Sunday 21 February 2016

রুদ্ধশ্বাস সপ্তক: পাঠ প্রতিক্রিয়া

ধরুন, আপনি একজন লেখকের লেখা পড়তে বেশ পছন্দ করেন| মুশকিল হচ্ছে, তাঁর লেখার প্রতি এই ভালোলাগাটা তৈরি হয়েছে কয়েকটা বিশেষ ধরনের গল্প পড়ে, যারা মূলত একটা জঁর-এর অন্তর্ভুক্ত| এবার, যখনই সেই লেখকের কোন নতুন গল্প প্রকাশ পায়, আপনি সেই কয়েকটা বিশেষ গল্প পড়ে হওয়া অনুভূতির মাপকাঠিতে নতুন গল্পটিকেও মাপতে যান| তার ফল কী হয়? যখন লেখক সেই জঁর-এর কিছু লেখেন তখন তালি, আর নইলে গালি! কিন্তু এটা কি সেই লেখকের প্রতি নিদারুণ অবিচার নয়, বিশেষত তিনি যখন গল্পের আকাশে ডানা মেলে সন্ধান করছেন সম্পূর্ণ নতুন ভূখণ্ডের? প্রসেনজিৎ বন্দোপাধ্যায় এমনই এক লেখক, যাঁর লেখার প্রতি এই অবিচার বোধহয় শুধু আমি নয়, অনেকেই করেছেন, কারণ ওনার কয়েকটা জঁর-বন্দি লেখা পড়ে আমার মতো আরও বহু পাঠক ফিদা হয়েছেন ও হয়েই আছেন! তাই লেখক আমাদের মতো বদরাগী পাঠকের কাছে এই নিয়ে কিছু বলতে এলেই আমরা যা বলি তার সরলার্থ: এর জন্যে ওনারই গাওয়া উচিত, দোষ কারও নয় গো মা, আমি স্বখাত সলিলে...|

ধান ভানতে এতখানি শিবের গীত গাইলাম কারণ গতকাল রাত থেকে পড়া শুরু করে, নানা স্থানে (যার মধ্যে হোটেলের অস্বস্তিকর বিছানা, দুপাশে বৃষ্টিভেজা চা-বাগান নিয়ে পড়ে থাকা পিচরাস্তায় দাঁড়ানো সুমো, এয়ারপোর্টের লাউঞ্জ, প্লেনে কোনঠাসা শব্দের বাস্তবায়িত রূপ: সিট, এ সবই আছে) ও কালে যে বইটি আমি শেষ করেছি সেটি প্রসেনজিৎ বন্দোপাধ্যায়-এর সাম্প্রতিক গল্প-সংকলন রুদ্ধশ্বাস সপ্তক| বইটি মাত্র ১৫৭ পাতার পেপারব্যাক| চমৎকার ছাপা, টাইপোর কলংকবর্জিত, এবং সুমন্ত গুহর পরিমিত অলংকরণে সমৃদ্ধ সাতটি গল্পের সংকলন এই বইটি যে আমার খুব-খুউব ভালো লেগেছে শুধু তাই লিখে ভালোলাগাটা ঠিক বোঝানো যাবে না|

আগে লিখি, সাতটা গল্প ছাড়া এই বইয়ে আর কী আছে| আছে এই সময়ের সেরা সাহিত্যিকদের অন্যতম, শ্রী সৌরভ মুখোপাধ্যায়-এর একটি ভূমিকা, যেটি নিয়ে আমি শুধু এটুকুই লিখব যে এমন অসাধারণ বইয়ের জন্যে ঠিক এমন একটি ভূমিকারই দরকার ছিল, যেটি পড়ার পর পাঠক বুঝবেন যে তিনি কী অমূল্য রতনের দ্যূতিতে আলোকিত হতে চলেছেন| যদি আমার কখনও বই ছাপা হয় (ওরকম ভাবে হাসবেন না; টবে ফুলকপি চাষ নিয়ে বই বেরোতে পারে, আর আমার বেলাতেই আপনাদের..) তাহলে সৌরভকে ধরে একখান ভূমিকা আদায় করতেই হবে|

এবার আসি গল্পদের কথায়|

(১) অতঃ সার শূন্য: এই গল্পটি এক বিখ্যাত সাহিত্যপত্রে প্রকাশের পর নানাবিধ কাঁটাছেড়ার মধ্য দিয়ে গেছিল, তাই অধিকাংশ পাঠক গল্পটিকে হয়তো চট করে চিনে ফেলবেন| সেই সময় গল্পটি আমার পড়তে ভালো লাগেনি| ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, কাল রাতে আবার গল্পটা পড়তে গিয়ে বুঝলাম যে লেখক গল্পটায় খুব সূক্ষ্ম কয়েকটা, আর একটা বিশাল পরিবর্তন এনেছেন| এতে লেখাটা বেশি যুক্তিযুক্ত তো হয়েইছে, সঙ্গে লেখার রাফ এন্ড টাফ ভঙ্গিটা খুব মানানসই হয়ে উঠেছে| এর বেশি লিখছি না, শুধু এটুকুই বলার যে যদি গল্পটা আগে পড়ে না থাকেন তবে এই সংকলনের প্রথমেই এটি পড়বেন না| বরং অন্য কটা লেখা পড়ে নিজেকে তৈরি করে রাখুন এই ট্রিট-টির জন্যে|

(২) হাতে রইল তিন: প্রেম, বন্ধুত্ব, ঈর্ষা, আবেগ, যুক্তি, বুদ্ধি, হতাশা, লালসা, ক্রূরতা: এই সব কটি রঙের মিশেলে সেজে উঠেছে এই বইয়ের সবথেকে টানটান, ট্র্যাজিক, এবং প্যাশনেট এই গল্পটি| অন্য কোন লেখকের হাতে এই গল্প যা হতে পারত তা বোঝাতে আমরা চলতি বাংলায় ছড়িয়ে লাট কথাটি ব্যবহার করি, কিন্তু লেখক জমিয়ে দিয়েছেন| শুধু শেষের পাতাগুলোয় পৌঁছবার আগে কয়েকটা অনুচ্ছেদ যদি বাদ দেওয়া যেত...|

(৩) ননিগোপালের ভয়: ভূতের গল্প পড়ে ভয় পেতে চাওয়া পাঠকের আত্মারাম খাঁচাছাড়া করার মতো এই গল্পটি শুধু এই সংকলনের নয়, সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত সেরা ভয়ের গল্প বলে পরিগণিত হতে পারে| গল্পের সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় কিন্তু এটাই যে এই গল্পটি কঠোরভাবে লৌকিক, এবং এর শেষে যে রহস্যটা রয়েছে সেটা সমাধান করার মতো প্রচুর ক্লু লেখক দিয়েই রেখেছিলেন পাঠকের জন্যে|

(৪) জলযাপনের দিনগুলি: এক সাঁতার-ক্লাবের পটভূমিতে প্রেম, ক্রোধ, আর ঈর্ষার এই ঝাঁঝালো গল্পটিও পেশ করেছেন লেখক তাঁর ট্রেডমার্ক তথ্যগত নিষ্ঠা, বর্ণনার বাস্তবিকতা, চূড়ান্ত সাবলীল ভাষা, আর টানটান করে রাখা গতি দিয়ে| বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: গল্পটির সঙ্গে থাকা অলংকরণ দেখে কেউ যদি ভাবেন যে এটি একটি মজার গল্প, তাহলে ভয়ংকর রকম ভুল করবেন|

(৫) ননিগোপালের জুতো: গতবছরের শারদীয়া টগবগ-এর তিনটি সেরা লেখার মধ্যে ছিল এই লেখাটি, যার ছত্রে-ছত্রে মিশে গেছে নিখুঁত বর্ণনা, নিপুণ ব্যঙ্গ, দুরন্ত গতি, আর শেষে আক্ষরিক অর্থে মুখ হাঁ করিয়ে দেওয়া চমক! একবার পড়ুন, বারবার পড়ুন|

(৬) মেঘবরণ: এই গল্পটা নিয়ে আমি যাই লিখি না কেন, গল্পটা পড়ার পর চুপ করে বসে থাকা আমার মনের অবস্থাটা কিছুতেই বোঝানো যাবে না| শুধু এটুকু লিখি: রাগ-বিরাগ-সংরাগ দিয়ে গড়া এই গল্পটা পড়ার পর আপনিও চুপ করে বসে থাকবেন| হয়তো মনে-মনে আপনিও ভিজবেন সেই বৃষ্টিতে, যা মনের অব্যক্ত দুঃখ আর অনুতাপদের অবশেষে বেরিয়ে আসার সুযোগ করে দেয় নিজের আড়ালে অশ্রুকণাদের লুকিয়ে রেখে|

(৭) অ্যাটিনা: অলৌকিকের আড়ালের লৌকিক সত্যিটা কীভাবে প্রকাশ করতে হয়, সে ব্যাপারে লেখকের এই গল্পটিকে ভবিষ্যতে টেক্সট হিসেবে ব্যবহার করা হলে আশ্চর্য হব না| তবে কুকুর লেখকের (এবং আমারও) বড়ো প্রিয়, তাই জানিয়ে রাখি, মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে লেখা লেখকের সেরা লেখাটি কিন্তু এই বইয়ে নেই| শোধ নামের সেই গল্পটি এপার বাংলা ওপার বাংলা-য় সংকলিত, সম্ভব হলে খুঁজে নেবেন অবশ্যই|

তাহলে সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল? দাঁড়াল এটাই যে প্রকাশকের অপেশাদারিত্ব আর পরিকল্পনার অভাবে যাঁরা বইমেলায় বিভা পাবলিকেশন-এর স্টলে গিয়েও বইটি পান নি, যাঁরা বইটি নিয়ে গত কদিনে ফেসবুক আর অন্যত্র হওয়া আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দোলাচলে ভুগছেন যে বইটা পাঠযোগ্য কি না, আর যাঁরা বইটার কথা প্রথম শুনলেন, তাঁদের সবার উদ্দেশ্যে বিনীত আবেদন: ৯১-৯৪৩৪৩৪৩৪৪৬ বা ৯১-৯৭৪৯৭০১৯৮৮-য় ফোন করে প্রকাশকদের উত্যক্ত করে বের করুন বইটা কোথায় পাবেন, হোম-ডেলিভারি সম্ভব কি না, বইটা বিদেশে পাওয়া যাবে কি না, ইত্যাদি, এবং তারপর বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বইটা কিনে ফেলুন|


বিশ্বাস করুন, কেন বইটা নিয়ে এমন হাউমাউ করছি সেটা বইটা পড়ার পরেই বুঝবেন, আর তারপর আপনিও অন্য কোন পাঠককে সন্ধান দেবেন এই রুদ্ধশ্বাস সপ্তক-এর| তাহলে আর দেরি কেন? ফোন করুন, ফোন করুন! ইতিমধ্যে, সেলাম প্রসেনজিৎ!

No comments:

Post a Comment