Saturday 1 September 2018

চোখের বাহিরে

'সেজ' নামক সুবিখ্যাত জার্নালের নভেম্বর ২০১৭ সংখ্যায় বুধাদিত্য চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, "We believe in the constructed world when resonance of the site reverberates in our ears and to our sonic sensibilities even long after the medial experience."
চলচ্চিত্রের আসল কথাটি সম্ভবত ধরা পড়েছে এই একটি লাইনেই, যেখানে দৃশ্যরা ফুরিয়ে গিয়েও শব্দের সৌজন্যে জেগে থাকে বন্ধ চোখের অন্ধকারে। এভাবে জিনিসটা আগে সেভাবে ভাবিনি, কিন্তু কাল রাতে কন্যার সৌজন্যে এটা হাড়ে-হাড়ে টের পেলাম।
কেন?

রাতে খাওয়ার শেষে, যখন পরিবারের দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্রী টেবিল ত্যাগ করে টিভি বা মোবাইলে মনোনিবেশ করেন, তখন আঙুল ও থালা চাটায় মগ্ন আমি ও কন্যা দুনিয়ার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। আমাকে শুনতে হয় জাস্টিন বিবারের মুণ্ডপাত, বেনেডিক্ট কামবারবাচ কী অ...সাম, বিটিএস (একটি কোরিয়ান পপ গ্রুপ)-এর ছেলেগুলো কী কিউট, স্কুলে ক্লাসে কে কাকে কাগজের ফালি পাচার করতে গিয়ে টিচারের হাতে ধরা পড়েছে, ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকার কী শেষ অবধি কারও সঙ্গে বিয়ে হবে... ইত্যাদি। মেয়েকে হজম করতে হয় উপনিষদের তত্ত্ব নিয়ে থ্রিলার লেখার সমস্যা, হতভাগা প্রকাশকেরা কেন আমার গল্পগুলো বই করার যোগ্য বলে মনে করছে না সেই নিয়ে চাপ, অফিসের খাজা দশা... ইত্যাদি।
কাল রাতে মেয়ে বলল, তাদের স্কুলের হবি ক্লাসের অংশ হিসেবে সে ও তার বন্ধু মিলে 'মণিহারা' পড়ছিল। লাইব্রেরির বইটি বড়ো ফন্টে ছাপা বলে "সেই জীর্ণপ্রায় বাঁধাঘাটের ধারে আমার বোট লাগানো ছিল।" থেকে "আমি কহিলাম, 'নৃত্যকালী।'" অবধি তারা পড়ে ফেলেছে, কিন্তু কিছুই বোঝেনি! আমি যারপরনাই রুষ্ট হলাম। ভাবলাম, রচনাবলি নামিয়ে গল্পটা ওকে আবার পড়াই। তারপর বুদ্ধি গজাল। বললাম, "বুঝতে গেলে দেখতে হবে। এক ঠাউরের লেখা ঠাওরাতে হলে আরেক গ্রেটের কাজ দেখতে হবে। তুই রেডি?"

তাহার মাতা সম্মুখস্থ বৈদ্যুতিন পর্দায় কোনো হতভাগ্যের ক্রন্দন দেখিবার ও শুনিবার অবসরে বার্তালাপও চালু রাখিয়াছিলেন। ইত্যবসরে আমরা ইউটিউবে প্রবেশ করিলাম, এবং অর্ধশতবর্ষাধিক প্রাচীন চলচ্চিত্রটি দেখিতে লাগিলাম। তিন কন্যার কাহিনির মধ্যভাগের অংশটিতেই মনোনিবেশ করিলাম। ক্রমে সেই অংশটি আসিল যেখানে:
"তখন ফণিভূষণ চোখ মেলিল এবং দেখিল, ঘরে নবোদিত দশমীর চন্দ্রালোক আসিয়া প্রবেশ করিয়াছে, এবং তাহার চৌকির ঠিক সম্মুখে একটি কঙ্কাল দাঁড়াইয়া। সেই কঙ্কালের আট আঙুলে আংটি, করতলে রতনচক্র, প্রকোষ্ঠে বালা, বাহুতে বাজুবন্ধ, গলায় কণ্ঠি, মাথায় সিঁথি, তাহার আপাদমস্তকে অস্থিতে অস্থিতে এক-একটি আভরণ সোনায় হীরায় ঝক্‌ঝক্‌ করিতেছে। অলংকারগুলি ঢিলা, ঢল্‌ঢল্‌ করিতেছে, কিন্তু অঙ্গ হইতে খসিয়া পড়িতেছে না। সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর, তাহার অস্থিময় মুখে তাহার দুই চক্ষু ছিল সজীব; সেই কালো তারা, সেই ঘনদীর্ঘ পক্ষ্ম, সেই সজল উজ্জ্বলতা, সেই অবিচলিত দৃঢ়শান্তি দৃষ্টি। আজ আঠারো বৎসর পূর্বে একদিন আলোকিত সভাগৃহে নহবতের সাহানা-আলাপের মধ্যে ফণিভূষণ যে দুটি আয়ত সুন্দর কালো-কালো ঢলঢল চোখ শুভদৃষ্টিতে প্রথম দেখিয়াছিল সেই দুটি চক্ষুই আজ শ্রাবণের অর্ধরাত্রে কৃষ্ণপক্ষ দশমীর চন্দ্রকিরণে দেখিল, দেখিয়া তাহার সর্বশরীরের রক্ত হিম হইয়া আসিল। প্রাণপণে দুই চক্ষু বুজিতে চেষ্টা করিল, কিছুতেই পারিল না; তাহার চক্ষু মৃত মানুষের চক্ষুর মতো নির্নিমেষ চাহিয়া রহিল।"

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কী জানেন? এই বর্ণনা, বা পর্দায় দেখা জমাট ছায়া, এমনকি হাড়ের হাত দিয়ে বাক্সটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা, এসবে আমার মেয়ে ভয় পায়নি। কিন্তু পেছনে বেজে চলা সেই অদ্ভুত সুরটা (মণিমালিকা-র থিম), গল্পের শুরুতে স্কুলমাস্টারের ঘাটে এসে বসার সময় হাওয়ার শব্দ, সর্বোপরি ফণীভূষণের ভূমিকায় কালী ব্যানার্জির অপেক্ষার সময় পটভূমিতে বেজে চলা ধিকি-ধিকি বাজনা (দ্যাট ফেটফুল নাইট), এগুলো তাকে মারাত্মক ভয় দেখায়। রাতে শোয়ার পর ফ্যানের হাওয়ায় পরদার নড়াচড়া, শ্রীমতীর হাতের চুড়ির আলগা আওয়াজ, এমনকি এসি-র চলা-বন্ধ হওয়ার যে শব্দগুলো সে কখনও খেয়াল করেনি সেগুলোও কাল রাতে মণিহারার সেই সন্ধিক্ষণটি তার কাছে বারবার ফুটিয়ে তুলছিল।
তার চেয়েও ভালো জিনিস কী জানেন? যা একেবারে সুধারস হয়ে কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল?
"বাবা, রবীন্দ্রনাথ এরকম গল্প আরও লিখেছেন? আমাকে পড়তে দেবে?"
জয় বাবা সত্যজিতের চরণে সেবা লাগে বাবা!

2 comments:

  1. চমৎকার!
    পরের বা তার পরের গল্প পড়ার পর কী প্রতিক্রিয়া হয়, জানার অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমিও! কিন্তু আশঙ্কা হচ্ছে, আমাকেই না পড়ে শোনাতে হয়!

      Delete