Thursday 22 November 2018

দরজা বন্ধ ছিল...



কিশোর ভারতী শারদীয়া ১৪২৫-এ রহস্য-রোমাঞ্চ ঘরানার গ্র্যান্ড মাস্টার অনীশ দেব এই নামে একটা উপন্যাস লিখেছেন। লেখক এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, একটি সত্য ঘটনাত দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এটি লেখা শুরু করেন। কিন্তু তারপর লেখাটা স্বয়ংচালিত হয়ে একটা ‘লকড্‌ রুম মিস্ট্রি’-র আকার নেয়। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, এই পত্রিকাতেই আমাদের সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক সৈকত মুখোপাধ্যায় যে লেখাটি পেশ করেছেন (“খুনি ম্যাজিক”) সেটিও একটি লকড্‌ রুম মিস্ট্রি! এমন সমাপতনে আমার ‘কল্পনা উত্তেজিত হইয়া উঠিল’। ঠিক করে ফেললাম, আজ এই নিয়েই আপনাদের বোর করব।

লকড্‌ রুম মিস্ট্রি মানে কী? রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যে ‘ইম্পসিবল ক্রাইমস’ নামক একটি বৃহত্তর ঘরানা আছে। এতে তদন্তের ভারপ্রাপ্ত সরকারি গোয়েন্দা বা পুলিশ মাথা ও গতর খাটিয়ে রহস্যের সমাধান করতে অসমর্থ হন। এক কথায় বলতে গেলে রহস্য সাহিত্যের শুরু থেকে দেখলে সব কাহিনির সূত্রপাত এই দিয়েই হয়, যেখানে পুলিশ স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইগো বিসর্জন দিয়ে গোয়েন্দার সাহায্য চায়। কিন্তু এদের মধ্যে আমাদের বিচার্য সেই অপরাধগুলোই যেখানে:
(ক) একটা, বা একাধিক খুন, নিদেনপক্ষে গুরুতর অপরাধ হয়েছে।
(খ) নিহত ব্যক্তি(দে)-র বা অপহৃত বস্তুটির নাগাল পাওয়া আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব ছিল, কারণ~
·      দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
·      জানলা বন্ধ বা এমন গড়নের যা দিয়ে কারও পক্ষে কিছু করা বাস্তবে সম্ভব নয়, মানে টেলিপোর্টেশন, অকাল্ট মেথড, ইথারে ভাইব্রেশন তোলা (বাণ মারা?) এসব সমাধান চলবে না।
·      যাদের খুন করার মতো মোটিভ ছিল তারা সেই সময় কোনো তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে ছিলেন বলে অ্যালিবাই আপাতভাবে ওয়াটারটাইট। এই শেষের শর্তটি মানা হতেও পারে, নাও পারে, তবে হলে যে কেস জমে যায় তা সহজবোধ্য।
সংক্ষেপে বলতে গেলে এই রহস্য শুধুমাত্র হু-ডান-ইট্‌ নয়, বরং হাউ-ডান-ইট্‌-ই এক্ষেত্রে গোয়েন্দার মস্তিষ্কের পুষ্টি ঘটায় এবং তাকে তাড়িত করে।

বাংলায় মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য তাঁর গোয়েন্দা হুকাকাশি-কে দিয়ে অন্তত একটি ইম্পসিবল ক্রাইম সলভ করিয়েছেন। অনীশ দেব তাঁর হুনুর্‌ অশোকচন্দ্র গুপ্ত-কে দিয়ে একাধিক লকড্‌ রুম মিস্ট্রি সল্ভ করিয়েছেন। তবে এই ঘরানায় ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যে এমন বেশ কিছু গল্প ও উপন্যাস রয়েছে যাদের ক্লাসিক বলতে দ্বিধা হয় না। এদের মধ্যে যেগুলো আমি নিজে পড়েছি, তাদের সঙ্গে এই সুযোগে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। লেখাগুলো আমি কালানুক্রমিকভাবে সাজিয়েছি। আমার পছন্দের অর্ডার অনুযায়ী নয়।

(১) মার্ডার্স ইন দ্য রু মর্গ: ১৮৪৫ সালে এডগার অ্যালান পো-র একাধিক লেখার সংকলন ‘টেলস্‌’-এ প্রকাশিত এই গল্পটির সমাধান পড়ে আমার পিত্তি চটকে গেছিল। কিন্তু ইম্পসিবল ক্রাইম ব্যাপারটা কীভাবে সাজাতে হয়, তার টেমপ্লেট তৈরি হয় এই গল্পে।


(২) দ্য মিস্ট্রি অফ দ্য ইয়েলো রুম (১৯০৮): গথিক সাহিত্য তথা রহস্যের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন হিসেবে যে লেখাগুলো পরিগণিত হয়, তাদের মধ্যে একটি হল “দ্য ফ্যান্টম অফ দ্য অপেরা” (১৯০৯ ও ১৯১০-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত, ১৯১০-এ গ্রন্থবদ্ধ)। বহুবার চলচ্চিত্রায়িত এবং নানা রূপে মঞ্চে পরিবেশিত এই যথার্থ ক্লাসিকটি লিখেছিলেন গ্যাস্টন লারু। কিন্তু তার আগেই লারু লেখেন উপরোক্ত রহস্য উপন্যাসটি। রীতিমতো ম্যাপ দিয়ে, ঘটনার সময়ে বিভিন্ন চরিত্র কোথায় কী অবস্থায় ছিল সেগুলো তাতে চিহ্নিত করে লারু যা একটি জিনিস নামান তা পরবর্তীকালে এই ঘরানার লেখালেখি কীভাবে হওয়া উচিত, তার মডেল হয়ে দাঁড়ায়।


(৩) দ্য ওরেকল অফ দ্য ডগ (১৯২৬): জি.কে. চেস্টারটনের অমর সৃষ্টি ফাদার ব্রাউন-এর বেশ কিছু কাহিনি ‘দ্য ইনক্রেডুলিটি অফ ফাদার ব্রাউন’ নামের বইয়ে সংকলিত হয়। তাতে স্থান পাওয়া এই গল্পটির সামনে রহস্য-রোমাঞ্চের যেকোনো ভক্ত আভূমি নত হয়ে সেলাম ঠুকবে। শুধু এই গল্পটি নয়। এই বইয়েই আছে আরও খান তিনেক গল্প যাদের স্বচ্ছন্দে ইম্পসিবল ক্রাইম ঘরানায় রাজসভায় বসানো যেতে পারে। ইনফ্যাক্ট আমি গোটা ফাদার ব্রাউন সিরিজটাই অবশ্যপাঠ্য বলব।


(৪) দ্য গ্রিক কফিন মিস্ট্রি (১৯৩২): এলেরি কুইন নামক গোয়েন্দাকে কেন্দ্রে রেখে লেখা ইম্পসিবল ক্রাইম সিরিজের সেরা বই এটি নয়। তবে এই উপন্যাসটি ইম্পসিবল ক্রাইম-এর ক্ষেত্রে রীতিমতো সম্ভ্রমের সঙ্গে আলোচিত হয়। প্লট নিয়ে একটু লিখি। গল্পের শুরু খুবই স্বাভাবিকভাবে, যখন এক ধনকুবের স্বাস্থ্য ও বয়সের ধাক্কায় মারা যান। মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয়, তাঁর উইলসহ একটা বাক্স সিন্দুক থেকে গায়েব। সর্বত্র খুঁজেও সেটা পাওয়া গেল না। তখন বাধ্য হয়ে মৃতদেহটাই কবর থেকে তোলা হল এই ভেবে যে কেউ কফিনের মধ্যে বাক্সটা পাচার করে দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করতে চেয়েছে। না, সেখানেও বাক্সটা পাওয়া গেল না। তবে কফিন খুলে তার মধ্যে মৃতদেহের সঙ্গে আরও একটা লাশ পাওয়া গেল, যাকে খুন করা হয়েছে!


(৫) দ্য থ্রি কফিনস্‌, নামান্তরে দ্য হলো ম্যান (১৯৩৫): লকড্‌ রুম মিস্ট্রি-র ক্ষেত্রে যাঁকে সম্রাট বলে মনে করা হয় সেই জন ডিকসন কার-এর লেখা এই উপন্যাসটি রহস্যসাহিত্যে এটি প্রায় গীতা-টাইপের স্ট্যাটাস পায়। শুধু কাহিনির প্যাঁচালো প্রকৃতির জন্য নয়। এই উপন্যাসে রহস্যভেদী ডক্টর গিডিয়ন ফেল-এর মুখে লকড্‌ রুম মিস্ট্রির প্রকারভেদ ও তার সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে যে বক্তৃতাটি আছে সেটিকে এই ধারায় লেখালেখি করতে গেলে পাঠ্যপুস্তক ভাবা উচিত।


(৬) মার্ডার ফর ক্রিসমাস (১৯৩৮), নামান্তরে এরকুল পোয়ারো-জ ক্রিসমাস (১৯৩৯): ‘রহস্যের রানি আগাথা ক্রিস্টি’ (উপাধিটি নির্লজ্জভাবে প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত-র বই থেকে ঝেড়ে দিলাম। প্রসঙ্গত, ডেম আগাথা-কে নিয়ে কিছু জানতে চাইলে ওই নামের বইটির চেয়ে ভালো সোর্স বা রিসোর্স বাংলায় অন্তত পাবেন না, এটাও বলে রাখলাম।) এমন অনেক কাহিনিই লিখেছেন যা ইম্পসিবল ক্রাইম বলে বিচার্য। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত ‘মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস’ বোধহয় জনপ্রিয়তা আর চলচ্চিত্রায়িত হওয়ার দিক দিয়ে কোনান ডয়েলের ‘দ্য হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস্‌’-কে টক্কর দেবে; তাতেও মাথা গুলিয়ে যাওয়ার পর্যাপ্ত উপকরণ আছে। একইভাবে ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত ‘অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়াজ নান’ ক্রিস্টির জনপ্রিয়তম উপন্যাসই শুধু নয়, এমনকি তাঁর নিরিখেও সেটি সবচেয়ে ‘কষ্টকল্পিত’ রহস্য বলে বিচার্য। কিন্তু যেটির কথা লিখলাম সেটি মানবসম্পর্কের আলো-ছায়া ফুটিয়ে তুলে, আমার মতে, আরও বিশুদ্ধ রহস্য হয়ে উঠতে পেরেছে।


(৭) দ্য কেস অফ দ্য কনস্ট্যান্ট সুইসাইডস (১৯৪১): জন ডিকসন কার্‌-এর লেখা প্রায় সব গল্প-উপন্যাসই লকড্‌ রুম মিস্ট্রির পাঠকদের কাছে টেক্সট-তুল্য। এই বইটিও ব্যতিক্রম নয়। স্কটিশ হাইল্যান্ডে একটি কাসলে জমায়েত হয় বেশ কয়েকটি মানুষ। সেই কাসলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা অপমৃত্যুর কিংবদন্তির সঙ্গেই জুড়ে যেতে থাকে একের পর এক মৃত্যু, যাদের দেখে আত্মহত্যা মনে হলেও ব্যাপারটা, লালমোহনবাবু-র ভাষায়, হাইলি সাসপিশাস। ডক্টর গিডিয়ন ফেল এবারেও ফেল করেননি। কত রকমভাবে বন্ধ ঘরের মধ্যে একজনকে খুন করা যেতে পারে সেই নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি খুনিকেও চিহ্নিত করেন তিনি।


(৮) রিম অফ দ্য পিট (১৯৪৪): হেক টেলবট-এর লেখা এই উপন্যাসটি শুধু লকড্‌ রুম মিস্ট্রি নয়। খুনের পাশাপাশি বরফে আপাতভাবে অদৃশ্য কারও পায়ের দাগ, লোকালয় থেকে বহু দূরে বরফবন্দি একটি বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে জমে ওঠা ভয়, টেনশন, সন্দেহ, রোমান্স, এবং ম্যাজিক মিশিয়ে একটি দারুণ উপভোগ্য রহস্য পরিবেশন করে। নামজাদা সম্পাদক থেকে পাঠক, প্রায় সবাই এই উপন্যাসটিকে ভূরি-ভূরি নম্বর দিয়েছেন। এখনও ভোটাভুটি হলে সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম লকড্‌ রুম মিস্ট্রির তালিকায় এটি প্রথম পাঁচে থাকে।


(৯) দ্য ফোর্থ ডোর (১৯৮৭): জন ডিকসন কার্‌-এর সার্থক উত্তরসূরী হিসেবে গণ্য ফরাসি লেখক পল হল্টার-এর প্রথম উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয় ২০১০-এ, কিন্তু ততদিনে এটি স্বনামে এবং ‘দ্য হুডিনি মার্ডারস’ নামেও ক্লাসিক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। সত্যি বলছি, এমন মাথা-গুলিয়ে-দেওয়া লেখা আমি আমার জীবনে আজ অবধি একটিও পড়িনি। বইটা শেষ করার পর একদম ‘বুঝভোম্বল’ স্টাইলে ভেবেছিলাম, “কেসটা কী হল?” প্রসঙ্গত, এই উপন্যাস আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছে, কেন এই ধরনের রহস্য সমাধান করতে গেলে ম্যাজিক তথা ইল্যুশন সম্বন্ধে জ্ঞান এত গুরুত্বপূর্ণ।


(১০) দ্য ডক্টর্স কেস (১৯৮৭): এই গল্পটি তিনটি কারণে ঐতিহাসিক। প্রথমত, এটি স্টিফেন কিং-এর লেখা একমাত্র হোমসিয়ান প্যাস্টিশ, যা হোমসের আত্মপ্রকাশের শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত ‘দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার্স অফ শার্লক হোমস’-এ স্থান পেয়েছিল। দ্বিতীয়ত, এটি কিং-এর লেখা এযাবৎ একমাত্র লকড্‌ রুম মিস্ট্রি। তৃতীয়ত... গল্পের নামটা থেকে কি কিছু বুঝতে পারছেন? বাকিটা বুঝতে গেলে আপনাকে গল্পটা পড়তে হবে। কিং-এর গল্প-সংকলন ‘নাইটমেয়ার্স অ্যান্ড ড্রিমস্কেপস্‌’-এ গল্পটা পাবেন। জন জোসেফ অ্যাডামস্‌ সম্পাদিত প্যাস্টিশ সংকলন ‘দ্য ইমপ্রোবেবল অ্যাডভেঞ্চার্স অফ শার্লক হোমস’-এও এটি পাওয়া যাবে।


না। আর লিহুম না। ল্যাহনের কিসু নাই। খালি পড়নের আসে। যদি এই ধারায় পড়াশোনা করে মগজাস্ত্রে ধার দিতে চান, তাহলে ঝটপট বইগুলো জোগাড় করে পড়ে ফেলুন। আর এতগুলো বই কেনার মতো অবস্থায় যদি না থাকেন, অথচ আলোচনাটা কৌতূহলোদ্দীপক বলে মনে হয়, তাহলে মার্টিন এডওয়ার্ডস্‌ সম্পাদিত ‘মিরাকুলাস মিস্ট্রিজ’ নামক গল্প-সংকলনটি জোগাড় করুন এবং পড়ে ফেলুন। 

আটলান্টিকের ওপারের লেখাজোখা এতে নেই, কারণ বইটি প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ লাইব্রেরি ক্রাইম ক্লাসিক্স সিরিজে। সেইসব গল্প পড়তে চাইলে অটো পেঞ্জলার সম্পাদিত একটি অতিবৃহৎ সংকলন আছে বটে, তবে তাতে জালি গল্প প্রচুর।
তবে হ্যাঁ, এই নিয়ে পড়াশোনা শুরুর আগে একটি বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ লিখে দিই। এই গল্পগুলো আদ্যন্ত কৃত্রিম, এবং যতটা না রহস্যভেদ, তার চেয়ে বেশি ইন্টেলেকচুয়াল এক্সারসাইজ। মগজাস্ত্রে শান দেওয়াই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে পোলিস প্রোসিডিওরাল পড়া ভালো, কারণ সেগুলো বাস্তবকে অনেক বেশি প্রতিফলিত করে। আর যদি বাস্তব থেকে পালিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ ইত্যাদি চান, তাহলে লুক নো ফারদার। রহস্যপ্রেমীদের কাছে এসকেপিস্ট এন্টারটেনমেন্টের পরাকাষ্ঠা এই লেখাক’টি পড়ে দেখলে ভালো লাগতেই পারে।
পাঠ শুভ হোক।

3 comments:

  1. ঋদ্ধ হলাম। অনেক সুলুকসন্ধান দিলেন, যদিও আমি police proceduralআর noir পড়তে ভালবাসি।





    ReplyDelete
  2. অনেক ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  3. অনেক অনেক ধন্যবাদ।

    ReplyDelete