Thursday 26 October 2017

আলোহান: একটি রূপকথার জন্ম



বিভা পাবলিকেশন থেকে সদ্য প্রকাশিত, রনিন লিখিত, ১২৮ পৃষ্টার, ১৪৪/- টাকা দামের এই পেপারব্যাক উপন্যাসটি নিয়ে কিছু লেখার আগে বইটির মুদ্রণ নিয়ে লিখতেই হচ্ছে।

সুমন্ত মল্লিক-এর অসামান্য প্রচ্ছদে শোভিত, আপাতভাবে সুমুদ্রিত এই বইটিতেও বিভা পাবলিকেশন-এর যাবতীয় দুর্বলতা, কিছু কম হলেও, প্রকট হয়েছে। রয়েছে বিস্তর বানান ভুল, এবং মোক্ষম টাইপো।
এই অবধারিত দুর্বলতাগুলো ছাপিয়ে মূল গল্পের কথা ভাবলে বইটা কেমন লাগে?

“আমাদের এই বইয়ের কাহিনি এমন এক সময়ের, এমন এক পৃথিবীর, যেখানে চলছে ঘোর দুর্দিন”।
আমি জানি আপনি কী ভাবছেন। মানুষ বাঘ-ভালুকের হাত থেকে বাঁচার, আর দু’মুঠো খেয়ে গুহার ভেতরে লুকোনোর ব্যবস্থা করার পর থেকেই নিজের আশপাশের দুনিয়াটা সম্বন্ধে এই কথাটা ভেবে আসছে, তাই না?
সভ্যতার ঊষালগ্নেও সাহিত্য বলতে যা রচিত হয়েছে তাতে মানুষের বিশ্বাস উৎপাদন করার জন্য, তার সাহসের মরুভূমিতে এক চিলতে সবুজ লালনের আশায় এমন পটভূমি তৈরি করা হয়েছে, যেখানে নায়ক (ও তার সঙ্গীদের) যেতে হয় এক দুরূহ যাত্রায়। আজও এমন লেখা হয়, শুধু তাকে আমরা ধর্মগ্রন্থ না বলে ফ্যান্টাসি বলি।
আলোচ্য বইয়েও খুব সহজ, কবিতার হালকা স্পর্শমাখা গদ্যে বলা হয়েছে এমন এক পৃথিবীর কথা, যেখানে দেবতাদের ক্ষমতালোভী যুবরাজের খেয়ালে পৃথিবী ধ্বংস হতে বসেছে। উজাড় হয়ে আসা পৃথিবীর এই ধুলোখেলায় অসহায় ক্রীড়নক হয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে মত্ত, বা লুট-তরাজের মাধ্যমে অবশিষ্ট মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে পশুর অধম হয়ে পড়ছে মানুষ।
একটি ছেলে ছাড়া।
নিজের পরিবার, নিজের ভালোলাগা, সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে সেই ছেলেটি। তাকে যেতে হবে বহু-বহু দূরে, যেখানে আছে এক মিনার, যার কাছে নাকি দেবতাদের দেখা মেলে।
নিষ্করুণ মরুভূমি, হিংস্র ও প্রতিহিংসাপরায়ণ দস্যুদল, মাটির নিচের বাসিন্দা ‘নরমাংসভোজী’ মানুষেরা, তুষারের ঝড়, ঈর্ষাকাতর দেবতার পাঠানো একের পর এক টোপ বা মৃত্যুবাহী ছোবল, এইসব অতিক্রম করে ছেলেটি কি পৌঁছতে পারবে সেই মিনারের কাছে?
কেউ কি থাকবে তার সঙ্গে শেষ অবধি?
কী হবে তার এই যাত্রার শেষে?
সুধী পাঠক মাত্রেই জানেন, শুধু একটি ‘কোয়েস্ট’ বা একটি চরিত্রের দুঃসাহসিক প্রয়াস কখনোই ফ্যান্টাসির উপজীব্য হয় না। এই বইয়েও লেখক দক্ষতার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন জীবন সংগ্রামের সার সত্য: বিপদে হাল না ছেড়ে বরং নিজের দেহ ও মনকে মজবুত করে প্রত্যাঘাত করতে হয়। তার সঙ্গেই এসেছে আমাদের অতি পরিচিত মহাকাব্যে পড়া পুত্রস্নেহ ও রাজকর্তব্যের দ্বন্দ্ব। এসেছে বিশ্বাসে ভর দিয়ে কতটা পথ চলা যায়, সেই প্রসঙ্গ।
তা বলে লেখাটা কি নিখুঁত? মোটেই নয়। এদের যে দুর্বলতাগুলো আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেগুলো হল:
(১) সবকিছু ঘটেছে ভীষণ সরলরৈখিক পথে।
(২) সব চরিত্র, বিশেষত খল চরিত্ররা এতটাই একমাত্রিক যে তারা মনে দাগ কাটতে পারে না।
(৩) ডিস্টোপিয়ান পৃথিবীতে সবচেয়ে আগে বিপন্ন হয় যে ইউনিটটি, সেই সংসারের বাঁধন একেবারে অটুট রেখে দিয়েছেন লেখক, যা অসম্ভাব্য।
(৪) লেখার শেষটায় বড়ো বেশি ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’ ভাব এসে গেছে, যেটা টোকিয়েন ও অন্যান্য কিংবদন্তি সাহিত্যিকের লেখায় দেখা যায় না।
কিন্তু তাও, সব মিলিয়ে, খুব সহজ ভাষায়, মূলত ইয়ং অ্যাডাল্ট বা কিশোর পাঠকদের জন্য লেখা এই ফ্যান্টাসিটি পড়লে দুটো কারণে আশাবাদী হওয়াই যায়:
১. এক নতুন লেখকের অনাড়ষ্ট কলমের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় হল এই বইয়ের মাধ্যমে।
২. এই মুহূর্তে বাংলায় ছোটোদের জন্য বিবেক কুণ্ডু-র লেখায় বুমবুম সিরিজ, এবং বড়োদের জন্য কল্পবিজ্ঞানের মোড়কে মল্লিকা ধর-এর কিছু লেখা ছাড়া ফ্যান্টাসি তেমন নেই। ওপার বাংলায় শরীফুল হাসান তাঁর অসামান্য “সাম্ভালা” ট্রিলজিতে একই সঙ্গে এনেছিলেন মিথ, হরর, থ্রিলার, কোয়েস্ট, এবং ফ্যান্টাসির ক্লিফনোটস কৃত সংজ্ঞার বাস্তবায়ন (ফ্যান্টাসি ফিকশন হল এমন এক জঁর যাতে বর্ণিত ঘটনাবলি কখনোই বাস্তবে সম্ভবপর নয়)। আলোচ্য উপন্যাস সেই স্তরে পৌঁছতে পারেনি, হয়তো পৌঁছতে চায়ওনি। কিন্তু আগামী দিনে সুযোগ পেলে লেখক তাঁর কল্পনাশক্তি এবং সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে নিঃসন্দেহে আমাদের আরো ব্যাপক, আরো গভীর, আরো ধারালো লেখা উপহার দেবেন।
অন্তত এটাই আমার বিশ্বাস।
পাঠ শুভ হোক।

Sunday 22 October 2017

অনীশ দেব চরণকমলেষু, এবং সবুজের অভিযান



পাঠকের কাছে রহস্য কাহিনির আকর্ষণ ঠিক কোথায়?
ঊনবিংশ শতকে ছাপার খরচ কমে যাওয়ায়, এবং সাক্ষরতার হার বেড়ে যাওয়ায় পশ্চিমে পত্র-পত্রিকার সংখ্যায় কার্যত বিস্ফোরণ ঘটে। তখনই সম্পাদকেরা বোঝেন যে পাঠকদের টেনে রাখার জন্য তাঁদের দরকার এমন ধরনের লেখা যাকে ইংরেজিতে বলে সেনসেশনাল, আর হিন্দিতে সনসনিখেজ! বাংলায় এই শব্দটির নিকটতম প্রতিশব্দ বোধহয় রোমাঞ্চকর।

আলেকজান্দার দুমা থেকে জুল ভের্ন হয়ে এই ঘরানা ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে ঢোকেচার্লস ডিকেন্স-এর চেয়েও উইলকি কলিন্স এটির প্রয়োগ করতে বেশি সফল হন। ইতিমধ্যে আটলান্টিকের অন্য দিকে একটি মানুষ আধুনিক ইংরেজিতে গথিক বা ভয়াল রসের সাহিত্যের সূচনা করার পাশাপাশি গোয়েন্দা গল্পেরও গোড়াপত্তন করেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই এডগার অ্যালেন পো প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক ও সমালোচক মহলে সম্ভ্রমের বদলে নাসিকা-কুঞ্চন উৎপাদনেই সফল হয়ে অকালে প্রয়াত হয়েছেন।
আমেরিকা ও ইউরোপ, দু’জায়গাতেই পেনি ড্রেডফুল জাতীয় পত্রিকা ও বই এরপর দারুণ জনপ্রিয় হয়। সাহিত্য নিয়ে এই পত্রিকাগুলোর কোনো মাথাব্যথা ছিল না। এদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল অপরাধের কথা বলে, ও সেই নিয়ে পুলিশি অনুসন্ধানের মোড়কে সমাজের উঁচু ও নিচু তলার মানুষদের নানাবিধ কেচ্ছা যথাসম্ভব রগরগে ভাষায় রঙ চড়িয়ে লিখে টু পাইস কামানো। অনেক কলমচিই এই ধারায় ‘লেখালেখি’ চালাতে উৎসাহ হয়েছিলেন
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর কলকাতায় রহস্যরোমাঞ্চ কাহিনির আবির্ভাব এই সময়েই।
ঠগীদমনের ফলে খ্যাত ও শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে গণ্য উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান-এর অধীনে দারোগা বরকতউল্লাহ-এর কার্যকলাপ ‘বাঁকাউল্লার দপ্তর’ তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল, যদিও তার প্রেরণা ছিল ফ্রান্সের গোয়েন্দা ভিডকের স্মৃতিচিত্রণ, যা সমকালীন ইউরোপ জুড়ে আগ্রহ ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। এরই মাঝে, পেনি ড্রেডফুল ঘরানার নির্ভুল আত্তীকরণ তথা বঙ্গীকরণ করে ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়-এর “হরিদাসের গুপ্তকথা” নানা নামে ও রূপে প্রকাশিত হয় ১৮৭০ থেকে ১৮৭৯ সাল অবধি। ১৮৮৮ সালে গিরিশচন্দ্র বসু ডাকাতি তথা অন্যান্য অপরাধ দমনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন ‘সেকালের দারোগার কাহিনি’।

রহস্য কাহিনি বলতে আমরা যা বুঝি সেটা হয়তো এভাবেই চলত, কিন্তু অবস্থাটা হঠাৎ বদলে গেল। শিল্প-বিপ্লবের ফায়দা তোলা ও সাম্রাজ্যবিস্তারের মাধ্যমে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা দেশটির রাজধানীতে এমন একঝাঁক খুন হল, বীভৎসতা ও দুর্বোধ্যতায় যাদের জুড়ি মেলা ভার।
১৮৮৮ সালের ৩১শে অগস্ট, ৮ই সেপ্টেম্বর, ৩০শে সেপ্টেম্বর (দু’বার!), এবং ৯ই নভেম্বর। লন্ডনের হলদেটে কুয়াশায় ভেজা স্যাঁতসেঁতে রাতে, হোয়াইটচ্যাপেল-স্পিটালফিল্ডস এলাকার পাঁচজন মহিলা, যারা প্রত্যেকেই ছিল দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টির শিকার, মদের খরচ তোলার জন্য যাদের ক্যাজুয়াল প্রস্টিট্যুশন (মাফ করবেন, এই শব্দবন্ধের যথাযথ বাংলা আমার জানা নেই)-এর রাস্তা বেছে নিতে হয়েছিল, আক্ষরিক অর্থেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল এক অজানা আততায়ীর ছুরিতে।
অজানা, কারণ লন্ডন, ইংল্যান্ড, ইউরোপ হয়ে সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই খুনিকে পুলিশ ধরতে পারেনি। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছিল জ্যাক দ্য রিপার নামে কুখ্যাত সেই খুনি। সিরিয়াল কিলার তার আগেও এসেছিল, পরেও এসেছে অনেক। কিন্তু রিপার কিলিংস আক্ষরিক অর্থেই ইতিহাস গড়েছিল।
কেন?
হঠাৎ প্রশাসন, পুলিশ, খবরের কাগজের এক-একটি সংস্করণ প্রকাশের ঘন্টাখানেকের মধ্যে কিনে ফেলা পাঠকেরা, এবং তাদের তথা বাজারের গতিপ্রকৃতি বুঝতে সদা সচেষ্ট প্রকাশনা শিল্প দুটো জিনিস বুঝতে পারল।
প্রথমত, ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ দিয়ে সব হত্যার নাগাল পাওয়া শক্ত। মানুষের মন সরলরেখায় চলে না, আর সেজন্যই খুনিকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করেও সন্দেহভাজনদের লম্বা তালিকা ছাড়া কিছুই জোগাড় করে উঠতে পারেনি পুলিশ বা প্রেস।
দ্বিতীয়ত, সব অপরাধের সমাধান করার ক্ষমতা, বা দক্ষতা পুলিশেরও নেই! রাষ্ট্র এই ধারণাটির স্বীকৃতি দেওয়ার আগেই পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝলেন এক মার্কিন প্রকাশক। পোর্টসমাউথে বসে পশার জমানোয় ব্যর্থ এক চিকিৎসক-এর লেখা একটি উপন্যাস ১৮৮৭-র ‘বিটন’স ক্রিসমাস অ্যানুয়াল’-এ প্রকাশিত হয়েছিল ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’ নামে। বই হয়ে বেরোনোর পরেও তেমন একটা মারমার-কাটকাট জনপ্রিয়তা পায়নি লেখাটা, কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম পেশাদার কনসাল্টিং ডিটেকটিভের আবেদন বুঝতে সাগরপাড়ের মানুষটির দেরি হয়নি। অতঃপর লেখকের সঙ্গে চুক্তি, সাউথ সি-তে নিজের ফাঁকা চেম্বারে বসে আর্থার কোনান ডয়েল-এর কলম সঞ্চালন, ফেব্রুয়ারি ১৮৯০-এ ‘লিপিনকট’স ম্যাগাজিন’-এ প্রকাশিত “দ্য সাইন অফ ফোর” নামক উপন্যাসে শার্লক হোমস নামক মানুষটির পুনরাবির্ভাব
বাকিটা ইতিহাস।
অ্যালান মুর তাঁর ‘ফ্রম হেল’ উপন্যাসে দাবি করেছেন, তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় পরস্পরবিরোধী অজস্র টানাপোড়েনের ফলে জ্যাক দ্য রিপারের মতো এক খুনির আবির্ভাব অবধারিত ছিল, যেমন অনিবার্য ছিল বিংশ শতকে অ্যান্টি-সেমিটিক ধ্যানধারণার প্রসারের ফলে হিটলারের উত্থান। অন্তত রহস্যরোমাঞ্চ সাহিত্যের ইতিহাস দেখলে এই কথাটা প্রমাণিত হয়, কারণ সমাজের দর্পণ হিসেবে সাহিত্য মানুষের ভয়ের জায়গাগুলো সব সময় ছুঁয়ে যেতে চায়। তাই বিংশ শতকেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ারের নারকীয়তা আর বিষাক্ত গ্যাসের ধোঁয়া পাওয়া যায় দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝে বিভিন্ন রহস্য কাহিনিতে খুনের উপকরণ হিসেবে বিষের ব্যবহারে। আমেরিকায় সমৃদ্ধি আর তার পরের ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’-এর প্রতিধ্বনি শোনা যায় এলেরি কুইনের হাস্যরস মিশ্রিত বুদ্ধিদীপ্ত গোয়েন্দা গল্পের যুগাবসান হয়ে ড্যাশেল হ্যামেট ও রেমন্ড শ্যান্ডলার-এর হার্ড বয়েল্ড ঘরানার অভ্যুদয়ের মাধ্যমে। এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর ঠাণ্ডা লড়াই তার লম্বা ছায়া ফেলে জেমস বন্ড থেকে ব্যাটম্যান, স্পেন্সার থেকে অ্যালেক্স ক্রস, এই সব রকমের গোয়েন্দার কীর্তিকলাপে।

বাংলায় রহস্যরোমাঞ্চ নিয়ে জনপ্রিয় ‘সাহিত্য’ রচনার ক্ষেত্রে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়-এর ‘দারোগার দপ্তর’-কে পথিকৃৎ বলা চলে। ১৮৯৩ সালে প্রথম খণ্ড প্রকাশের পর থেকেই বেস্টসেলার হয়ে যায় বইটি। কিন্তু এরপর আর পুলিশি গোয়েন্দাদের কেন্দ্রে রেখে বাংলায় বেশি লেখালেখি হয়নি। বেকার স্ট্রিটের খড়্গনাসা পাইপমুখো নিঃসঙ্গ গোয়েন্দাটির ধাঁচেই সেই সময়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক পাঁচকড়ি দে ১৮৯৯-এ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ‘মায়াবিনী’-তে আনেন গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয়-কে।
১৩০৬ বঙ্গাব্দে গোয়েন্দা গল্প লিখে কুন্তলীন গল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পান রজনীচন্দ্র দত্ত। দ্বিতীয় স্থানাধিকারী দীনেন্দ্রকুমার রায় পরবর্তী কালে তাঁর প্রটাগনিস্ট রবার্ট ব্লেক-কে কেন্দ্রে রেখে প্রচুর রহস্য গল্প লেখেন। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য-র হুকাকাশি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ঘরানার রহস্যভেদী হলেও হেমেন্দ্রকুমার রায়-এর জয়ন্ত (সঙ্গে মানিক ও সুন্দরবাবু) মোটামুটি হোমসীয় ধারাকেই অব্যাহত রাখে। তারপর, ‘মাসিক বসুমতী’ পত্রিকার মাঘ ১৩৩৯ সংখ্যায় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়-এর “পথের কাঁটা” গল্পে আত্মপ্রকাশ করে বাঙালির একান্ত নিজস্ব সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী।
ব্যোমকেশের কাহিনিগুলোয় চোর-পুলিশ খেলা, বা অপরাধী ও সত্যান্বেষীর মধ্যে ক্যাট অ্যান্ড মাউজ গেম-এর বদলে সমাজজীবনের সংকটগুলো ফুটে ওঠে স্পষ্ট ভাবে, অনুপম ভাষায়। শরদিন্দু সচেতনভাবে লেখাগুলোতে এক বৌদ্ধিক ব্যাপ্তি দিতে চেয়েছিলেন বলেই হয়তো ব্যোমকেশের গল্পগুলো এই বদলে যাওয়া সময়ে, যখন প্রাইভেট ডিটেকটিভ ধারণাটাই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, এবং সারভেইল্যান্স নামক বস্তুটির মাধ্যমে রাষ্ট্র বিগ ব্রাদার হয়ে আমাদের জান-মালের দায়িত্ব নেওয়ার নামে ঢুকে পড়ছে ঘরের কোণে, দারুণ ভাবে জনপ্রিয় রয়ে গেছে।

তাহলে, এই সময়ের এক নতুন লেখক যখন রহস্যকাহিনি লেখেন, তখন তাঁর লক্ষ্য কী হয়? এলেরি কুইন স্টাইলে ফেয়ার প্লে মিস্ট্রি লেখা, যেখানে সব ক্লু দেওয়া থাকে পাঠকের সামনে, আর তাঁকে চ্যালেঞ্জ করা হয় রহস্যটি সমাধান করার জন্য?
হোমস ঘরানার সঙ্গে অ্যাকশন মিশিয়ে, অর্থাৎ ১৯৬৫-৬৬-তে ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ ও ‘বাদশাহি আংটি’-তে প্রতিষ্ঠা করা শ্রী প্রদোষ চন্দ্র মিত্র-র গল্পগুলোর ধাঁচে নারীচরিত্র-বর্জিত শিশুপাঠ্য গল্প লেখা?
ব্যোমকেশের মতো এক সত্যান্বেষী নির্মাণ করা, যার চোখে ধরা পড়বে সমাজের ফাটলগুলো, যার বুদ্ধির ছটায় ছিন্নভিন্ন হবে সংস্কার আর উপেক্ষার মাকড়সার জাল?
নাকি তিনি আনবেন এক আউটসাইডার-কে, যাঁর বুদ্ধির দীপ্তি পুলিশকে সাহায্য করবে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে?
একথা বুদ্ধিমান মাত্রেই মানবেন যে আজকের সক্রিয় মিডিয়া এবং আইনি জটিলতা অধ্যুষিত সময়ে শেষেরটিই একমাত্র পথ। অপরাধ নিয়ে মাথা ঘামানোর ব্যাপারে পুলিশ, সি.বি.আই, ল’ইয়ার, এঁরা ছাড়া আর কারো অধিকার স্বীকার করে না রাষ্ট্র।
বাংলায় রহস্যরোমাঞ্চ সাহিত্যের কম্পমান শিখাটিকে দীর্ঘদিন নিজের দু’হাতের মাঝে সযত্নে লালন করেছেন যে অনীশ দেব, আজ তাঁরই জন্মদিন। তিনি যে সীমিত সংখ্যক গোয়েন্দা গল্প লিখেছেন, তাতেও রহস্যভেদে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন অধ্যাপক অশোক চন্দ্র গুপ্ত, তথা এ.সি.জি, যিনি তাঁর ছাত্র, বদরাগি পুলিশ অফিসার রঘুপতিকে সাহায্য করেন নানা অপরাধের কিনারা করে অপরাধীর বিরুদ্ধে কাস্ট-আয়রন কেস সাজাতে।
কাকতালীয় হলেও এটাই সত্যি যে আজ আমি মনোরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা যে রহস্যকাহিনির সংকলনটি পড়লাম, সেই “শোণিত ধারায় সাত”-এর সাতটির মধ্যে ছ’টিতেই রহস্যভেদীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন রসায়নের অধ্যাপক সুদর্শন ভট্টাচার্য।
কিন্তু বইটা হয়েছে কেমন?

বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক স্বজনপোষণ এবং ভাড়াটে সমালোচকদের অভিমতের দুষ্টচক্রকে তুশ্চু করে নতুন লেখকদের আত্মপ্রকাশের মঞ্চ গড়ে দেওয়ায় বিরাট ভূমিকা নিয়েছে যে নতুন প্রকাশনা সংস্থাগুলো, তাদের মধ্যে বিভা পাবলিকেশন অগ্রগণ্য। এই সংস্থা থেকে প্রকাশিত বইপত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিনের। প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মতো ধারালো এবং প্রথা-বহির্ভূত বিষয় নিয়ে গল্প রচয়িতার দু’টি গল্প-সংকলন-ই প্রকাশ করেছে বিভা। গত বছরের সেরা থ্রিলার, এবং বাংলায় একান্ত বিরল ইতিহাস-আধারিত টেকনো থ্রিলার-এর একমাত্র সার্থক নিদর্শন, দেবারতি মুখোপাধ্যায়-এর “ঈশ্বর যখন বন্দি”-ও প্রকাশ করে বিভা-ই। তাই তুলনামূলক ভাবে নবীন গল্পকার মনোরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়-এর সাতটি রহস্য গল্পের সংকলন যখন বিভা থেকেই প্রকাশিত হয়, তখন বইটি নিয়ে আমার প্রত্যাশা ছিল বিপুল।
কিন্তু বইয়ের গল্পগুলো নিয়ে আলোচনার আগে, যে খারাপ জিনিসগুলো আমাকে পদে-পদে দস্তুরমতো কষ্ট দিয়েছে, সেগুলোর কথা আগে লিখি: -
১. প্রত্যেক পাতায় অন্তত গোটা পাঁচেক ছাপার এবং/অথবা বানান ভুল।
২. ‘ওনার’/’উনার’-এর মতো অশুদ্ধ অভিব্যক্তিতে লেখাগুলো বোঝাই থাকা।
৩. কোথায় ‘ওঁর’ হয়, আর কোথায় ও’র হয়, সেই ধারণা না থাকা।
৪. অভিভাবকদের কথাবার্তা প্রসঙ্গে আপনি/উনি আর তুমি/সে গুলিয়ে ফেলা।
৫. ফরম্যাটিং-এর সময় রহস্যকাহিনির উপযোগী ছোটো-ছোটো অনুচ্ছেদে লেখাকে না ভেঙে একটানা লিখে যাওয়া, যার ফলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পাঠকের কাছে বিরক্তিকর ঠেকবে।
৬. অপ্রয়োজনীয় কথা, বিশেষত কেন্দ্রীয় চরিত্র কী করেন ও কেন করেন সেটা প্রত্যেক গল্পে ফলাও করে, বার-বার বলা।

এবার আসি গল্পগুলোর কথায়। সূচিপত্র অনুযায়ী নয়, বরং গল্পগুলো আমি যেভাবে পড়েছি সেইভাবেই লিখছি।
(১) অতীতের অস্ত্রোপচার: ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকায় জুলাই ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত এই গল্পটি ‘ওল্ড সিনস কাস্ট লং শ্যাডোজ’ ধারণাটির সার্থক রূপায়ন। রহস্যভেদে কয়েকটা ফাঁক থাকলেও, এবং অপরাধী বেশ সহজেই চিহ্নিত হয়ে গেলেও গল্পটা টাইট, এবং সুখপাঠ্য।
(২) অপরিমেয়: ‘আনন্দমেলা’-তে জুলাই ২০১৭-তেই প্রকাশিত হয় এই গল্পটি। কিঞ্চিৎ কষ্টকল্পিত হলেও অংকের ব্যবহা এই গল্পকে এমন একটি মাত্রা দিয়েছে যে এটিকে এই সঙ্কলনের শ্রেষ্ঠ গল্প বলাই চলে।
(৩) আলোছায়া স্টুডিও: বুদ্ধিদীপ্ত এবং কিছুটা নন-লিনিয়ার ধাঁচে লেখা হলেও একে গোয়েন্দা গল্প নয়, বরং রহস্য গল্প বলাই সঙ্গত। তথ্যপ্রমাণের বদলে অনুমান-উপমানের সাহায্যে এই গল্প যেখানে গিয়ে থেমেছে, সেখান থেকে আইনের চোখে ধৃত সন্দেহভাজনদের শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবলে ‘হানোজ দিল্লি দূর অস্ত’ কথাটাই মনে আসে।
(৪) পুরাতন খেলা: এই গল্পেও রহস্য আছে। “ওয়ান্স ইউ এলিমিনেট দ্য ইম্পসিবল, হোয়াটেভার রিমেইনস, নো ম্যাটার হাউ ইমপ্রবেবল, মাস্ট বি দ্য ট্রুথ” ম্যাক্সিম মেনে তার একটা সমাধানও আছে। কিন্তু আইনের হাত এখানেও অপরাধীর নাগাল পায়নি।
(৫) দুই শতাব্দী পরে: অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে এই গল্পটি। একটু যত্ন নিয়ে, আরেকটু গবেষণা আর জায়গা নিয়ে লিখলে, সর্বোপরি দুই শতাব্দীতে আমূল বদলে যাওয়া ভূগোলের বাধা এড়িয়ে কীভাবে গুপ্তধন পুনরুদ্ধার সম্ভব তা বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে উপস্থাপন করতে পারলে এই গল্পটি প্রয়াত গবেষক চিত্রা দেব-এর সৃষ্ট গোয়েন্দা সঞ্জয়-এর ইতিহাস ও অপরাধ মেশানো রহস্যভেদের কাহিনি ‘সিদ্ধিদাতার অন্তর্ধান’ ও ‘রূপমতীর মালা’-র সার্থক অনুসারী হতে পারত।
(৬) লালবাবুর নাতনি: একটি উৎকৃষ্ট সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার হয়ে উঠতে পারত এই গল্পটি, যদি লেখক ফরম্যাটিং এবং অনুচ্ছেদ-বিভাজনের মাধ্যমে গল্পটাকে ক্লাস ইলেভেনের রচনার মতো করে না লিখে আরো গতিময়, আরো টানটান করে সাজাতেন।
(৭) ঘাতক সম্মেলন: আগাথা ক্রিস্টির ‘কার্ডস অন দ্য টেবল’-এর মতো একটা ছকে শুরু হয়েও গল্পটা নিছক রহস্যভেদের কাহিনি হয়নি, বরং অত্যন্ত বুদ্ধির সঙ্গে লেখক ছকটিকে কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করে মনস্তত্ত্বের একটি জটিল দিক তুলে ধরেছেন, যাতে ‘ক্রাইম ডাজ নট পে’ কথাটি ফুটে উঠেছে জোরালো আকারে।

সামগ্রিকভাবে আমি দু’টি মাত্র কথা বলতে পারি।
প্রথমত, এই সময়ের অত্যন্ত ব্যতিক্রমী একটি রহস্য কাহিনির সঙ্কলন হল এই বইটি। এর প্রতিটি গল্প অন্যের চেয়ে আলাদা। এদের পেছনে লেখকের ভাবনার যে স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য ধরা পড়েছে তা দস্তুরমতো ঈর্ষণীয়। এমতাবস্থায়, মাত্র ১৪৪ টাকা দামের এই বইটি কিনতে দ্বিধাবোধ করলে পাঠকের লোকসান।
দ্বিতীয়ত, বিভা পাবলিকেশন অবিলম্বে একজন পেশাদার কপি এডিটর নিয়োগ না করলে, এবং সেই এডিটর সংসদ বা আকাদেমির বানানরীতি বিষয়ে অভিজ্ঞ না হলে, আমি তো বটেই, অন্য পাঠকেরাও এই প্রকাশনাকে হাবিজাবি পাবলিকেশন নামে ডাকতে শুরু করবে।


পাঠ শুভ হোক।

Sunday 15 October 2017

পাহাড়ের মানুষ পাহাড়ের গল্প



  • বইয়ের নাম: পাহাড়ের মানুষ পাহাড়ের গল্প
  • লেখক: গৌতম চক্রবর্তী
  • প্রকাশক: দ্য কাফে টেবল
  • পেপারব্যাক, ১৩৬ পৃষ্ঠা, ১৫০/- টাকা
এক-একটা বইয়ের রিভিউ হয় না।
সেই বইয়ে আলাদা করে থাকে না কোনো নায়ক, প্রতিনায়ক, বা নায়িকা।
সেই বইয়ে তেমন কোনো গল্পও থাকে না আলাদা করে।
অথচ, তার পাতায়-পাতায় ছড়িয়ে থাকে জীবনের মহীরুহ থেকে ঝরে পড়া অনেক শুকনো পাতা, আর ভেজা গন্ধ।
তার দু’মলাটের মধ্যে ধরা থাকে অনেক হাসি আর হইচই-এর আওয়াজ, অনেক কান্নার শুকনো দাগ, অনেক স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার ব্যথা, অনেক না-বলা রোমান্স, অনেক-অনেক লড়াই।
আর দুর্জয় আশা।
কী বলা যায় তেমন বইকে?
দিনলিপি? রিপোর্টাজ?
অলীক কথন?
মাত্র ১৩৬ পৃষ্ঠার, দেড়শো টাকা দামের যে বইটি নিয়ে আজ লিখতে বসেছি, সেটি বোধহয় ওই শেষ বর্গে শামিল-যোগ্য।
কল্যাণ দাস-এর আঁকা পাহাড়ি কুয়াশার মতো আধেক জমাট, আধেক ধোঁয়াটে ছবিগুলোয় সাজানো, ছোটো-ছোটো ৩২টি ভিনিয়েট (vignette) নিয়ে গড়ে উঠেছে এই বইটি। এতে উঠে এসেছে পাহাড়ের মানুষের সরল, সৎ, পরিশ্রমী, কখনও-হার-না-মানা মনোভাব, তাদের জীবনসংগ্রামের বিচিত্র গল্পকথা, তাদের হার আর জিৎ।
তার সঙ্গেই, প্রতি পদে, এই লেখাগুলো বুঝিয়ে দিয়েছে, শহরের অর্থ আর আলোয় ঠাসা আমাদের জীবন আসলে কতটা ফাঁপা, আর ক্ষেত্রবিশেষে নিরর্থক।
সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো আকাশপানে চেয়ে থাকা ওই পাহাড়ের কোলে যারা থাকে, তাদের সঙ্গে আমাদের মিলের চেয়ে অমিল বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন, যখন সেই পাহাড়ে শান্তি রাখতে গিয়ে, কিছু লোভী আর ধান্দাবাজ মানুষের ক্ষমতার খেলায় বোড়ে হয়ে ঝরে যাচ্ছে অমিতাভ মালিকের মতো তাজা প্রাণ, তখন এই বইটাই আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে হল বড়ো বেশি করে।
ভীষণ সহজ ভাষায় আর ভঙ্গিতে লেখা, পাহাড়ের মানুষের এই চাওয়া-পাওয়া, আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্নভঙ্গ, হেরেও ফিরে আসার কথাগুলো পড়ে মনে হল, বারুদের গন্ধ বা রক্ত নয়, নীল আকাশের বুকে মাথা তোলা কাঞ্চনজঙ্ঘা আর সবুজের বুক চিরে ছুটে যাওয়া তিস্তা-রঙ্গিতের মাঝের পৃথিবীর মানুষগুলোকেই যেন আবার অনুভব করলাম।
ধন্যবাদ কাফে টেবল। আপনারা এগিয়ে না এলে আমরা এই সরল, নিরহংকার, অভিমানী লেখাগুলো ছাপার অক্ষরে পেতাম না।
শুধু পরের বার টাইপোগুলো শুধরে নেবেন। এমন গৈরিকবসন বইয়ে ওই মালিন্য মানায় না।

Wednesday 11 October 2017

বিন্দুবিসর্গ: রহস্যকাহিনির মোড়কে ইতিহাসের নতুন পাঠ


Ø বইয়ের নাম: বিন্দুবিসর্গ
Ø লেখক: দেবতোষ দাশ
Ø প্রকাশক: পত্র ভারতী
Ø প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৭
Ø পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৩৩৬, হার্ডকভার
Ø মূল্য: ৩৭৫/- টাকা

আচ্ছা বলুন তো, ‘বিন্দু’ মানে কী?
সাধারণত আমরা এই শব্দটিকে দু’রকম অর্থে ব্যবহার করে থাকি। প্রথমত, জলকণা বা ফোঁটা, বা সেই পরিমাণ স্থান অধিকার করে এমন অত্যল্প পরিমাণ বোঝাতে। দ্বিতীয়ত, জ্যামিতিতে স্থূলত্বদীর্ঘত্বহীন পদার্থ তথা পয়েন্ট বোঝাতে।
বাংলায় অভিধান তথা সুসংহত শব্দভাণ্ডার নির্মাণকে যদি মর্তে গঙ্গা আনয়নের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তাহলে ভগীরথ হলেন শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মহাগ্রন্থ “বঙ্গীয় শব্দকোষ” খুলে কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, ‘বিন্দু’ শব্দের শুধু বিশেষ্য রূপেরই আছে ১৭টি অর্থ তথা ব্যবহার, যার মধ্যে “ভ্রূদ্বয়ের মধ্য”, “মহাদেব”, এমনকি “নায়িকার ওষ্ঠে নায়ককৃত দন্তক্ষতবিশেষ”-ও আছে!
এবার দয়া করে বলুন, ‘বিসর্গ’ মানে কী?
আপনার কথা বলতে পারছিনা, তবে আমি ‘বিন্দুবিসর্গ’ নামক লব্জের বাইরে, আলাদা করে, এই শব্দটা ব্যবহার করিই না। “বঙ্গীয় শব্দকোষ”-এর পাতা উলটে দেখছি, এটিরও রয়েছে নানা অর্থ ও প্রয়োগ, যার মধ্যে আছে “অস্ত্রপ্রয়োগ”, “ত্যাগ”, “সৃষ্টি”, এবং “দক্ষিণায়ন”!
অথচ, ‘বিন্দুবিসর্গ’ শব্দের কিন্তু মাত্র একটাই মানে: অণুমাত্র
কেন?
আবার সেই “বঙ্গীয় শব্দকোষ” খুলেই দেখছি, বাংলা বর্ণমালায় বিসর্গের ঠিক আগে অবস্থিত ‘অনুস্বার’ ব্যঞ্জনবর্ণ হলেও ‘অ’-কারের মতো হ্রস্ব, এবং তাকে ‘বিন্দুরূপ’ বা ‘বিন্দুরেখারূপ’-এ প্রকাশ করা হয়। সেজন্যই কি, ‘বিন্দুবিসর্গ’ মানে যৎসামান্য?
আর তাহলে, একটু আগে লেখা দুটো শব্দ পাশাপাশি বসতে গিয়েই তাদের অর্থের বৈচিত্র্য বিসর্জন দিল কেন?

মহাজনেরা বলেছেন ভাবা প্র্যাকটিস করতে। যথারীতি আমরা, আর পাঁচটা হিতোপদেশের মতো, এটাকেও পাত্তা দিইনি। কিন্তু ভাবতে গেলে, বিশেষ করে আমাদের রোজকার ব্যবহারের এই দুঃখিনী বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার নিয়ে কিঞ্চিৎ মাথা ঘামালে চমকে উঠতে হয়।
এই নিয়ে পত্রিকায় প্রবন্ধ হলে সেটা আমাদের নজর এড়িয়ে যাবে।
এই নিয়ে ভেবে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর মতো গবেষক নিজের জীবনের দশকের পর দশক ব্যয় করলেও আমরা তাকে উপেক্ষাই করব, কারণ আমরা তাঁদের দিকেই তাকাই যাঁরা প্রথাগত অর্থে ‘সফল’।
যদি না
তাঁদের ভাবনাকে কেন্দ্রে রেখে তৈরি হয় এক প্রবল ঘূর্ণিঝড়।

আলোচ্য উপন্যাসটি আসলে বাংলা ভাষার হাত ধরে ভারতের ইতিহাস, পুরাণ, ধর্ম, সমাজ, এবং বর্তমান ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ রাজনীতিকে এক নতুন চোখে দেখার চেষ্টা।
কিন্তু ঠিক যে কারণে আপনি এনসাইক্লোপিডিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের আকর জেনেও নিতান্ত প্রয়োজন না হলে পড়েন না, সেই একই কারণে এই ‘বিকল্প’ দৃষ্টিপাতের অস্তিত্ব অনেক-অনেক দিন ধরে থাকলেও আমরা তা জানতে চেষ্টাও করিনি।
হয়তো সেজন্যই, কপিল মুনির আশ্রমে ছাই হয়ে পড়ে থাকা সগর রাজার ছেলেদের অভিশপ্ত ভস্মাবশেষের সঙ্গে তুলনীয় সেই অদ্বিতীয় কাজের ওপর পাঠকের আগ্রহের গঙ্গাকে বইয়ে দেওয়ার জন্য কলম ধরলেন এই সময়ের অন্যতম কুশলী নাট্যকার ও গদ্যশিল্পী, দেবতোষ দাশ। আর আমরাও পেলাম সৌজন্য চক্রবর্তীর দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে সমৃদ্ধ সুমুদ্রিত একটি হার্ডকভার, যা নিয়ে এই লেখা।

কিন্তু উপন্যাস লিখলেই তো আর পাঠকের আনুকূল্য পাওয়া যায়না। তাই দেবতোষ তাঁর কাহিনি নির্মাণ করলেন বাংলা সাহিত্যের নিরিখে এক অভিনব আঙ্গিকে। তিনি গল্পটিকে সাজালেন রহস্যকাহিনির কাঠামোয়, যেখানে গল্প শুরু হচ্ছে মাঝরাতে নিজের অফিসে এক গুণী, জ্ঞানী, ব্যতিক্রমী মিডিয়া ব্যারনের খুন হওয়া দিয়ে।
“ভোরের কাগজ” পত্রিকার সম্পাদক বিল্বদল বা বিলু চট্টোপাধ্যায়ের খুনের তদন্ত করতে গিয়ে কলকাতা পুলিশ এমন কিছু হেঁয়ালি বা ধাঁধার মতো সূত্র পায়, প্রথাগত ভাবে যাদের সমাধান করা অসম্ভব না হলেও সময়সাপেক্ষ। অতঃপর, মঞ্চে প্রবেশ আউট-অফ-দ্য-বক্স চিন্তায় সিদ্ধহস্ত ধরণী কয়াল, অর্থাৎ ডিকে-র।
ইতিমধ্যে খুনি, যে নিজের পরিচয় দিয়েছে ‘অদ্বৈত’ নামে, কিন্তু বসে নেই। নিজের প্রজ্ঞা, মেধা, মনন, ও ক্ষিপ্রতা কাজে লাগিয়ে সেও পুলিশের থেকে এক কদম এগিয়ে থেকে তার পরবর্তী শিকারের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। নিহত ব্যক্তির অন্যতম আস্থাভাজন সহায়িকা নিবেদিতাও কিন্তু নিশ্চেষ্ট হয়ে না থেকে খুনির পরবর্তী শিকার, গবেষক কবীর খানকে সঙ্গে নিয়ে ফেরার হয়েছে।
কিন্তু কেন এই খুন?
কে এই কবীর খান?
আর, তাঁকে বাঁচানোর জন্য নিজের প্রাণ বিপন্ন করে পুলিশ আর খুনির সঙ্গে কেন লুকোচুরি খেলছে নিবেদিতা?

এখানেই এই উপন্যাস ড্যান ব্রাউনীয় কন্সপির‍্যাসি থিওরি এবং প্রযুক্তি-সর্বস্ব কাঠামোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক পথে এগিয়েছে, যা আপাতভাবে থ্রিলার বা রহস্যকাহিনির ‘নিয়ম’ মেনে চলেনা, কিন্তু এই উপন্যাসে সমাজ ও ভাষা নির্মাণের যে কুটিল ও বন্ধুর চিত্র ফুটে উঠেছে তার সঙ্গে যার চলন আশ্চর্যরকম সাযুজ্যসম্পন্ন।
আগে লিখি কেন এই থ্রিলার আর পাঁচটা ফর্মুলাইক রহস্য উপন্যাসের চেয়ে আলাদা।
প্রথমত, এতে মাত্র একটিই খুন হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এখানে কিছু চেজ, কিছু সাসপেন্স-পূর্ণ মুহূর্ত, এবং একটি প্রক্ষিপ্ত মারামারি বা টানাহেঁচড়ার দৃশ্য ছাড়া কোনো অ্যাকশন নেই। প্রায় পুরো উপন্যাস জুড়েই রয়েছে প্রচুর মুখে-বলা বা ম্যাগাজিনে ছাপা কথা, যা চরিত্রদের মুখে বা মনে এসেছে আমাদের সুবিধার্থে, এবং যাদের পটভূমি হয়েছে এসি চেম্বার, ফোন, ট্যাক্সি, ট্রেনের কামরা, হোটেলের ডাইনিং টেবল।
তৃতীয়ত, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন হয়নি এখানে। সমকালীন রাজনীতি আমাদের সমাজের দেহে যে দগদগে ক্ষতস্থানগুলো লালন করে চলেছে, সেগুলোর কোনো ম্যাজিকাল বা ফাইনাল সলিউশনও দেওয়া হয়নি এই উপন্যাসে।
তাহলে একে থ্রিলার বলা চলে কি?
বৃক্ষের নাম যেমন ফল থেকে বোঝা যায়, তেমনই থ্রিলারের গুণাগুণ বোঝা যায় মাত্র একটি মাপকাঠিতেই: উপন্যাসটা পড়তে গিয়ে আনপুটডাউনেবল লেগেছে কি না। সেই বিচারে, কেমন লাগল বইটা?

সারাদিন অফিস আর সাইট ভিজিট করে যখন নিংড়ানো গামছার সঙ্গে সহমর্মিত্ব অনুভব করছি, তখন এই বইটা হাতে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, কয়েক পাতা উলটে দেখে নেব বইটা কেমন লাগছে, তারপর না হয় ধীরেসুস্থে পড়তে বসা যাবে। রাত দুটো নাগাদ লাল চোখে লাইট নেভাতে হল, কারণ পরদিন সকালে প্লেনে চড়ার ব্যাপার ছিল। ভোরবেলা সিকিউরিটি চেক হয়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আবার বইটা বেরোল ব্যাগ থেকে, এবং আশেপাশে কী হচ্ছে তার বিন্দুবিসর্গ না দেখে আমি আবার মজে গেলাম। অতঃপর প্লেনে বসা, সিটবেল্ট বাঁধা, এবং আবার পড়া শুরু। গন্তব্যে পৌঁছে, বেল্ট থেকে ব্যাগেজ নেওয়ার সময়টা রীতিমতো অস্থির হয়ে থেকে, অবশেষে ট্যাক্সিতে বসেই আবার বইটা হাতে নেওয়া, এবং স্রেফ তলিয়ে যাওয়া গল্পের মধ্যে।
যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে এই উপন্যাস।
অথচ, খুনি থেকে শুরু করে খুনের কারণ, সব আমাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন লেখক বই শুরুর মাত্র কয়েক অধ্যায়ের মধ্যেই!
তাহলে আমি বইটা শেষ না হওয়া অবধি ছাড়তে পারছিলাম না কেন?

উত্তরটা লুকিয়ে আছে এই বইয়ের মূল প্রতিপাদ্যে, অর্থাৎ এক অবহেলিত এবং বিস্মৃতপ্রায় তত্ত্বে, যা অনুযায়ী বলতে এবং মানতে হয় যে আমাদের সত্যিকারের ইতিহাস লুকিয়ে আছে আমাদের এই বাংলা ভাষায়।
নাগরিকতা ও পলিটিক্যাল কারেক্টনেস-এর যৌথ সম্মার্জনীর আঘাতে ঝেঁটিয়ে সাফ হওয়া ভাষায় নয়, বরং সেই ভাষায়, যাতে রচিত হয়েছিল কৃত্তিবাস ওঝা-র রামায়ণ, কাশীরাম দাশ-এর মহাভারত, যা আজও বহুলাংশে মহিলা, অন্ত্যজ ও অন্যান্য অন্তবাসীর মুখে জীবিত আছে।
প্রথমে নিহত বিল্বদল চট্টোপাধ্যায়-এর কথায়, পরে ডিকে-র পড়া কিছু লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রবন্ধে, সর্বোপরি অন্যান্য চরিত্রদের সঙ্গে ভাষা ও পুরাণ নিয়ে গবেষণায় ডুবে থাকা সাধক কবীর খানের আলোচনার সূত্রে এই ভাষা থেকে ভারতের, এমনকি গোটা পৃথিবীর তথা মানবজাতির যে ইতিহাস একান্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটে উঠেছে তা যুক্তিগ্রাহ্য হয়েও অবিশ্বাস্য। কেন তা অবিশ্বাস্য, বা কেন তা যুক্তিগ্রাহ্য, এগুলো লিখতে গেলে লেখাটা স্পয়লারে ভর্তি হয়ে যাবে বলে সেদিকে যাচ্ছিনা। শুধু এটুকু লিখছি যে কাহিনির শুরুতে যখন ভাষার শেকড় ধরে টান দিয়ে তুলে আনা কবীর খানের থিওরিগুলোর মুখোমুখি হচ্ছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, “সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে” টাইপের আরো একটা গাঁজাখুরি থিওরি প্রমাণে প্রাণপাত করা এক মানুষের করুণ অথচ হাস্যকর কথা শুনছি।
কারণ আমার দু’চোখের পেছনে ডান্ডা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল আমার পড়া ইতিহাস, আমার শেখা বিশ্বাস, আমার ভাবা রাজনীতি, যারা নতুন চোখে আমার নিজের ভাষাকে পড়তে দিচ্ছিলনা
কিন্তু তারপর, দেবতোষ তাঁর ধারালো কলমের সাহায্যে আমার মাথায় একটা লোবোটমি করে দিলেন। আর সঙ্গে-সঙ্গে শ্বাসরোধী অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরের জানলা ভেঙে ঢোকা সূর্যের আলোর মতো করে আমার অনুভবকে প্লাবিত করল এক নতুন জ্ঞান, এক নতুন বোধ।
আমার দুই ভ্রূর মাঝে একটা নতুন চোখ খুলে গেল!
আমি দেখতে পেলাম, স্কুলে-পড়ানো ইতিহাসের মর্মরবেদির তলায় লুকোনো এক ভয়ঙ্কর অন্যায় আর অপমানের জ্বলন্ত সত্যিকে, যাকে খবরের কাগজে বা টিভির পর্দায় কখনও-সখনো দেখলেও চোখজোড়া অন্যদিকে পিছলে নেওয়াতেই এতদিন অভ্যস্ত ছিলাম।
আমি শুনতে পেলাম কালের যাত্রার ধ্বনি, যেখানে আঁধারের চক্রে পিষ্ট তারার বুকফাটা কান্না হারিয়ে গেছিল বিজয়ীর আরোপিত নারকীয় বিভাজনে।

নিছক রহস্য উপন্যাস নয়।
নয় কোনো হু বা হাউ বা হোয়াই ডান-ইট।
নয় কোনো রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা, বা ফেসবুক গরম করা ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষ (তিলে-সেকু-মাকু) বনাম মৌলবাদী (চাড্ডি) চাপান-উতোড়।
এই উপন্যাস আমাদের বাঙালি হিসেবে ভাষাগত উত্তরাধিকার নিয়ে গর্বিত হওয়ার পাশাপাশি ভবে হওয়া নশ্বর মানবজনমকে সার্থক করে তোলার নতুন পথের সন্ধান দেয়।
এই উপন্যাস অজস্র আরোপিত এবং বহুপ্রচারে সত্য বা পোস্ট-ট্রুথ হয়ে ওঠা নির্জলা মিথ্যাকে চিনে নিতে সাহায্য করে।
সর্বোপরি, “ফুল খেলিবার দিন নয় অদ্য” বলেও এই উপন্যাস আমাদের বলে, এখনও মানুষের মধ্যে আছে স্বাভিমান প্রতিষ্ঠার মনোবল, আছে সততা, আছে জ্ঞানপিপাসা, আছে বিশ্বাসের অন্ধত্ব ঘোচানোর ইচ্ছে, এবং আছে দুর্জয় সাহস।

এই উপন্যাস শুধুমাত্র জঁর ফিকশনের ক্ষেত্রে নয়, বরং বাংলা ভাষা ও শব্দতত্ত্বের ইতিহাসে একটি দিকচিহ্ন হয়ে থাকবে তার এই ভুবনপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য, যা এই বইকে খুন-খারাপি-সাসপেন্স-চেজ ইত্যাদির দ্বারা সীমাবদ্ধ মর্ত্যের দ্রুতগতি নদীর চেহারা থেকে তুলে অন্য পরিচয় দিয়েছে। অলকানন্দা নয়, এই উপন্যাস গবেষক কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর অক্লান্ত সাধনার ফসলের ওপর দাঁড়িয়ে আমার কাছে আকাশগঙ্গাই হয়ে আছে।

তাহলে দ্বিধা কেন, হে পাঠক?
হাতে তুলে নিন দুই দধীচীপ্রতিম গবেষকের অস্থি দিয়ে নির্মিত এই বজ্রসম থ্রিলারকে, যা আপনাকে বৃত্তীয় ভাবনার অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে।
আর বুঝিয়ে দেবে, আমাদের সত্যিকারের ইতিহাসের বিন্দুবিসর্গও আমরা এতদিন জানতাম না!
পাঠ শুভ হোক।

Thursday 5 October 2017

শান্ত


ধরে নিন, আপনি একজন ‘ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলা’, যিনি নিজে কাউকে ঝামেলায় ফেলেন না, আবার কেউ আপনাকে ঝামেলায় জড়াক, সেটাও চান না।
ট্রেনে বা বাসে আপনি দেখলেন, কোনো অভাগিনী শিকার হচ্ছে কালো হাত আর ততোধিক কালো দৃষ্টির, অথবা নিরীহ একটা ছেলেকে অকারণে যাচ্ছেতাই অপমান করছে কেউ। কখনও বা অফিসের ঘেরাটোপে দেখলেন কোনো স্যাডিস্টকে, অন্যকে কষ্ট দেওয়ার ব্যাপারে যার কুশলতা দেখলে দুঃশাসন দ্রৌপদীর দিকে হাত বাড়ানোর আগে ক’টা দিন তার আন্ডারে কোচিং নিত।
তখন আপনার কী করতে ইচ্ছে হয়?
ঘাবড়াবেন না। আমি আপনাকে ডান্ডা হাতে “ত্বয়া হৃষীকেশ” বলে ফিল্ডে নামতে বলছি না।
বাবা লোকনাথ নাকি রণে-বনে স্মর্তব্য। কিন্তু এই আধুনিক চক্রব্যূহে ঢুকে পড়া সৎ, নির্বিরোধী, অথচ “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে” মন্ত্রে বিশ্বাসী একাকী অভিমন্যুদের জন্য এবার এল এক নতুন প্রফেট, তার নিজস্ব দাওয়াইয়ের সঙ্কলন নিয়ে।
শান্ত!
ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, ফেসবুকের মাধ্যমে, রাজা ভট্টাচার্য-র আশ্চর্য সৃষ্টি এই নিপাট ভালোমানুষটির কীর্তিকলাপ আপনারা অনেকেই পড়েছেন। এই ছোকরা, ও তার অদৃশ্য অবতার কাটা বল্টু-র দাপট দেখে আমরা ইতিমধ্যেই মুগ্ধ হয়েছি, হেসেছি, হয়তো কেঁদেছি কখনও...
আর হাত মুঠো করে ভেবেছি, অবকি বার, শান্ত-কে দরকার!

যাঁরা এখনও শান্ত-কে চেনেন না, তাঁদের জন্য রাজা ভট্টাচার্য-র অকপট ও অনাবিল “লেখকের কথা” থেকে কিছুটা তুলে দিই বরং, যাতে ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ স্পষ্ট হয়।
“... জাতের নামে বজ্জাতিই হোক, আর পণের নামে ভিক্ষাবৃত্তি; যত্রতত্র ময়লা ফেলাই হোক বা বাচ্চাদের খেলার মাঠ কেড়ে নেওয়া – আমার সমস্ত বিরক্তি আর ঘৃণা বাঁকা পথে বেরিয়ে এল প্রতিশোধ নিতে, প্রতিবাদ করতে।
আমার মতো হাজারো মানুষ – যারা সহ্য করতে বাধ্য হন এমনই শতেক বর্বরতা – তাঁদের প্রত্যেকের ‘অল্টার ইগো’ এই সাদামাটা ছেলেটা। তার না আছে দল, না আছে বল, না আছে নেতা, না আছে অভিনেতা। আছে শুধু ন্যায্য কথা মুখের ওপর বলে দেওয়ার ক্ষমতা। মুখের ওপর – কিন্তু বাঁকা পথে। সে এমনই কথা – যাকে ‘না যায় ছাড়ানো, না যায় এড়ানো’।
হে শান্ত-প্রেমী জনগণ, আপনাদের (আইজ্ঞা হ, তার মধ্যে আমিও আছি বটে) সবার খ্বোয়াইশ পুরো করতে বইমেলায় এগিয়ে এসেছিল ‘দ্য কাফে টেবল’। তাদের তত্ত্বাবধানে শান্তর বাছাই করা কিছু আখ্যানমালা ধরা পড়েছিল দু’মলাটের মধ্যে, ১২০ পৃষ্ঠার, ১৫০/- টাকার এই ঝকঝকে পেপারব্যাকে। অনেক মর্ষকামী বিমর্ষর মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে বইটা হু-হু করে বিক্রি হয়েছিল, ও হচ্ছে।
খুঁটিয়ে দেখলে বইটা নিয়ে কিছু ঘ্যানঘ্যান করাই যায়, যেমন: -
®  বেশ কিছু মুদ্রণ প্রমাদ ও কী/কি সংশয় একে ক্লিষ্ট করেছে,
®  কল্যাণ দাস-এর অলঙ্করণ ক্যারিকেচার-সুলভ বলে প্রতিটি গল্পেই মাখনের মতো হাসির আড়ালে লুকোনো ছুরিটার অস্তিত্ব লঘু হয়ে গেছে, এক্ষেত্রে মডেল হিসেবে ‘কাণ্ডজ্ঞান’ ও অন্যান্য কলামে অহিভূষণ মালিকের আঁকা অবিস্মরণীয় ছবিগুলোর দিকে আমি লেখক ও শিল্পীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি;
®  এই লেখাগুলোর প্রকাশের তারিখ একটু কষ্ট করে দেওয়াই যেত, তাতে সেগুলো কালানুক্রমিক ভাবে সাজানোও যেত।০

কী কী গল্প(-হলেও-সত্যি) আছে এতে? সূচিপত্র পেশ করা যাক।
১. প্রশংসা
২. পরিচয়
৩. শব্দজব্দ
৪. কৃপণ
৫. মাঠ
৬. বোমা
৭. পঞ্চবার্ষিকী
৮. ভোটের লাইনে
৯. আঘাত
১০. মৃত্যুভয়
১১. ফ্রি-গিফট
১২. ডিপ্রেশন
১৩. ভাগ
১৪. বুলি ও গালি
১৫. সম্বোধন
১৬. প্রথা
১৭. পণ
১৮. প্রত্যক্ষ
১৯. মার
২০. নেশা
২১. লুডো
২২. প্রমাণ
২৩. খিল্লি
২৪. কর্মসংস্কৃতি
২৫. আদুরে
২৬. ছোঁয়াচ
২৭. গান
২৮. দেখা
২৯. জুতো
৩০. ডাস্টবিন
৩১. খুনি

একটা সময় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-এর “রসেবশে” কলাম পড়ে লক্ষ-লক্ষ বাঙালি তাঁদের মলিন ও শতচ্ছিন্ন পোশাক-কে ‘ওয়েল ভেন্টিলেটেড’ জেনে ফুরফুরে থাকার মন্ত্র পেয়েছিলেন। ফেসবুকে সেই কাজটাই করে চলেছে শান্ত।

আসুন, তার অ্যাডভেঞ্চারগুলো পড়ে ফেলি, ভাবি, “এখানে শান্ত থাকলে কী করত?”, আর পরের বার যখনই কোনো অন্যায় দেখব তখনই ...!