“শান্তনু, আমি তোকে বলা কথাটা ভুলে গেছিলাম রে। সরি। আবার ঠেকে শিখলাম আর কী।
আমি আর এই ভুলটা করছি না”।
আজ থেকে প্রায় ষোলো বছর আগের কথা।
তখন আমার
যা রুটিন ছিল, সেটা মেনেই সকাল এগারোটার কল্যাণী সুপার ধরে কলকাতা গিয়ে, আর
আই.আই.এস.ডব্লু.এম-এ পড়াশোনা সেরে বিকেল পৌনে পাঁচটা নাগাদের গ্যালপিং
শান্তিপুর-টা ধরে ব্যারাকপুর ফিরছি।
দরজার
কাছে, কনুই আর মাথার জংগলের মধ্য দিয়ে হাতদুটোকে ওপরে তুলে, পা-মাড়ানো এড়িয়ে
একটু-একটু করে পজিশন নিচ্ছি। এমন সময় শান্তনু’র সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
শান্তনু
সেই বিরল লোকেদের একজন, যে আমার সঙ্গে বিবেকানন্দ মিশন, রহড়া মিশন, ভি.সি. কলেজ,
কালীবাড়ির মাঠের হাস্যকর ক্রিকেটঃ এই সব কিছুতে থেকেও কখনও আমার বন্ধু হয়নি। বা
আমি ওর বন্ধু হইনি। একই ব্যাপার।
সেদিন
কিন্তু, ট্রেনের সেই মারাত্মক ভিড়ে পাস্কালের সূত্র মেনে আমার ওপর পড়া চাপ
সুষমভাবে নিজের চারপাশে ছড়িয়ে দিতে-দিতেও ওর সঙ্গে আমার হওয়া অতি-সংক্ষিপ্ত
কথোপকথনটা খুব দামি ছিল। ওর কাছে হয়তো নয়, কারণ ও কথাটা খুব সহজভাবেই জিজ্ঞেস
করেছিল।
বন্ধুত্বের
অধিকার না থাকলেও একটা বয়স অবধি বোধহয় সবাই সবাইকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে। ও
সেই ভাবেই প্রশ্নটা করেছিল।
“ঋজু, আমাদের ব্যাচের সবাই তো কাজে ঢুকে গেল। অমুক-অমুক তো বিয়ে করে বাচ্চার
অন্নপ্রাশন খাইয়েও দিল। এক তুই এখনও বেকার রয়ে গেলি। কেন রে? তুই কি কোনও কাজই
পাচ্ছিস না?”
শহরতলি
শেষ হয়ে তখন যে ভিড়টা দরজার সামনে দলা পাকাচ্ছে, তাতে জমাট বাঁধা লোকেরা প্রায়
সবাই আমারই মতো ব্যারাকপুরের বাসিন্দা, নয়তো শেওড়াফুলি বা শ্রীরামপুরের লোক, যারা
স্টেশন থেকে ফেরিঘাটের অটো নেবে। তাদের মধ্যে কেউ-কেউ আমাকে চেনে, আবার অনেকেই
চেনে না, কিন্তু শান্তনুর গলার স্বরে কোথাও হয়তো তারাও বুঝতে পেরেছিল, ওই “এক তুই”-এর
পেছনে রয়েছে কিছু একটা বিশেষ ব্যাপার।
মাধ্যমিকে
সাব-ডিভিশন টপার, উচ্চ-মাধ্যমিকে প্রথম কুড়ির মধ্যে থাকাঃ একে কি বিশেষত্ব বলা
যায়?
যায়
হয়তো। জানিনা, তবে ভিড়ের একটা বড়ো অংশ হঠাৎই আমার দিকে তাকিয়েছিল তখন।
১৯৯৭-এর
সেপ্টেম্বরে বি.এইচ.ইউ, এবং বায়োটেকনলজির কোর্স ছেড়ে চলে এসেছিলাম আমি। খেয়াল
চেপেছিল সিভিল সার্ভেন্ট হওয়ার। ডব্লিউ.বি.সি.এস নয়, আই.এ.এস!
তবে
মান্থলি-তে অকুপেশনের জায়গায় একটা ড্যাশ বসানোর সময়, লিফটে চেপে নামতে গিয়ে দড়ি
ছেঁড়ার অনুভূতিটাও হয়েছিল তখনই।
সেই
ভাবেই তদ্দিনে তিন বছর কেটে গেছে।
শান্তনু’র প্রশ্নটাকে তাই, কোনও মতেই অন্যায্য বলা যায় না।
কিন্তু
আশে-পাশে দাঁড়ানো লোকগুলোর চাউনিতে কি শুধুই কৌতূহল ছিল?
আমার কেন
যেন মনে হয়েছিল, সেই চাউনিগুলোতে আমি দেখতে পাচ্ছি, আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তিন
নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢুকে এদিক-ওদিক ছিটকে যাওয়ার আগে এক চিলতে হিংস্র
মনোরঞ্জন-লাভের বাসনা।
আমি কি
রেগে গেছিলাম? বা ভয় পেয়েছিলাম? ও দুটো তো বেশির ভাগ সময়েই একই মুদ্রার এপিঠ আর
ওপিঠ। ফাইট, অর ফ্লাইট।
আমি
নিজেই আশ্চর্য হয়ে শুনেছিলাম আমার কথাগুলো।
“আসলে কী জানিস? এখন আমার ঘুঁটিটা পেকে এসেছে। এখন এই খেলা ছেড়ে অন্য দিকে মন
দিলে, তারপর সারা জীবন আপশোস করতে হবে।
আপশোস
করার মতো জিনিসের লিস্টটা এখনই অনেক লম্বা হয়ে গেছে রে। সেটা আর বাড়াতে চাই না”।
শান্তনু
আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
আর কতদিন
এই ‘পাকা ঘুঁটি ঘরে তোলা’-র পেছনে আমি ব্যয় করব, এটা ও জানতে চায়নি।
তবে আমি
নিজের কাছে জবাব চেয়েছিলাম, এবং নিজেকে একটা ডেডলাইন দিয়েছিলাম, যার মধ্যে সিভিল
সার্ভিস হলে হবে, না হলে গলায় টাই ঝুলিয়ে জিনিস বেচতে বেরিয়ে পড়ব।
তারপর আর
কোনও দিন শান্তনু’র সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।
এক বছরের
মধ্যেই আমি ডব্লিউ.বি.সি.এস এবং আই.এ.এসঃ দুটো নদীই পার করি, আর ব্যারাকপুর ছাড়ি।
তারপর
অন্য জায়গা, অন্য গল্প, অন্য জীবন।
কিন্তু
আজ হঠাৎ এসব কথা কেন?
কারণ আজ
আমি আবিষ্কার করেছি, যে আমি আপশোস করার মতো বিষয়ের তালিকা স্বেচ্ছায় দীর্ঘায়িত
করাটা আবার শুরু করেছি।
আমি রিভিউয়ার
হিসেবে নাম, বা মগনলাল মেঘরাজ-এর মতো বদনাম, কুড়িয়েছি বেশ কিছুদিন হল। ইদানিং
দেখছি, সেই সুবাদে আমার কাছে বাংলা আর ইংরেজিতে বেশ কিছু বইপত্র এসেছে রিভিউ করার
জন্যে।
ইংরেজি
বইপত্র নিয়ে সমস্যা নেই। সেগুলো আমি পড়ি খুব দ্রুত, এবং তালি বা গালি চটপট ওয়েবের
জানলা দিয়ে ছুঁড়ে দিয়েই আমি আবার নিজের পছন্দসই বই নিয়ে কাত হই।
সমস্যা
হয় বাংলা বই নিয়ে।
আমার
স্ত্রী এবং মেয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণ, তাই তাঁরা আমাকে সংসারের একমাত্র নাবালক সদস্য হিসেবে
ট্রিট করেন। কিন্তু তার বাইরে যারা ফেসবুক বা অন্যত্র আমার প্রোপি হিসেবে বিরাজমান
প্রফুল্ল আনন দেখে বিভ্রান্ত হন, তাঁরা আমাকে প্রায়ই বিভিন্ন লেখা পড়তে বলেন
যেগুলো “বড়োদের লেখা” বলে পরিগণিত হয়, অথচ যেগুলো থ্রিলার, ভূতের গল্প, গোয়েন্দা
গল্প, কল্পবিজ্ঞান, রহস্যঃ এসব জঁর ফিকশনের বাইরে।
আমার
পক্ষে এই কাজটা দুঃসাধ্য বললেও কম বলা হয়।
তবু,
নানা বাহানা দিয়ে, এমনকি ‘ট্যাহা
নাই’ বলে আমি ওই ধরণের লেখাপত্তর পড়ার অপচেষ্টা
থেকে নিজেকে বিরত রাখি।
কিন্তু
বিনামূল্যে পাওয়া বই নিয়ে “কী হবে
উপায়”?
ওগুলো
রিভিউ না করলে প্রতি মুহূর্তে আশংকা হয়, এই বুঝি সাহিত্যিক ফেসবুক বা অন্য কোনও
মাধ্যমে আমার নাগাল পাবেন, এবং ক্যাঁক করে আমায় চেপে ধরে জানতে চাইবেন, “এতদিন (আমার বইয়ের রিভিউ নিয়ে) কোথায় ছিলেন?”
বিশ্বাস
করুন, ভাবনাটা এতই উদ্বেগজনক, যে হাতে থাকা গরম চপ-তুল্য থ্রিলারকেও বাসি মুড়ি বলে
মনে হয়।
তাই, পরদিন
ঘুম থেকে ওঠার পর ‘দিনের শুভ সূচনা’-র আশায় ইসবগুল খাওয়ার মতো করে, আজ তেমন দুটো
রিভিউ-অপেক্ষিত বই নিয়ে শুলাম।
ওরে
বাবা!
আমার
প্রথমেই মনে হল, এদের দেয় কে, মানে ছাপে কে?
এই
দুঃখবাদী প্যানপ্যান, যার পাতার-পর-পাতা জুড়ে আছে মেয়েদের/মহিলাদের/বৃদ্ধাদের
আত্মত্যাগ, ছেলেদের/পুরুষের/বুড়োদের লোভী+দুর্বল+হিংস্র+শোষক+প্রবঞ্চক চেহারা, যার
ন্যারেটিভ হল কবিতা-লাইট আর কেন্দ্রীয় চরিত্র হল সানলাইট, মানে শুভ্রতার ঝলক.....
এসব কারা পড়েন?
যাঁরা
পড়েন, তাঁদের মেহফিলে ভুলক্রমে গিয়ে পড়লে আমি যে বর্তমানের আদনান সামি চেহারা থেকে
একেবারে সামি কাবাব হয়ে যাব, এটা গ্যারান্টিড। তাই আগেই সেইসব শ্রদ্ধেয়
পাঠক-পাঠিকাদের কাছে বিনম্র নিবেদন পেশ করছি, আমাকে বিষবৎ পরিত্যাগ করুন, যাতে আমি
আমার ভূত-রহস্যরোমাঞ্চ-সাইফাই-গোয়েন্দা এসব বই পড়ে আর তাই নিয়ে গালি-তালি দিয়েই
এবারের মতো প্রাণে বেঁচে থাকি।
“তাই শান্তনু, আমি আজ থেকে শুধু সেই বই-ই পড়ব, যা পড়তে আমার ইচ্ছে করে। কে কী
চাইল, বা কে কী দিল, সেই নিয়ে আমি আর মাথা ঘামাব না। বাজারে চিন্তাশীল ও মনস্বী
পাঠক আছেন ভূরি-ভূরি। তাদের থেকে অনেক দূরে, কোনও একটা রঙচঙে মলাটের বই নিয়ে আমি
এবার কাত হচ্ছি।
আশা করি
তুই ভালো আছিস”।
চমৎকার লিখেছেন !
ReplyDelete