Sunday 8 February 2015

বইমেলা ২০১৫: ফিরে দেখা

আজ বেলা পৌনে দুটো নাগাদ যখন বইমেলা থেকে বেরোচ্ছি, তখন সবক'টা গেট দিয়ে জনস্রোত মেলায় ঢুকছে। মনে হল, "নবমী নিশি গো, পোহায়ো না আর" ব্যাপারটা বাঙালি এখন মেলার শেষ দিনেই সবচেয়ে বেশি করে টের পায়। এমনকি আমার মত একাচোরা পাবলিকের কাছেও এই শেষ দিনের টানটা অমোঘ বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু সেটা ঠিক কেন? একে তো বইমেলার তুলনায় কলেজ স্ট্রিটে সারা বছর বেশি ছাড় পাওয়া যায়। তার ওপর এক ঝলকের রাগি নজরে বইমেলাকে বই-এর বদলে খাবারের মেলা বলেই মনে হয়। সারদা আর রোজ ভ্যালি কি এম.পি.এস-এর তরফে টাকা তোলার উদ্যোগ স্বাভাবিক ভাবেই এবার ছিল না, যেটা ভালো। কিন্তু সেই "ক্ষতি" পূরণ করার জন্যে খাবারের স্টলগুলো, আর তার সামনে ভিড় জমান জনতাই কাফি ছিল। তাহলে কেন এই মেলা শেষ হয়ে যাওয়ার দুঃখটা একেবারে টনটনিয়ে উঠছে? ভেবে চিন্তে যে কারণগুলো মাথায় এল তারা হল: -

১) বইমেলা উপলক্ষে সারা বছর ফেসবুক আর অন্য নানা মাধ্যমে টুকটাক যোগাযোগ (সেও ভার্চুয়াল) হওয়া নামগুলো বাস্তব মানুষ হয়ে সামনে আসে। দশচক্রে ভূতায়িত আমরা তখন টের পাই, আড্ডার শেকড়টা কত গভীরে বিস্তৃত, অথচ সেই আড্ডাটা জমাট বাঁধার আগেই ভেঙে যায়, কারণ কেউ যাবে নর্থে, কেউ সাউথে, কেউ রাজ্যের বাইরে, কেউবা দেশের বাইরে।
২) ধর্ষণ, শিশুহত্যা, মৌলবাদ, রাজনীতি, সানি লিওন, ভিরাট কোহলি, আর জ্যান্ত দুর্গার শ্রীবচনের বাইরেও যে একটা বিশাল ভুবন আছে, তার আভাস আমরা পাই এই ক'টা দিন বই (সঙ্গে প্রেমিকা কি বন্ধুবান্ধব থাকলে তো কেস জমে ক্ষীর) নিয়ে মেতে উঠে।
৩) অচল টাকার অপ্রতিরোধ্য ঠেলায় ভালো টাকার সরে যাওয়ার মত করে, বাজার আর মামাটিমানুস-এর ধাক্কায় বই-এর জগতেও রসসিক্ত অথচ বুদ্ধিদীপ্ত (বিশেষত একটু অন্য ধারার, একটু ক্রিটিক্যাল) লেখাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বইমেলায় এলে "সৃষ্টিসুখ", "গুরুচণ্ডা৯", আর অন্যান্য স্বাধীনচেতা প্রকাশনা সংস্থাগুলোর স্টলে গেলে মনে হয় যে মননশীল বাংলা লেখার প্রত্যাবর্তন নিয়ে এখনো আশাবাদী হওয়া যায়।

আমি এবারো, যথারীতি, কাছা খুলে এবং ব্যাগ ফাটিয়ে বই কিনেছি। সবথেকে বেশি কিনেছি সৃষ্টিসুখ, সংসদ, মেইনস্ট্রিম, কোরক, গুরুচণ্ডা৯, আর নানা ছোটখাটো সংস্থা থেকে। কিছু সংস্থা যথারীতি ঝুলিয়েছে, মানে বই প্রকাশ করে উঠতে পারেনি। ছাড়া কিছু সংস্থার বই পাওয়াই যায়নি, অর্থাৎ কলেজ স্ট্রিটে সেগুলো যোগাড় করতে হবে পরে। আর নামজাদা ও পায়াভারী সংস্থাগুলোর বই আমি কলেজ স্ট্রিটের দোকান থেকেই কিনি, তাই তাদের কথা আলাদা। কিন্তু এবারের মেলাটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেকদিন এর রেশ আমার মনে থেকে যাবে। সমুদ্রের স্বাদ পাওয়া মানুষ যেমন প্যাচপেচে ঘেমো অফিসে বসে ঢেউয়ের গর্জন শুনতে পায়, আমিও আমার অর্ধোন্মাদ সাইকোটিক বসের কথা শুনতে-শুনতে বইমেলার এই ভিড় আর হাসিঠাট্টার কথা ভাবব, আর অপেক্ষা করব সামনের বছরের জন্যে

No comments:

Post a Comment