে মাত্র তিনটি পৃষ্ঠায় ফুটে উঠেছে| এই সব লেখা পড়লে মনে হয়, বাংলা ভাষায় শিশু-কিশোর সাহিত্যের ভবিষ্যত সুরক্ষিত| কিন্তু তারপরেই মনে হয় যে প্রাতিষ্ঠানিক লবিবাজি আর অদূরদর্শী প্রকাশনা-ব্যবস্থায় পিষ্ট এই বাজারে এইসব লেখকদের কি আদৌ টিঁকে থাকতে দেওয়া হবে? জানিনা, শুধু পাঠ্য বই-এর পাতা ছাড়িয়ে কয়েকটা লাইন এই রকম সময়ে মাথায় গুঁতো মারে আর বলে: “পাগলা, নেমে যা| যে ভাষার জন্যে তুই পাগল, যে ভাষার শিশু-কিশোর সাহিত্যের জন্যে তুই এখনো মাসে-মাসে এতো কিছু খরচা করে চলেছিস, সেই ভাষায় যাঁরা ভালো লেখেন তাঁদের একটু হলেও সাহায্য করার চেষ্টা কর্|” প্রকাশনা ব্যবস্থায় নামা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু কেউ কি নেই যিনি কলেজ স্ট্রিট-কে শাসন করা এই দুষ্টচক্রের ব্যূহ থেকে এই অভিমন্যু-দের বেরিয়ে আসার রাস্তা দেখাতে পারবেন?


ঈদ মুবারক| ভালো থাকুন| ভালো বই পড়ুন| আর ভালো লেখকদের খুঁজে বের করুন| আমি তেমন কয়েকজন-কে পেয়েছি| আপনাদের জন্যে আন্তরিক শুভেচ্ছা রইলো|

Wednesday 21 May 2014

আবার এসেছি ফিরে!!!



কথায় আছে যে কাজ না থাকলে লোকে নাকি জ্যাঠাইমার গঙ্গাযাত্রা করে| আমার প্রচুর কাজ আছে, কিন্তু তবুও এই ব্লগ-এর মাধ্যমে সম্প্রতি মাথায় ঘোরাঘুরি করা দুটো প্রসঙ্গ উল্লেখ না করে পারছিনা|

প্রথম বিষয়: বেশ কিছুদিন আগে আমার স্ত্রী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে একা একটা বেশ বড় ফ্ল্যাটে থেকেও আমি যে এতো ভূতের, ভ্যাম্পায়ার-এর, ওয়ারউলফ-এর, আর নানা ধরণের কিম্ভূত ও অদ্ভূত রকমের ভয়ের গল্প পড়ি, তা আমার এসবে ভয় করে কি না| আমি অকপটে উত্তর দিয়েছিলাম যে খবরের কাগজ আর নিউজ চ্যানেল/সাইট-গুলোর থেকে বড় ভয়-পাওয়ানোর উপাদান এখন আর নেই| ওগুলো আমাদের সত্যিকারের ভয় দেখায়| যখন কোনো কারণে আমার স্ত্রীর মোবাইল (মোট তিনটে নম্বর, এ ব্যাপারে উনি আমার থেকেও ‘কর্পোরেট’) বেজে-বেজে থেমে যায়, কিন্তু কেউ ধরে না, তখন ভয় করে| যখন কোনো কারণে মনে হয় যে স্কুল-বাসটা মেয়েকে যখন স্ট্যান্ডে নামিয়ে চলে যাবে তখন আমি বা আমার স্ত্রী সেখানে যদি পৌঁছতে না পারি, তখন ভীষণ-ভীষণ ভয় করে| “অবকি বার মোদি সরকার” স্লোগানে আরও অনেকের মতো আমিও গলা মিলিয়েছি, ভোট-ও দিয়েছি| কিন্তু আমার রাজ্য, আমার শহর, এখনও সেই বাহিনি-র শাসনাধীন যাদের রক্ষণাবেক্ষণে নারীদের জীবন ও সম্মানের কোনো মূল্যই আর নেই| এই ভয়ের হাত থেকে কি আমাদের মুক্তি দিতে পারবে নতুন কেন্দ্রীয় সরকার?

দ্বিতীয় বিষয়: নিখাদ এসকেপিস্ট এন্টারটেইনমেন্ট (পলায়নবাদী বিনোদন?) হিসেবে আমি যতো বই পড়েছি, তার মধ্যে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল-এর “দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড” স্রেফ তুলনাহীন| যদি এমন কেউ আদৌ থেকে থাকেন যিনি এই লেখাটি পড়েন নি, তাহলে তাঁর সুবিধার্থে জানাই যে  আমাজন অববাহিকায় পাহাড়-ঘেরা এক বিচিত্র জগত, যেখানে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুরা এখনো স্ব-মহিমায় বিরাজমান, সেখানে এক বিজ্ঞানী (প্রফেসর চ্যালেঞ্জার)-র নেতৃত্বে একটি অভিযান ও তার সঙ্গে জড়িত নানা ঘটনা নিয়ে লেখা এই এডভেঞ্চার বিশ্ব-সাহিত্যের অমর সম্পদ| ঐ লেখকেরই (আজ যাঁর ১৫৫-তম জন্মদিন) অমর সৃষ্টি শার্লক হোমস-কে ঐ পটভূমিতে রেখে বেশ কিছু প্যাসটিশে লেখা হয়েছে, যার কিছু ভালো (লেখক উইলিয়াম মেইকল) এবং কিছু একেবারে রদ্দি| কিন্তু হোমস বা চ্যালেঞ্জারের দুনিয়া ছিলো ভিক্টোরিয়া বা এডওয়ার্ড-এর সমকালীন| আজকের পৃথিবীতে কি এমন একটা এডভেঞ্চার বানানো সম্ভব? সম্ভব, এবং একটি মারকাটারি উপন্যাস কার্যত এই বিষয় নিয়েই লেখা হয়েছে: এই ব্যাপারটি আমি বুঝলাম সেই উপন্যাসটি দ্বিতীয় বার পড়তে গিয়ে! ডগলাস প্রেস্টন ও লিংকন চাইল্ড: এই লেখক জুটিকে এখনকার ইংরেজি সাহিত্যের যেকোনো পাঠকই চিনবেন এফ.বি.আই-এর স্পেশ্যাল এজেন্ট পেন্ডারগাস্ট-এর স্রষ্টা হিসেবে| এঁদের, তথা এজেন্ট পেন্ডারগাস্ট-এর প্রথম উপন্যাস ছিলো “রেলিক”| গল্পটা প্রাথমিকভাবে ছিলো একটা মিউজিয়ামের ভেতরে ঘটতে থাকা একের-পর-এক রহস্যময় ও ভয়াবহ হত্যার তদন্ত নিয়ে| পরে দেখা গেলো যে এই মৃত্যুগুলোর জন্যে কোনো মানুষ নয়, দায়ী হলো সভ্যতার নজর এড়িয়ে যাওয়া এক প্রাণী| এই প্রাণীর বাসভূমি (আমাজনের জিনগু উপত্যকা) এবং পেন্ডারগাস্ট-এর নামের মাঝের অংশ (জিনগু, যেটা আমরা অনেক পড়ে জেনেছিলাম), দুটোই কোনান ডয়েল-এর অমর রচনার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ, কারণ: (১) ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’-এ যে অঞ্চলটির কথা লেখা হয়েছিলো, সেটির সঙ্গে ঐ অঞ্চলের লিংকন-চাইল্ড-এর দেওয়া বর্ণণা-র প্রভূত সাদৃশ্য আছে; (২) প্রফেসর চ্যালেঞ্জার-এর চরিত্রটি কোনান ডয়েল যে মানুষটির ভিত্তিতে গড়েছিলেন (লেফটেনান্ট কর্নেল পার্সি ফসেট), সেই মানুষটি আমাজনের গভীর জঙ্গলের বুকে লুকিয়ে থাকা এক হারানো শহর (যাকে স্প্যানিশ কনকুইসাডর-রা ‘এল ডোরাডো’ নামে চিহ্নিত করেছিলো)-এর সন্ধানে গিয়ে ঐ অঞ্চলেই (জিনগু উপত্যকা) রহস্যময় ভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যান| পেন্ডারগাস্ট-এর নামে ঐ স্থান-টি ঢুকে পড়েছিলো কারণ তাঁর এক পূর্বপুরুষ ফসেট-এর সন্ধানে গিয়ে ওখানেই হারিয়ে যান এবং আর কখনো ফিরে আসেননি| আর পেন্ডারগাস্ট-এর পুরো চরিত্রটিই শার্লক হোমসের আরও ‘যুগোপযোগী’ এবং ‘কুল’ সংস্করণ মাত্র| তাই ‘রেলিক’ পড়লেই হোমস-কে আজকের পৃথিবীতে লস্ট ওয়ার্ল্ড-এর ভয়ংকর এক প্রাণী (যে শক্তিতে যেমন, বুদ্ধিতেও তেমন হওয়ায় মিউজিয়ামের ডক্টর রস তাকে ‘দ্য পারফেক্ট কিলিং মেশিন’ আখ্যা দেন)-র মোকাবিলা করতে দেখা যায়| লিংকন-চাইল্ড-এর এই শ্রদ্ধার্ঘ প্রায় পূর্ণ হয় তাঁদের সাম্প্রতিকতম পেন্ডারগাস্ট-এডভেঞ্চার-এ এসে (“হোয়াইট ফায়ার”), যেখানে কোনান ডয়েল-এর লেখা ‘শেষ’ হোমস-এর গল্প নাম দিয়ে একটি আস্ত প্যাসটিশে পেশ করা হয়েছে| এই প্যাসটিশে-টি লেখক-দের তথা পেন্ডারগাস্ট-এর মতে “দ্য হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস”-এর মাধ্যমে ডয়েল যে সত্যিকারের বিভীষিকাময় ঘটনাটিকে ধরতে চেয়েছিলেন, তারই আরও সঠিক বর্ণণা-মাত্র| তাই, সব মিলিয়ে, যদি আপনি “ভয় করতে ভালোবাসি তোমার কোলে চেপে” মতে বিশ্বাসী হয়ে ঘরের উষ্ণতা আর নিরাপত্তার মাঝে বসে ভয়াল-ভয়ংকর এডভেঞ্চার আর খুন-খারাপির গল্প পড়তে চান, তাহলে মনে-মনে হারিয়ে যাওয়ার মতো অনেক কিছুর সন্ধান কিন্তু আমি দিয়ে দিলাম আপনাকে| দিনটা ভালো কাটুক|