Monday 30 September 2019

য়া দেবী!


মহালয়া এসে গেলেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দুটো ঢেউ আছড়ে পড়ে
একটা ঢেউ তোলেন বামপন্থী ও নারীবাদীরাএঁরা দুর্গাকে নানাবিধ অপশব্দে ভূষিত করে মহিষাসুরকে পরাভূত নায়কের স্থান দিতে সচেষ্ট হনএই ধারাতেই পোস্টিত হয় ‘আমার দুর্গা, তোমার দুর্গা…’ ইত্যাদি নানা চিৎকৃত ভাষ্য
দ্বিতীয় ঢেউয়ের লক্ষ্য হয় দুর্গাপূজার উৎস, রূপ, রূপান্তর, ইতিহাস – এই বিষয়ে যথাসাধ্য জানাচায়ের পেয়ালায় তুফান ওঠেদুর্গা আদৌ শাস্ত্রীয় দেবী কি না, তাই নিয়ে প্রায় লাঠালাঠি হয়
আমার আজকের পোস্ট এই দ্বিতীয় ঢেউ নিয়েইনিজের সীমিত সাধ্যের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করে আমি কয়েকটা বইয়ের সন্ধান পেয়েছি, যাদের অনুসরণ ও অনুধাবন করলে দুর্গাপূজার অতীত ও বর্তমান তথা তার শাস্ত্রীয় ও পৌরাণিক আখ্যান-ব্যাখ্যা অনেকটাই জানতে পারা যায়সেই বইগুলোর সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই এই পোস্টের মাধ্যমে



(১) শ্রীশ্রীদুর্গা তত্ত্বে ও কাহিনিতে~

স্বামী অচ্যুতানন্দের লেখা এই বইটির প্রকাশক দেব সাহিত্য কুটীরদুর্গাপূজার ধর্মীয় দিকটি সম্বন্ধে জানতে চাইলে মাত্র ১২০ পৃষ্ঠার এই বইটিকেই সবচেয়ে ভালো প্রাইমার বলা যেতে পারেযে-সব অধ্যায়ে এটি বিন্যস্ত, তাদের পরিচয় নীচে দিলাম:
-      শ্রীভগবতীর লীলা স্মরণ
-      মধুকৈটভ বধলীলা
-      মধুকৈটভনাশিনী মহাকালী
-      মহিষাসুরমর্দিনী
-      নারায়ণী স্তুতির ভাবানুবাদ
-      দেবী দুর্গার বহু রূপ ও বহু নাম
-      জয়ন্ত্যাদি শক্তি
-      নবদুর্গা
-      অষ্টশক্তি-অষ্টমাতৃকা
-      শুম্ভ-নিশুম্ভ কাহিনি
-      দেবতাদের স্তব
-      নানা রূপ ধরা দেবী
-      দেবীমাহাত্ম্য
-      শ্রীশ্রীদশমহাবিদ্যা
-      কে জানে কালী কেমন
-      কালীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ

(২) দেবীমাহাত্ম্য ও শ্রীশ্রীদেবী দুর্গা~

নবকুমার ভট্টাচার্য লিখিত এই শীর্ণকায় (মাত্র ৬৫ পৃষ্ঠা!) বইটির পরিবেশক পুস্তক বিপণিযাঁরা চণ্ডীপাঠ তথা মহামায়া’র আখ্যান প্রসঙ্গে দেবী দুর্গা’র সঙ্গে এই শক্তির সম্পর্কটি বুঝতে চান, তাঁরাই এই বইটির অভীষ্ট পাঠকগৌরচন্দ্রিকার পর এতে যে অধ্যায়গুলো রয়েছে, তাদের সূচি দেখলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে:
·        দেবীমাহাত্ম্য ও শ্রীশ্রীদেবী দুর্গা
·        চণ্ডী কে?
·        দেবীমাহাত্ম্য শ্রীশ্রীচণ্ডীতে মাতৃকা
·        দেবী-মহিষাসুর যুদ্ধের গতি প্রকৃতি ও যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র
·        অসুর দমনে সুরের কুমারী
·        নাম মাহাত্ম্যে দেবী চণ্ডী
·        দেবী আরাধনায় চণ্ডীপাঠ কেন?
·        চণ্ডীপাঠের নিয়ম-কানুন
·        চণ্ডীমণ্ডপ

(৩) মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা~

স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ রচিত, শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ থেকে প্রকাশিত Art & Culture Series-এর অন্তর্গত এই ৩৮২ পৃষ্ঠার বইটি দুর্গাপূজা নিয়ে ‘শাস্ত্রীয়, ঐতিহাসিক ও গবেষণামূলক আলোচনা’-র সংকলন২৬টি অধ্যায় ও পাঁচটি পরিশিষ্টতে বিন্যস্ত, প্রামাণ্য বিবলিওগ্রাফি-তে সমৃদ্ধ এই বইটিদেবী দুর্গার শাস্ত্রীয়, দার্শনিক, ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক ভিত্তি নিয়ে যদি জানতে চান, তাহলে এর চেয়ে ভালো রেফারেন্স বোধহয় পাওয়া যাবে নাএর গোটা সূচিপত্র তুলে দেওয়ার কথা ভেবেই হৃৎকম্প হচ্ছে, তবু লড়ে যাচ্ছিমা দুর্গার ব্যাপার বলে কথা!
প্রস্তাবনায় পাদপীঠরচনার সংক্ষিপ্ত-আলোচনা রয়েছে। তারপর শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ভাগ, অর্থাৎ গবেষণার আলোকে বিস্তৃত ও পূর্ণাঙ্গ-আলোচনাতাতে একে-একে এসেছে:
1.      ঋগ্বেদে দেবতা
2.     বিশ্বমাতৃত্বের ধারণা
3.    বেদে সপ্তমাতৃকা-প্রসঙ্গ
4.     শ্রীশ্রী চণ্ডীতে মাতৃকা ও মাতৃকাতত্ত্ব
5.    বিশ্বমাতৃকা ও মহাশক্তি ননা
6.    মহিষমর্দিনী-দুর্গা’র মূর্তিকল্পনায় বৈশিষ্ট্য
7.     পরমাপ্রকৃতি-বিশ্বজননী দুর্গা
8.    ভারতেতর-দেশে বিশ্বমাতৃত্বের ধারণা
9.     ক্রমবিকাশের পথে দেবী-ধারণায় শ্রীদুর্গা
10.       দেবী দুর্গা ও সূর্য বা মিত্রদেবতা
11.         দেবী দুর্গা’র জন্ম ও বিকাশরহস্য
12.        শিব ও শিবঘরণী-দুর্গা’র বিচিত্র রূপকল্পনা
13.       বাগ্‌দেবী সরস্বতী’র নামভেদ বৈদিকসাহিত্যে
14.        শ্রীশ্রীকাত্যায়নী দুর্গা
15.       আমাদের (গৌড়-বঙ্গে) দুর্গোৎসব
16.       শারদীয়া-শ্রীশ্রীদুর্গা’র অকালবোধন
17.        বৈদিকযুগে শরৎকালে রুদ্রযজ্ঞের অনুষ্ঠান
18.       অকালবোধনের কারণ, রহস্য ও তথ্য
19.        কাত্যায়নীতন্ত্র ও দেবীমাহাত্ম্য
20.      কূলচূড়ামণিতন্ত্রে মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা
21.        দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী ও দেবী দুর্গা
22.       দেবী দুর্গা’র মূর্তিরূপায়নের কথা
23.      মহিষরূপধারী মহিষাসুর ও দেবীকে অস্ত্র দান
24.       রূপে ও নাম-বৈচিত্র্যে দেবী দুর্গা
25.      দেবীর ধ্যান ও আরাধনা
26.      তন্ত্রে ও দর্শনে দেবী দুর্গা
পরিশিষ্টে স্থান পেয়েছে~ দেবী মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা’র স্বজন-পরিজন, রাজা কংসনারায়ণ ও বঙ্গে প্রথম দুর্গোৎসব, শ্রীশ্রীদুর্গাপূজায় সঙ্গীত ও রাগ-রাগিণী এবং দেবী দুর্গা’র স্নানমন্ত্রের সুর ও স্বরলিপি
দুর্গাপূজার দিনগুলোয় দেবীকে নিয়ে জানতে চাইলে ৩৮২ পৃষ্ঠার এই মহাগ্রন্থটি লা-জবাব

(৪) দুর্গা: বাংলার ঐতিহ্যে~

দীপঙ্কর ঘোষের সংকলনে ও সম্পাদনায়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত এ এক আশ্চর্য সুন্দর বই! দেবী দুর্গার রূপকল্পনায় সর্বভারতীয় ঐতিহ্য অনুসরণের পাশাপাশি বাঙালি শিল্পীরা এক নিজস্ব ভুবনও নির্মাণ করেছেনঅজস্র রঙিন ছবি ও আনুষঙ্গিক সংক্ষিপ্ত বিবরণ তথা আলোচনা দিয়ে এই বই সেই ভুবনটিকে ধরে রাখতে চেয়েছেসেই ছবিগুলো তুলে দিতে গেলে এই পোস্ট আয়ত্তের বাইরে চলে যাবেতাই আপাতত সূচিপত্র তুলে ধরলাম শুধু
§  প্রস্তাবনা: দীপঙ্কর ঘোষ
§  বাঙালির দুর্গা: গৌতম সেনগুপ্ত
§  ভাস্কর্য ও কারুশিল্প
§  চিত্র
§  প্রতিমাশিল্প
আমার সীমিত অভিজ্ঞতায় দুর্গা’র রূপকল্পনা ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ৭২ পৃষ্ঠার এই বইটির চেয়ে ভালো তথা দৃষ্টিনন্দন বই আর একটিও নেই

(৫) মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা~

সব পাঠকের জন্য, সবরকমের দৃষ্টিভঙ্গির ফসল হিসেবে জন্মানো অজস্র কৌতূহলের উত্তর দেওয়ার জন্য ‘ওয়ান স্টপ শপ’ হিসেবে যদি একটি বই চান, তাহলে ২৮৮ পৃষ্ঠার এই বইটির জবাব নেই‘নবকল্লোল’-এর বিভিন্ন শারদীয়া সংখ্যায় দুর্গা তথা শক্তির নানা রূপের উপাসনা নিয়ে যে-সব লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, তারাই স্থান পেয়েছে দেব সাহিত্য কুটীর থেকে প্রকাশিত এই সংকলনেএর সূচিপত্র দিতে গিয়েও হিমসিম খেতে হবে, তবু ‘জয় মা!’ বলে চেষ্টা করছি
1)     শক্তিপূজার উৎস সন্ধানে ~ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ
2)    দুর্গা: রূপে রূপান্তরে ~ স্বামী অচ্যুতানন্দ
3)    সপরিবারে দুর্গা ~ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ
4)    মাতৃসকাশে মিনতি ~ স্বামী জ্ঞানলোকানন্দ
5)    শক্তিদায়িনী মা দুর্গা’র অমৃতকথা ~ স্বামী বেদানন্দ
6)    অপরাশক্তি মা-মহামায়া ~ স্বামী অতীশানন্দ
7)    জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ~ স্বামী আত্মবোধানন্দ
8)    আদ্যাশক্তি দেবী মহামায়া ~ ব্রহ্মচারী নিত্যানন্দ
9)    দেবী হলেন দুর্গা ~ নন্দলাল ভট্টাচার্য
10)            বঙ্গে দুর্গোৎসব ~ রাধারমণ রায়
11)             দুর্গা-বিচিত্রা: বাংলার চালারীতির মন্দির-ভাস্কর্যে দুর্গা ~ মোহিত রায়
12)            দেবী’র আসা-যাওয়ার নেপথ্যে বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো ~ বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
13)            ভারতীয় দৃষ্টিতে মাতৃবন্দনা ~ পূর্বা সেনগুপ্ত
14)            দুর্গা: উৎস, বিস্তৃতি ও বৈচিত্র্য ~ মানস ভাণ্ডারী
15)            ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসব ~ পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
16)            দুটি প্রাচীন দুর্গাপূজা ~ দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
17)            সেকালের দুর্গোৎসবে একালের ঘটনা: সাহেব কলকাতার দুর্গোৎসব ~ বিদ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
18)            বর্গী বিতাড়ন ও সামন্তভূমের দুর্গাপূজা ~ শৈলেন চক্রবর্তী
19)            চিন্ময়ী থেকে মৃণ্ময়ী ~ অর্ক চৌধুরী
20)           ভিন্নরূপে দেবী দুর্গা ~ দেবযানী বসু
21)            দেবী দুর্গা’র রূপবৈচিত্র্য: একালের প্রেক্ষাপটে ~ প্রশান্ত দাঁ

মা দুর্গাকে নিয়ে আরও ভালোভাবে জানার জন্য এদের চেয়েও বেশি তথ্যনিষ্ঠ ও বিশ্লেষণাত্মক বই থাকতেই পারেতবে এই পথে হাঁটা শুরু করে অনেকদূর এগোনোর মতো পাথেয় এদের মধ্যে আপনি পেয়ে যাবেন – এ-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত
পুজো খুব-খুব ভালো কাটুক

Wednesday 6 February 2019

অযুক্তি, না-তক্কো, ও হয়তো-গপ্পো


সব দোষ রাজা ভট্টাচার্য-র।
গতকাল এই মানুষটির সঙ্গে আড্ডা মারার ফাঁকে অরণ্যমন-এর স্টল থেকে বেরিয়ে চলে গেছিলাম বইমেলার আরেক মাথায় লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে। এরপর যা হয়। বাঁশবনে ডোম কানা হওয়ার মতো করে চারদিকে পত্র-পত্রিকার বিশাল সম্ভার দেখে আমি কেমন একটা দিশেহারা হয়ে গেলাম। এদিক-ওদিক ঘোরার ফাঁকে একটা ছোট্ট স্টলে ক’জন প্রবীণ মানুষকে একটা পত্রিকা নিয়ে বসে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম।
কেন?
কারণ তাঁদের সামনের টেবিলে রাখা ছিল ‘উন্মুক্ত উচ্ছ্বাস’ নামক একটি পত্রিকা-র ২০১৯ বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যা, যার প্রচ্ছদে বড়ো-বড়ো করে লেখা ছিল ‘রাজধানী দিল্লির নিজস্ব সাহিত্য পত্রিকা’। ইন্দ্রপ্রস্থের বাসিন্দা বাঙালিদের সাহিত্যচর্চার ওপর আমার সবিশেষ দুর্বলতা আছে। দেরি করা গেল না। মোটাসোটা সংখ্যাটা নিয়েই নিলাম। তারপর উদ্দেশ্যহীন কিঞ্চিৎ ঘোরাঘুরির পর পত্রিকাটা খুলে পড়তে শুরু করলাম। গল্প-কবিতা নিয়ে কিছু বলব না। সূর্য সেন-এর জীবন নিয়ে একটা আবেগজর্জরিত গল্প পড়েই মাথায় এক টন প্রশ্ন উদয় হল, যেগুলো নিয়ে পরে ঐশীকে জ্বালাতে হবে। কিন্তু আসল গুঁতোটা খেলাম পত্রিকার মূল অংশটি পড়তে গিয়ে, যা নিবেদিত হয়েছে এই সংখ্যার কেন্দ্রে থাকা মানুষটির জীবন ও কাজের নানা দিক নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনায়।
মানুষটি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।


বিদ্যাসাগর আমাদের কারও কাছে অজানা নন। আমার মতো গোদা লোকও তাঁকে নিয়ে একটা ছোটোখাটো রচনা লিখে কুড়িতে এগারো তুলে ফেলতে পারবে। তবু, নতুন করে মানুষটির কীর্তি, বিশেষত যে সাংঘাতিক বাধা ও শত্রুতা ঠেলে তাঁকে প্রতিটি ক্ষেত্রে এগোতে হয়েছিল তা পড়ে আমার আবার তব্দা লেগে গেল। কিন্তু মানুষটি এই হারকিউলিস-সম সংগ্রাম করে যা-যা আদায় করেছিলেন, তাদের বর্তমান অবস্থা কেমন?
আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে চলে যাওয়া মানুষটির অবিস্মরণীয় সিনেমাগুলোতে বহু মণিমুক্তো আছে। তাদের মধ্যে বাঙালি একটিকেই মিমযোগ্য বলে আঁকড়ে ধরেছে। সেটি অনুযায়ী যদি ভাবেন, বিশেষত ভাবা প্র্যাকটিস করাটা চালিয়ে যান, তাহলে দেখবেন~ নারীশিক্ষা তথা প্রাথমিক ও বুনিয়াদি স্তরের যথাসম্ভব মানুষের মনে সরল ও শুদ্ধভাবে মাতৃভাষা চর্চার স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেওয়ায় বাংলার অবস্থা এখনও শোচনীয়।
অথচ, আমরা আজও তাঁর মতো আরেকটি মানুষকে খুঁজে চলেছি। বিদ্যাসাগরের মতো, রামমোহনের মতো, দ্বারকানাথের মতো... কেউ তো আসুক! কোনো আলোর পথযাত্রী ঘর বাঁধুক এই অন্ধকার বালুচরে। ঈশ্বরের অবতার নয়, বরং এঁদের পুনর্জন্মের আশা বা খ্বোয়াইশ নিয়ে বাঁচি আমরা অনেকেই, তাই না? কিন্তু সে-সব ভাবতে গিয়েই আমার একটা কবিতার কথা মনে পড়ে গেল। কবিতাটা শেষ অবধি যেখানে পেলাম সেই সূত্রের শুদ্ধতা নিশ্চিত নয়, তাই ভুল থাকলে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

নচিকেতা
কেন ফিরে আস বার-বার?
স্মৃতির তুষার থেকে কেঁদে এসে শীতের তুষার
কেন হেঁটে পার হতে চাও?
এমন নির্জন রাতে সেই ভয়ে নক্ষত্র উধাও
অনন্ত আকাশ থেকে, সে-নির্মম মেঘের কুয়াশা
কোন্‌ সুখে বুকে টানো? এ-নরকে কীসের প্রত্যাশা?

তুমি কি জান না; যারা আসে
আকণ্ঠ পিপাসা নিয়ে সূর্যহীন এ সৌর আকাশে
চারদিকের মৃত গ্রহদের
কবর, প্রস্তর ভেঙে আসে; তারা নিজেরই রক্তের
পিপাসায় জ্বলে। কোনোখানে নেই একফোঁটা জল;
দীর্ঘশ্বাসে দ্বিখণ্ডিত এ মাটির অশ্রুই সম্বল।

কেন তবে সব ভুলে যাও?
এ-প্রেতপুরীর বুকে মুখ রেখে কোন্‌ সুখ পাও?
আসমুদ্রহিমাচল এই মহাশূন্যের কান্নায়
কেবল পশুর নখ দাগ কাটে; বিষাক্ত হাওয়ায়
সাপের খোলসগুলি ভাসে শুধু; আর
দিনরাত্রির বুকফাটা ‘নেই, নেই, নেই’-এর চিৎকার।

সে চিৎকারে স্বর্গ-মর্ত্য টলে
পাথরও চৌচির হত ভারতবর্ষের বন্ধ্যা পাথর না হলে।
জঠরের অসহ্য ক্ষুধায়
ধূমাবতী জন্মভূমি সন্তানের দুর্ভিক্ষের ভাত কেড়ে খায়,
এ-কী চিত্র! নরকের সীমা
চোখ অন্ধ করে দেয়, মুছে নেয় চেতনার সমস্ত নীলিমা।

তাই নিয়ে নচিকেতা, তবু তুমি গড়বে প্রতিমা?
অন্ধ হবে, বোবা ও অধীর
তবু ক্লান্তিহীন, মৃত্তিকায় পুনর্জন্মের অস্থির
জিজ্ঞাসায় মৃত্যুর তুষার
বার-বার হেঁটে হবে পার?
অগ্নিদগ্ধ দুই হাতে কতবার খুলবে তুমি যমের দুয়ার?
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

মেলার শেষ চারটে দিন অক্ষরের উৎসবের পাশাপাশি আগুনের পরশমণি হয়ে উঠুক আপনাদের সবার কাছে। ভালো থাকুন।