প্রায় মাসখানেক ধরে গুয়াহাটি তথা অফিসের ঘানি পিষতে পিষতে যখন নিজেকে বেশ একটা গার্হস্থ্য আর বাণপ্রস্থের মাঝামাঝি স্তরের আশ্রমিক ভাবতে শুরু করেছি, তখনই সমন (শমনও বলা চলে) এসে পৌঁছল ক'দিন আগে। রাজভাষা (একে নিছক হিন্দি বললে চলবে না। হিন্দি বলা হয় বলিউডি মশলাদার সিনেমায়। সরকারি কাজে যে দুর্বোধ্য এবং কার্যত অর্থহীন ভাষাটি ব্যবহার করতে কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তর এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করা হয়, এ হল সেই ভাষা।) বিষয়ক সংসদীয় সমিতি আগামীকাল ২৯শে ডিসেম্বর আরও পাঁচটি সংস্থার সঙ্গে আমাদের অফিসেও কাজকর্মে রাজভাষার ব্যবহার নিয়ে নিরীক্ষণ (হুঁ হুঁ বাবা, গোদা ভাষায় ইন্সপেকশন বললে কি আর এমন একটা শিরদাঁড়া-দিয়ে-হিমেল-স্পর্শ গোছের অনুভূতি হত?) করবেন। তবে সাংসদদের দয়ার শরীর, তার ওপর অসম এই মুহূর্তে বেড়াবার পক্ষে মোটেই সুবিধের নয়। তাই এই নিরীক্ষণ হবে রাজধানী-তে। অতঃপর বাঙালের রাজধানী আগমন, সকাল থেকে কুয়াশা আর শীত উপেক্ষা করে বধ্যভূমি (মানে কাল যেখানে যেতে হবে) খুঁজে বের করা এবং মিটিং করা। এই সব করতেই বেলা দু'টো বাজলো। লাঞ্চ সেরে মনে হল যে হোটেলে পড়ে থেকে কচু হবে। তারপর, দস্যু মোহনের ভাষ্য ঝেড়ে বললে: "কী হইতে কী হইয়া গেল!", দেখলাম যে আমি বেঙ্গল এসোসিয়েশন দ্বারা আয়োজিত চতুর্দশ বইমেলার সামনে পৌঁছে গেছি। আর তারপর যা হবার তাই হল। দু হাতে মোট সাতটা প্যাকেট আর মুখে লাজুক হাসি (আজ্ঞে হ্যাঁ, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে, সর্বত্র বই কিনলে আমার একটু লজ্জা করে, বাড়িতে গিয়ে শ্রীমতীর সামনে পড়ার সম্ভাবনা থাকলে ভয়ও করে) নিয়ে যখন গাড়িতে বসলাম, তখন আমার সঙ্গে থাকা প্রবীণ অ্যাসিস্টেন্ট ডাইরেক্টর আব্দুল হাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আগের বার বুকশেলফ গুলো ওনার পরিচিত দোকান থেকেই নিয়েছিলাম তো......।
তবে, যদিও এই মেলায় আমার এই প্রথম আসা, মেলাটার বেশ কয়েকটা বিশেষত্ব আমার নজরে পড়ল। ভুল হবার সম্ভাবনা খুব বেশি, তবু আমার মনে হল: -
১) কলকাতার মেলা যদিও তৃণমূলের একটা শিবিরে পরিণত হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে, এই মেলার চরিত্রটা কিন্তু এখনও বামপন্থী রয়েছে। এই বামপন্থা সি.পি.এম বা ফরোয়ার্ড ব্লকের শেষ দিককার ধান্দাবাজি আর লুম্পেন-ভিত্তিক রাজনীতি নয়, বরং মুক্তচিন্তা আর সংস্কৃতি-নির্ভর সেইসব চিন্তার কম্পন বহন করছে, একসময় আমরা যার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম।
২) এই মেলায় বিভিন্ন স্টলের দায়িত্ব যাঁদের কাছে ছিল, তাঁরা পেশাদার বিক্রেতা নন। তাই স্টলের তুলনায় অনেক সময়েই তাঁদের মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছিল পাশের মঞ্চে চলতে থাকা ক্যুইজ, যাতে বাঙালির একেবারে প্রাণের বিষয় নিয়ে চলছিল প্রশ্নোত্তর। তবে আমার সেটা ভালই লাগছিল, কারণ আমি নিজেও সোৎসাহে কান পেতেছিলাম ওই দিক তাক করেই। মাঝে যখন "এই পথ যদি না শেষ হয়" গানটা কোন সিনেমার, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে বেশ কয়েকটি দল ব্যর্থ হল, তখন "নামিয়ে দিন" বলে আমিও চেঁচিয়েছিলাম।
যাইহোক, বইমেলার উদ্দেশ্যে তো আর "আবার এসো মা" বলা যায়না। তাই বইগুলো ব্যাগে ভরি (প্লেনে এই অতিরিক্ত ওজনটা কীভাবে চেক-ইন্ করানো যায়, সেটাও ভাববার বিষয়), আর আজকের দুপুর-গড়িয়ে-সন্ধে কাটান সময়টা মনে রেখে দিই।
No comments:
Post a Comment