কথায় আছে যে কাজ না থাকলে লোকে
নাকি জ্যাঠাইমার গঙ্গাযাত্রা করে| আমার প্রচুর কাজ আছে, কিন্তু তবুও এই ব্লগ-এর
মাধ্যমে সম্প্রতি মাথায় ঘোরাঘুরি করা দুটো প্রসঙ্গ উল্লেখ না করে পারছিনা|
প্রথম বিষয়:
বেশ কিছুদিন আগে আমার স্ত্রী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে একা একটা বেশ বড় ফ্ল্যাটে
থেকেও আমি যে এতো ভূতের, ভ্যাম্পায়ার-এর, ওয়ারউলফ-এর, আর নানা ধরণের কিম্ভূত ও
অদ্ভূত রকমের ভয়ের গল্প পড়ি, তা আমার এসবে ভয় করে কি না| আমি অকপটে উত্তর দিয়েছিলাম
যে খবরের কাগজ আর নিউজ চ্যানেল/সাইট-গুলোর থেকে বড় ভয়-পাওয়ানোর উপাদান এখন আর নেই|
ওগুলো আমাদের সত্যিকারের ভয় দেখায়| যখন কোনো কারণে আমার স্ত্রীর
মোবাইল (মোট তিনটে নম্বর, এ ব্যাপারে উনি আমার থেকেও ‘কর্পোরেট’) বেজে-বেজে থেমে
যায়, কিন্তু কেউ ধরে না, তখন ভয় করে| যখন কোনো কারণে মনে হয় যে স্কুল-বাসটা মেয়েকে
যখন স্ট্যান্ডে নামিয়ে চলে যাবে তখন আমি বা আমার স্ত্রী সেখানে যদি পৌঁছতে না
পারি, তখন ভীষণ-ভীষণ ভয় করে| “অবকি বার মোদি সরকার” স্লোগানে আরও অনেকের মতো আমিও
গলা মিলিয়েছি, ভোট-ও দিয়েছি| কিন্তু আমার রাজ্য, আমার শহর, এখনও সেই বাহিনি-র শাসনাধীন
যাদের রক্ষণাবেক্ষণে নারীদের জীবন ও সম্মানের কোনো মূল্যই আর নেই| এই ভয়ের হাত
থেকে কি আমাদের মুক্তি দিতে পারবে নতুন কেন্দ্রীয় সরকার?
দ্বিতীয়
বিষয়:
নিখাদ এসকেপিস্ট এন্টারটেইনমেন্ট (পলায়নবাদী বিনোদন?) হিসেবে আমি যতো বই পড়েছি,
তার মধ্যে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল-এর “দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড” স্রেফ তুলনাহীন| যদি
এমন কেউ আদৌ থেকে থাকেন যিনি এই লেখাটি পড়েন নি, তাহলে তাঁর সুবিধার্থে জানাই
যে আমাজন অববাহিকায় পাহাড়-ঘেরা এক বিচিত্র
জগত, যেখানে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুরা এখনো স্ব-মহিমায় বিরাজমান, সেখানে এক বিজ্ঞানী (প্রফেসর
চ্যালেঞ্জার)-র নেতৃত্বে একটি অভিযান ও তার সঙ্গে জড়িত নানা ঘটনা নিয়ে লেখা এই
এডভেঞ্চার বিশ্ব-সাহিত্যের অমর সম্পদ| ঐ লেখকেরই (আজ যাঁর ১৫৫-তম জন্মদিন) অমর
সৃষ্টি শার্লক হোমস-কে ঐ পটভূমিতে রেখে বেশ কিছু প্যাসটিশে লেখা হয়েছে, যার কিছু
ভালো (লেখক উইলিয়াম মেইকল) এবং কিছু একেবারে রদ্দি| কিন্তু হোমস বা চ্যালেঞ্জারের
দুনিয়া ছিলো ভিক্টোরিয়া বা এডওয়ার্ড-এর সমকালীন| আজকের পৃথিবীতে কি এমন একটা
এডভেঞ্চার বানানো সম্ভব? সম্ভব, এবং একটি মারকাটারি উপন্যাস কার্যত এই বিষয় নিয়েই
লেখা হয়েছে: এই ব্যাপারটি আমি বুঝলাম সেই উপন্যাসটি দ্বিতীয় বার পড়তে গিয়ে! ডগলাস
প্রেস্টন ও লিংকন চাইল্ড: এই লেখক জুটিকে এখনকার ইংরেজি সাহিত্যের যেকোনো পাঠকই
চিনবেন এফ.বি.আই-এর স্পেশ্যাল এজেন্ট পেন্ডারগাস্ট-এর স্রষ্টা হিসেবে| এঁদের, তথা এজেন্ট
পেন্ডারগাস্ট-এর প্রথম উপন্যাস ছিলো “রেলিক”| গল্পটা প্রাথমিকভাবে ছিলো একটা
মিউজিয়ামের ভেতরে ঘটতে থাকা একের-পর-এক রহস্যময় ও ভয়াবহ হত্যার তদন্ত নিয়ে| পরে
দেখা গেলো যে এই মৃত্যুগুলোর জন্যে কোনো মানুষ নয়, দায়ী হলো সভ্যতার নজর এড়িয়ে
যাওয়া এক প্রাণী| এই প্রাণীর বাসভূমি (আমাজনের জিনগু উপত্যকা) এবং পেন্ডারগাস্ট-এর
নামের মাঝের অংশ (জিনগু, যেটা আমরা অনেক পড়ে জেনেছিলাম), দুটোই কোনান ডয়েল-এর অমর
রচনার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ, কারণ: (১) ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’-এ যে অঞ্চলটির কথা লেখা
হয়েছিলো, সেটির সঙ্গে ঐ অঞ্চলের লিংকন-চাইল্ড-এর দেওয়া বর্ণণা-র প্রভূত সাদৃশ্য
আছে; (২) প্রফেসর চ্যালেঞ্জার-এর চরিত্রটি কোনান ডয়েল যে মানুষটির ভিত্তিতে
গড়েছিলেন (লেফটেনান্ট কর্নেল পার্সি ফসেট), সেই মানুষটি আমাজনের গভীর জঙ্গলের বুকে
লুকিয়ে থাকা এক হারানো শহর (যাকে স্প্যানিশ কনকুইসাডর-রা ‘এল ডোরাডো’ নামে চিহ্নিত
করেছিলো)-এর সন্ধানে গিয়ে ঐ অঞ্চলেই (জিনগু উপত্যকা) রহস্যময় ভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে
যান| পেন্ডারগাস্ট-এর নামে ঐ স্থান-টি ঢুকে পড়েছিলো কারণ তাঁর এক পূর্বপুরুষ ফসেট-এর
সন্ধানে গিয়ে ওখানেই হারিয়ে যান এবং আর কখনো ফিরে আসেননি| আর পেন্ডারগাস্ট-এর পুরো
চরিত্রটিই শার্লক হোমসের আরও ‘যুগোপযোগী’ এবং ‘কুল’ সংস্করণ মাত্র| তাই ‘রেলিক’
পড়লেই হোমস-কে আজকের পৃথিবীতে লস্ট ওয়ার্ল্ড-এর ভয়ংকর এক প্রাণী (যে শক্তিতে যেমন,
বুদ্ধিতেও তেমন হওয়ায় মিউজিয়ামের ডক্টর রস তাকে ‘দ্য পারফেক্ট কিলিং মেশিন’ আখ্যা
দেন)-র মোকাবিলা করতে দেখা যায়| লিংকন-চাইল্ড-এর এই শ্রদ্ধার্ঘ প্রায় পূর্ণ হয়
তাঁদের সাম্প্রতিকতম পেন্ডারগাস্ট-এডভেঞ্চার-এ এসে (“হোয়াইট ফায়ার”), যেখানে কোনান
ডয়েল-এর লেখা ‘শেষ’ হোমস-এর গল্প নাম দিয়ে একটি আস্ত প্যাসটিশে পেশ করা হয়েছে| এই
প্যাসটিশে-টি লেখক-দের তথা পেন্ডারগাস্ট-এর মতে “দ্য হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস”-এর মাধ্যমে
ডয়েল যে সত্যিকারের বিভীষিকাময় ঘটনাটিকে ধরতে চেয়েছিলেন, তারই আরও সঠিক
বর্ণণা-মাত্র| তাই, সব মিলিয়ে, যদি আপনি “ভয় করতে ভালোবাসি তোমার কোলে চেপে” মতে
বিশ্বাসী হয়ে ঘরের উষ্ণতা আর নিরাপত্তার মাঝে বসে ভয়াল-ভয়ংকর এডভেঞ্চার আর
খুন-খারাপির গল্প পড়তে চান, তাহলে মনে-মনে হারিয়ে যাওয়ার মতো অনেক কিছুর সন্ধান
কিন্তু আমি দিয়ে দিলাম আপনাকে| দিনটা ভালো কাটুক|
No comments:
Post a Comment