সব দোষ রাজা ভট্টাচার্য-র।
গতকাল এই মানুষটির সঙ্গে আড্ডা মারার ফাঁকে অরণ্যমন-এর স্টল
থেকে বেরিয়ে চলে গেছিলাম বইমেলার আরেক মাথায় লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে। এরপর যা
হয়। বাঁশবনে ডোম কানা হওয়ার মতো করে চারদিকে পত্র-পত্রিকার বিশাল সম্ভার দেখে আমি
কেমন একটা দিশেহারা হয়ে গেলাম। এদিক-ওদিক ঘোরার ফাঁকে একটা ছোট্ট স্টলে ক’জন
প্রবীণ মানুষকে একটা পত্রিকা নিয়ে বসে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম।
কেন?
কারণ তাঁদের সামনের টেবিলে রাখা ছিল ‘উন্মুক্ত উচ্ছ্বাস’
নামক একটি পত্রিকা-র ২০১৯ বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যা, যার প্রচ্ছদে
বড়ো-বড়ো করে লেখা ছিল ‘রাজধানী দিল্লির নিজস্ব সাহিত্য পত্রিকা’। ইন্দ্রপ্রস্থের
বাসিন্দা বাঙালিদের সাহিত্যচর্চার ওপর আমার সবিশেষ দুর্বলতা আছে। দেরি করা গেল না।
মোটাসোটা সংখ্যাটা নিয়েই নিলাম। তারপর উদ্দেশ্যহীন কিঞ্চিৎ ঘোরাঘুরির পর পত্রিকাটা
খুলে পড়তে শুরু করলাম। গল্প-কবিতা নিয়ে কিছু বলব না। সূর্য সেন-এর জীবন নিয়ে একটা
আবেগজর্জরিত গল্প পড়েই মাথায় এক টন প্রশ্ন উদয় হল, যেগুলো নিয়ে পরে ঐশীকে জ্বালাতে
হবে। কিন্তু আসল গুঁতোটা খেলাম পত্রিকার মূল অংশটি পড়তে গিয়ে, যা নিবেদিত হয়েছে এই
সংখ্যার কেন্দ্রে থাকা মানুষটির জীবন ও কাজের নানা দিক নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনায়।
মানুষটি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
বিদ্যাসাগর আমাদের কারও কাছে অজানা নন। আমার মতো গোদা লোকও
তাঁকে নিয়ে একটা ছোটোখাটো রচনা লিখে কুড়িতে এগারো তুলে ফেলতে পারবে। তবু, নতুন করে
মানুষটির কীর্তি, বিশেষত যে সাংঘাতিক বাধা ও শত্রুতা ঠেলে তাঁকে প্রতিটি ক্ষেত্রে
এগোতে হয়েছিল তা পড়ে আমার আবার তব্দা লেগে গেল। কিন্তু মানুষটি এই হারকিউলিস-সম
সংগ্রাম করে যা-যা আদায় করেছিলেন, তাদের বর্তমান অবস্থা কেমন?
আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে চলে যাওয়া মানুষটির অবিস্মরণীয়
সিনেমাগুলোতে বহু মণিমুক্তো আছে। তাদের মধ্যে বাঙালি একটিকেই মিমযোগ্য বলে আঁকড়ে
ধরেছে। সেটি অনুযায়ী যদি ভাবেন, বিশেষত ভাবা প্র্যাকটিস করাটা চালিয়ে যান, তাহলে
দেখবেন~ নারীশিক্ষা তথা প্রাথমিক ও বুনিয়াদি স্তরের যথাসম্ভব মানুষের মনে সরল ও
শুদ্ধভাবে মাতৃভাষা চর্চার স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেওয়ায় বাংলার অবস্থা এখনও শোচনীয়।
অথচ, আমরা আজও তাঁর মতো আরেকটি মানুষকে খুঁজে চলেছি। বিদ্যাসাগরের
মতো, রামমোহনের মতো, দ্বারকানাথের মতো... কেউ তো আসুক! কোনো আলোর পথযাত্রী ঘর
বাঁধুক এই অন্ধকার বালুচরে। ঈশ্বরের অবতার নয়, বরং এঁদের পুনর্জন্মের আশা বা
খ্বোয়াইশ নিয়ে বাঁচি আমরা অনেকেই, তাই না? কিন্তু সে-সব ভাবতে গিয়েই আমার একটা
কবিতার কথা মনে পড়ে গেল। কবিতাটা শেষ অবধি যেখানে পেলাম সেই সূত্রের শুদ্ধতা
নিশ্চিত নয়, তাই ভুল থাকলে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
নচিকেতা
কেন ফিরে আস বার-বার?
স্মৃতির তুষার থেকে কেঁদে এসে শীতের তুষার
কেন হেঁটে পার হতে চাও?
এমন নির্জন রাতে সেই ভয়ে নক্ষত্র উধাও
অনন্ত আকাশ থেকে, সে-নির্মম মেঘের কুয়াশা
কোন্ সুখে বুকে টানো? এ-নরকে কীসের
প্রত্যাশা?
তুমি কি জান না; যারা আসে
আকণ্ঠ পিপাসা নিয়ে সূর্যহীন এ সৌর আকাশে
চারদিকের মৃত গ্রহদের
কবর, প্রস্তর ভেঙে আসে; তারা নিজেরই
রক্তের
পিপাসায় জ্বলে। কোনোখানে নেই একফোঁটা জল;
দীর্ঘশ্বাসে দ্বিখণ্ডিত এ মাটির অশ্রুই
সম্বল।
কেন তবে সব ভুলে যাও?
এ-প্রেতপুরীর বুকে মুখ রেখে কোন্ সুখ
পাও?
আসমুদ্রহিমাচল এই মহাশূন্যের কান্নায়
কেবল পশুর নখ দাগ কাটে; বিষাক্ত হাওয়ায়
সাপের খোলসগুলি ভাসে শুধু; আর
দিনরাত্রির বুকফাটা ‘নেই, নেই, নেই’-এর
চিৎকার।
সে চিৎকারে স্বর্গ-মর্ত্য টলে
পাথরও চৌচির হত ভারতবর্ষের বন্ধ্যা পাথর
না হলে।
জঠরের অসহ্য ক্ষুধায়
ধূমাবতী জন্মভূমি সন্তানের দুর্ভিক্ষের
ভাত কেড়ে খায়,
এ-কী চিত্র! নরকের সীমা
চোখ অন্ধ করে দেয়, মুছে নেয় চেতনার সমস্ত
নীলিমা।
তাই নিয়ে নচিকেতা, তবু তুমি গড়বে প্রতিমা?
অন্ধ হবে, বোবা ও অধীর
তবু ক্লান্তিহীন, মৃত্তিকায় পুনর্জন্মের
অস্থির
জিজ্ঞাসায় মৃত্যুর তুষার
বার-বার হেঁটে হবে পার?
অগ্নিদগ্ধ দুই হাতে কতবার খুলবে তুমি যমের
দুয়ার?
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
মেলার শেষ চারটে দিন অক্ষরের উৎসবের পাশাপাশি আগুনের পরশমণি
হয়ে উঠুক আপনাদের সবার কাছে। ভালো থাকুন।