ঈদ-এর সকাল| অফিস নেই| রাস্তায় গাড়ির বিকট কনসার্ট আজ প্রায়
না থাকারই মতো; মনে হচ্ছে যেন বাজনদারেরা পয়সা পাবার ব্যাপারে খুব একটা নিশ্চিত নয়|
এরকম অবস্থায় আমি একই সঙ্গে খুউব খুশি (কারণ ফাইল-ফ্যাক্স-মেইল-ফোন-“ম্যাডাম ইয়াদ
কর রহে হ্যায়”-“ইউনিয়ন-ওয়ালে মিলনে কে লিয়ে বাহার বৈঠে হ্যায়”-“আজ বিকেল চারটেয়
আপনার মিটিং আছে”: এই দশচক্র থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দ সত্যিই অতুলনীয়), এবং খুউব
বিরক্ত (সারাদিন আমি তাহলে কী নিয়ে থাকবো?)| না-পড়া বই-এর চাপে বিড়ম্বিত বুকশেলফ
ডাকে আয়-আয়, না-দেখা সিনেমায় বোঝাই ডিভিডি-র তাক ডাকে আয়-আয়| এর যে-কোনটার ডাকে
আমি সাড়া দিতেই পারি, কিন্তু কেন দেবো? শক্তি চট্টোপাধ্যায় পরলোক থেকে এসে আমাকে
কিছু সুভাষিত-বচন শোনাবার আগেই আমি বরং অন্য প্রসঙ্গে চলে যাই, আর সেটা হলো: কেন
হঠাত আজ এই ব্লগিং?
আমার কাছে আমার ছোটবেলাটা একটা বিভীষিকা-তুল্য, যেটা পেরিয়ে
আসাটা স্রেফ ঈশ্বরের আশীর্বাদ-এর জোরে (এবং জীবনবিজ্ঞানের শর্ত মেনে) সম্ভব হয়েছে
বলেই মনে হয়| মশা-লোডশেডিং-জঞ্জাল-পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠদের অকারণ (এবং পাতি ইল্লিগাল)
জ্যাঠামো-একটা নারকীয় স্কুল (রামকৃষ্ণ মিশন, কিন্তু অকপটে স্বীকার করি: ওই স্কুলে
পড়ার পর রামকৃষ্ণ আর বিবেকানন্দ-র নামে অভক্তি এসে গেছিলো)-একটা অকহতব্য ‘বন্ধু’
(???)-মহল (যারা ঠিক সেই ব্যাপারগুলোতেই দক্ষ ছিলো যেগুলোয় আমি ছিলাম এক্কেবারে
অক্ষম)-নিজের কনফিউজড অবস্থা (আশির দশক মানে সেক্সুয়ালি রিপ্রেসড ভণ্ডামির দশক):
এই ভয়ংকর জায়গাটা কিঞ্চিত সহনীয় হতো মাত্র দু’টি জিনিসের সৌজন্যে| প্রথমতঃ, ব্যারাকপুর
গার্লসের শাড়ি-পরা মেয়েদের দেখে (সেদিন গেছে, ওই স্কুলের হতভাগিনীরা এখন বীভত্স
ডিজাইনের সালোয়ার-কামিজ পরে)| দ্বিতীয়তঃ, “আনন্দমেলা” পড়ে| পাক্ষিক “আনন্দমেলা”-য়
তখন ফাটাফাটি সব লেখা বেরোতো, কিন্তু তাও একেবারে ম্লান হয়ে যেতো যখন পূজাবার্ষিকী
“আনন্দমেলা” বেরোতো| ওই বিশেষ বইটি নিয়েও (যথারীতি) নানাবিধ স্যাডিস্ট-এর অত্যাচার
সহ্য করতে হয়েছে: “আগে আমি পড়বো”, “স্কুল খুললেই না পরীক্ষা, এখন গল্পের বই পড়তে
হবে না”, “****-এর মা বলছিলো যে এই ছুটিতে ও’র ....... শেষ হয়ে গেছে, আর তুই এখনো
গল্পের বই নিয়ে পড়ে আছিস”, ইত্যাদি-ইত্যাদি| কিন্তু তবুও, সব কিছুর পরেও, যখন
পূজাবার্ষিকী “আনন্দমেলা” নিয়ে বিছানায় কাত হতে পারতাম (ওই অভ্যেসটা কাটাতে
পারিনি, এখনো আমার বই পড়ার ক্ষেত্রে ফেভারিট পোজ ও’টাই), কখনো কাকাবাবু-কখনো
প্রফেসর শংকু-কখনো অর্জুন-এর সঙ্গে আমি পাড়ি দিতাম অনেক-অনেক দূরে| মনে হতো যেন
রাস্তার ধারে জমে থাকা আবর্জনা, আর একই রকম ময়লা মনের মানুষদের শহরটা থেকে আমি চলে
গেছি এক কল্পলোকে|
তারপর বয়স বাড়লো, আগে নিষ্কৃতি পেলাম ওই স্কুলটা থেকে,
প্রায় একই সঙ্গে গেলো সেই ‘বন্ধু’-রা| আর তারপর ফেলে এলাম ব্যারাকপুর, কালিবাড়ির
মাঠের ঘন্টাধ্বনি আর ফুচকা, নগেনের তেলেভাজা, জলুয়ার কচুরি, মন্টুর মিল্ককেক,
স্টেশন-চত্বরের লস্যি আর রোল, আর নিজের ক্ষত-বিক্ষত ছেলেবেলাটাকে| কিন্তু “আনন্দমেলা”
রয়ে গেলো আমার সঙ্গে| বেকার থাকার সময়ে যেমন আমার একমাত্র বন্ধু, আমার একমাত্র ‘কমরেড’
(সি.পি.এম-এর লুম্পেনদের গলায় বিকৃত হয়ে যাওয়া মানেটা নয়, আমি সহযোদ্ধা অর্থে
বলছি) ছিলো সিগারেট [বিয়ের আগে ও’টাকে ছেড়ে দিয়েও অনেকদিন ভেবেছি, আমি কি বেইমানি
করলাম?]| ঠিক সেইভাবেই, এই মধ্য বয়সেও, একটা রামধনুর দেশে পৌছবার ঠিকানা আমি খুঁজে
বেড়াই “আনন্দমেলা”-য়| কিন্তু ভাবছি, এবার ছেড়ে দেওয়াই ভালো (চাটুজ্যেমশাই মনে
হচ্ছে আমায় বেশ শক্ত করেই ধরেছেন আজ)| গত বেশ কয়েক মাস ধরেই পাক্ষিক “আনন্দমেলা”-য়
প্রকাশিত লেখার মাণ দ্রুতবেগে নিম্নগামী, এবং ইতিমধ্যেই “কিশোর ভারতী” লেখার
ব্যাপারে “আনন্দমেলা”-কে ছাপিয়ে গেছে (মুদ্রণ এবং বিপণন-এ আর একটু যত্নবান হলে মার্কেট
শেয়ার-এও ছাপাবে, যদি এমন অবস্থাই চলে)| তবুও, অভ্যাসবশতঃ এবং “আশায়-আশায়” আমি
পত্রিকাটা পড়া চালিয়ে যাচ্ছিলাম| কিন্তু পূজাবার্ষিকী “আনন্দমেলা”-র সৌজন্যে এবার
একটা এসপার-ওসপার টাইপের সিদ্ধান্ত নিতেই হচ্ছে|
এবারের পূজাবার্ষিকী “আনন্দমেলা” বই আকারে বেরিয়ে গেছে এমন
সময়ে যখন পুজোর গন্ধমাখা নীল আকাশের বদলে কালো মেঘের ছোপ লাগানো ময়লা আকাশের নিচে
জল-কাদায় প্যাচপেচে শহরে পাঠকেরা এসাইনমেন্ট-ক্লাস-ওয়ার্কশপ নিয়ে নাস্তানাবুদ| একে
কি “ক্যাচ দেম ইয়ং”-এর আক্ষরিক অনুপালন বলা যেতে পারে? কী বলা যেতে পারে তা নিয়ে
ভাববার আগেই বইটা হু-হু করে বিকোতে শুরু করলো (আরে বাবা, এ-হলো সেই প্রকাশনার বই,
যা পড়তে হয়, নাহলে পিছিয়ে পড়তে হয়!), এবং ফেসবুক-এর পেজে-পেজে পেঁজা তুলোর মতো নরম
ভাষার বদলে দস্তুরমতো থান ইটের মতো ভাষায় লেখাগুলোর তুলো-ধোনাও শুরু হয়ে গেলো|
অধিকাংশ লেখাই এই নিয়ে যে তথাকথিত নামজাদা লেখক-লেখিকারাও এবার প্রতিষ্ঠানের
স্নেহধন্য উদীয়মান লেখক-লেখিকাকে জোর টক্কর দিয়েছেন “কে কতো ঝুল লিখতে পারে” সেই
রেস্-এ| আমি এই বিশেষ প্রতিযোগিতায় মার্কিং করবো না, বরং কষ্ট করে নিজের বা
বাবা/মা’র পয়সায় যাঁরা এই বইটি কিনেছেন, আমি তাদেরকেই আহ্বান জানাবো তাঁদের
বুদ্ধিমত্তার এই অবমাননার সমুচিত জবাব দিতে| আমি শুধু সেই লেখাটা নিয়ে কিছু বলবো
যেটা এই আবর্জনার স্তুপেও আমায় অনেক আগে পড়তে পাওয়া ভালো লেখাগুলোর কথা মনে করিয়ে
দিয়েছে: অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর “একটাই দিন”|
মাত্র তিন পাতায় লেখা এই গল্পটার বিষয়বস্তু নিয়ে কিছু বলতে
গেলে যাঁরা গল্পটা পড়েন নি, তাঁদের সঙ্গে ঘোরতর অন্যায় করা হবে| শুধু এটুকুই বলতে
পারি যে লেখার যেসব গুণের জন্যে আমি এই লেখকের লেখার একজন অনুরাগী (নির্মেদ গদ্য,
নিপুণ বর্ণনা, অসাধারণ চরিত্র-চিত্রণ. টানটান গতি, ধাপে-ধাপে ক্লাইম্যাক্স-এর দিকে
গল্প ও পাঠককে নিয়ে যেতে পারা, এবং মানবিকতার নির্মল স্পর্শ), তাদের প্রত্যেকটিই
এই গল্পে মাত্র তিনটি পৃষ্ঠায় ফুটে উঠেছে| এই সব লেখা পড়লে মনে হয়, বাংলা ভাষায়
শিশু-কিশোর সাহিত্যের ভবিষ্যত সুরক্ষিত| কিন্তু তারপরেই মনে হয় যে প্রাতিষ্ঠানিক
লবিবাজি আর অদূরদর্শী প্রকাশনা-ব্যবস্থায় পিষ্ট এই বাজারে এইসব লেখকদের কি আদৌ
টিঁকে থাকতে দেওয়া হবে? জানিনা, শুধু পাঠ্য বই-এর পাতা ছাড়িয়ে কয়েকটা লাইন এই রকম
সময়ে মাথায় গুঁতো মারে আর বলে: “পাগলা, নেমে যা| যে ভাষার জন্যে তুই পাগল, যে ভাষার
শিশু-কিশোর সাহিত্যের জন্যে তুই এখনো মাসে-মাসে এতো কিছু খরচা করে চলেছিস, সেই
ভাষায় যাঁরা ভালো লেখেন তাঁদের একটু হলেও সাহায্য করার চেষ্টা কর্|” প্রকাশনা
ব্যবস্থায় নামা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু কেউ কি নেই যিনি কলেজ স্ট্রিট-কে শাসন
করা এই দুষ্টচক্রের ব্যূহ থেকে এই অভিমন্যু-দের বেরিয়ে আসার রাস্তা দেখাতে পারবেন?
ঈদ মুবারক| ভালো থাকুন| ভালো বই পড়ুন| আর ভালো লেখকদের
খুঁজে বের করুন| আমি তেমন কয়েকজন-কে পেয়েছি| আপনাদের জন্যে আন্তরিক শুভেচ্ছা রইলো|
No comments:
Post a Comment