Wednesday, 3 June 2015

রুক্মিণী

খুব সম্ভবত “দক্ষিণের বারান্দা”-তেই পড়েছিলাম যে অবনীন্দ্রনাথ-এর গল্প লেখার সূত্রপাত হয়েছিল একদিন, ভাইবোনদের সঙ্গে দল বেঁধে জোড়াসাঁকোর বাড়ির বারান্দায়, স্বপ্নে দেখা গল্প লিখে| আমরাও স্বপ্নে কত গল্প দেখি| অবশ্য স্বপ্নে আমরা যা দেখি তার বেশির ভাগ গল্পই আমাদের নিজেদের নানা রকম ভয় আর দুশ্চিন্তার আরেকটু জটিল বা এলোমেলো সংস্করণ মাত্র, যাতে আমরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হই| আমি নিজে যেসব স্বপ্ন দেখি সেগুলো খুবই সাধারণ, এবং একান্তভাবেই ভীতিমূলক, যেগুলো, আমার ধারণা, প্রায় প্রত্যেকেই অজস্রবার নানা ভাবে দেখেছেন (রাস্তায় বেরিয়ে আবিষ্কার করছি: আমি বিবস্ত্র! ট্রেনে টিকিট চেকারের সামনে টিকিট খুঁজে পাচ্ছি না! প্লেনে চেপে বিদেশের এয়ারপোর্টে নামার আগে টের পাচ্ছি যে সঙ্গে পাসপোর্ট-ভিসা এসব কিচ্ছু নেই!)| কিন্তু কাল রাতে আমি একটা খুব ইন্টারেস্টিং স্বপ্ন দেখলাম| স্বপ্নে আমি ছিলাম না (নাকি ছিলাম? কী জানি| চিনতে পারলাম তো|), তবে একটা গোটা গল্প ছিল, একেবারে নাম-টাম সহ| সেই গল্পটা, অতি সামান্য সাজগোজের সঙ্গে পেশ করার জন্যেই এত ভ্যানতাড়া ভাঁজছিলাম|

গল্পটা একটা ছেলের আর একটা মেয়ের| তাদের আলাপ হল একটা ন্যাশনাল পার্কে, বিকেলের শেষ এলিফ্যান্ট রাইডে চড়তে গিয়ে| হাতির পিঠে গ্রুপে চড়তে হয়, আর এরা দুজনেই সেদিন পার্কে এসেছিল একা-একা| তাই, সব গ্রুপ-এর চড়া শেষ হয়ে যাবার পর একেবারে শেষ রাইডে গাইড আর মাহুতের সঙ্গে হাতির পিঠে সওয়ার হল ওরা দুজন| দুজনেই অসম্ভব মুখচোরা আর লাজুক, তাই প্রায় সিঁটিয়ে দু কোণায় যাওয়ার মত করেই বসার চেষ্টা করছিল তারা| কিন্তু হাতি কি আর ওসবের পরোয়া করে? সমুদ্রে ঢেউ তোলা জাহাজের মত করে হাতি এগিয়ে চলছিল ঘাসবন, কাদাজমি আর দূরে নীলচে পাহাড়ের পেছনে অস্তগামী সূর্যের আলোর মধ্য দিয়ে| আর তার পিঠে চাপানো বাক্সের মধ্যে বসে এর ওর গায়ে হেলে পড়তে পড়তে কখন যে ছেলেটা আর মেয়েটা একজন আর আরেকজনের সামনে সহজ হয়ে গেছে, তা তারা খেয়ালই করেনি| যাইহোক, রাইড শেষ হল| হাতি (আসলে হস্তিনী) এবং তার মাহুত ও গাইডকে বখশিস দেওয়া হল| মেয়েটা হাতির শক্ত কাঁটার মত লোমওলা মাথায় আস্তে-আস্তে হাত বুলিয়ে তাকে আদরও করল| কিন্তু পার্কের বাইরে এসেই তারা পড়ল মহা সমস্যায়|

একে তখন সন্ধে নামছে, তায় ঝমঝমিয়ে শুরু হয়েছে বৃষ্টি| শহরে ফেরার কোন গাড়ি না পেয়ে নিরুপায় হয়ে তারা দুজনে কাছাকাছি যেসব হোটেল-রেসর্ট আছে, তাতেই ঘরের সন্ধান করতে লাগল| ট্যুরিস্ট সিজনে অমন হুট করে কি আর ঘর পাওয়া যায়? শেষ অবধি একটা কমনামি রেসর্টের একটাই ঘরে ছেলেটি আর মেয়েটির ঠাঁই হল; অবশ্যই ভদ্রলোকের (ও ভদ্রমহিলার) চুক্তি মেনে ছেলেটি শোবে সোফায়, আর মেয়েটি খাটে| ইতিমধ্যে দুজনের আলাপ একটু-একটু করে জমে উঠেছে| ছেলেটা যেসব কথা কোনদিন কাউকে বলে উঠতে পারবে এমনটাই ভাবেনি, সেগুলো সে গড়গড়িয়ে মেয়েটিকে বলে ফেলেছে| মেয়েটি সেসব কথা শুনে কখনও রেগেছে, কখনও গলা খুলে হেসেছে| এসবের মধ্যে দিয়েই সারা হল ডিনার, বাইরের আলোগুলো একে-একে নিভে গেল, আর কাঁচের জানলা দিয়ে আসা বিদ্যুতের আলোয় ওরা দুজনেই দুজনের অন্ধকার অবয়বকে দূরে না রেখে শেষ অবধি একাকার হয়েই গেল|

রাত ফুরোলেও কিন্তু দুজনের মধ্যে রোমান্সটা ভোরের নরম কুয়াশার মত রয়েই গেল| লজ্জায়, ভয়ে, বা সম্পূর্ণ অন্য কোন অনুভূতির বশে ওরা কথোপকথন চালাতে পারছিল না, কথাগুলো শুরু হয়েই থেমে যাচ্ছিল, কিন্তু দুজনেরই মুখে এমন একটা অদ্ভূত আভা ছড়িয়ে ছিল যে কথাবার্তার আর দরকারই হচ্ছিল না| তারপর দুজনেই শহরে ফিরল| রাতের অত বড় একটা কান্ডের পরেও (আমার স্বপ্নে অন্তত ওটা একটা কান্ডই ছিল, সে আপনারা যাই ভাবুন নাহয়) ওদের আলাপ ফোন, আর কখনও-সখনো দেখার মধ্যেই আটকে রইল অনেক দিন ধরে| ইতিমধ্যে দুজনেই মর্মে-মর্মে বুঝে ফেলেছে যে তাদের সম্পর্কটাকে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই| কিন্তু তার জন্যে যে মস্ত বড় গাঁটটা পেরোতে হবে, তার জন্যে তো ওপরমহলের অনুমতি চাই| মেয়েটা একটা মেস-এ থেকে একটা খুবই ছোট চাকরি করে| ছেলেটা নিজের বাড়িতে বাবা-মা’র সঙ্গে থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরির পরীক্ষা দেয়| তাই লজ্জায় রাঙা হয়েও একদিন মেয়েটাই এল ছেলেটার বাড়ি “কথা” বলতে|

ছেলেটা মেয়েটাকে বাইরের ঘরে বসাল| তারপর সে ভেতরে গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বাবা আর হোমমেকার মা-কে সবকিছু খুলে বলে যখন বসার ঘরে নিয়ে এল [বীরপুরুষের দ্বারা যে এই কথাগুলো আগে তার বাবা-মা’র কাছে উথ্বাপিত হয়নি, তা বলাই বাহুল্য], তখন কিন্তু মেয়েটি সেই ঘরে ছিল না| ছেলেটি খুব অবাক হয়ে ফোনে মেয়েটিকে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল| তারপর যোগাযোগ করার অন্য চেষ্টাগুলোও একে-একে ব্যর্থ হল| ছেলেটি এক রকম হন্যে হয়ে মেয়েটির খোঁজ করার চেষ্টা করবে ভেবেও এগোতে পারছিল না, কারণ তার সব থেকে বেশি আকাংক্ষিত চাকরির পরীক্ষা তখন দরজায় কলিং বেল টিপছে| বিশাল লম্বা পরীক্ষা প্রক্রিয়া যদ্দিনে শেষ হল, তদ্দিনে ছেলেটি ফোন করে, আর সময় পেলেই মেয়েটি যে মেসে থাকত সেই মেসের অন্য বাসিন্দাদের প্রায় জেরা করে নিজের মত করে সন্ধান চালিয়েছিল| কিন্তু মেয়েটির কোন সন্ধান সে পায়নি| সে ছিল মোবাইল-পূর্ব যুগ (আহা, স্বপ্নকে আপ-টু-ডেট হতেই হবে তার কি কোন গ্যারান্টি আছে?), তাই অন্তত তাতে তোলা মেয়েটির কোন ফটোও ছিলনা ছেলেটির কাছে, যা দিয়ে অন্য কোনভাবে খোঁজখবর নেওয়া যায়| তারপর রেজাল্ট বেরোল, ছেলেটি চাকরি পেয়ে পাড়ি দিল অনেক দূরে| আর ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো ফরফরিয়ে উল্টে গেল দিন-মাস-বছর ঘোরার ইঙ্গিত দিয়ে|

অনেক দিন কেটে গেছে| প্লেন আর এ.সি. কামরায় অভ্যস্ত ছেলেটি নেহাত দায়ে পড়ে (এই শহরে ট্র্যাফিক জ্যাম এতই কুখ্যাত যে লোকাল ট্রেনেই চলাফেরা করার পরামর্শ তাকে দিয়েছিল সবাই) সেদিন ট্রেনে করে অচেনা শহরে কোথায় যেন যাচ্ছিল| হঠাৎ উল্টোদিকে বসে থাকা এক মহিলার দিকে ছেলেটার নজর গেল| সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত হলেও, এবং মনের কাঁচে বহু-বহু বছরের ধুলো পড়লেও, তার সেই হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাকে চিনতে পারল ছেলেটি| কিন্তু তারপরেই সে পড়ল কঠিন সমস্যায়| একদিকে তার বুকের ভেতর আগ্নেয়গিরি থেকে উৎক্ষিপ্ত লাভার মত উঠে আসতে চাইছে প্রশ্নের ঝাঁক, যাদের কাটছাঁট করলে এটাই দাঁড়ায়: “কেন? কেন? কেন?”, অন্যদিকে সে বুঝতে পারছে যে সময়, পরিবেশ, এমনকি তার নিজের পরিচয়, কোনটাই সেই উদগীরণের পক্ষে অনূকুল নয়| এমন সময় ভিড়ের ফাঁক দিয়ে একটি টিনএজার মুখ বাড়িয়ে মহিলাকে কিছু বলল, আর শেলফে রাখা একটা ব্যাগ নামাল| দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের চলন থেকে ছেলেটি বুঝতে পারল যে মহিলা এবার নামবেন| মহিলা উঠে দাঁড়াতেই একজন সেখানে বসার চেষ্টা করলেন, অন্যরা কেউ এগোলেন, কেউ পেছলেন, কিন্তু তার মধ্যেও ছেলেটি আর থাকতে না পেরে মেয়েটির নাম ধরে ডেকে উঠল|


মহিলাটি ভীষণ চমকে উঠে ছেলেটির দিকে তাকালেন| আর তারপর তাঁর মুখে সেই লজ্জা-বিস্ময়-ভয় মেশান হাসিটা ঝিকমিকিয়ে উঠল যেটা দেখে ছেলেটি সেই প্রথম দিন বিকেলেই তার মন দিয়ে দিয়েছিল| কিন্তু কথা বলার সময় ছিল না, কারণ ট্রেনের গতিবেগ তখন কমে আসছে, মানে স্টেশন সামনেই| মহিলা আর ছেলেটিকে বলে উঠতে পারলেন না, যে সেদিন ছেলেটির বসার ঘরে বসে তার বাবার ছবি দেখে তিনি নিজের এক মামাকে চিনতে পেরেছিলেন, আর তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাদের সম্পর্কটা সামনে এলে প্রলয় আসবে দুটি পরিবারেই| তাই নিজের পুরনো জীবনকে পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন অনেক-অনেক দূরে, এক নতুন জীবনের সন্ধানে| কিন্তু ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি একটা কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন| নিজের মেয়েকে ডেকে তিনি শুধু বললেন: “ইনি আমার খুব কাছের মানুষ| এঁকে প্রণাম করো|” টিনএজার মেয়েটি এই কথায় একটু হকচকিয়ে গেলেও মায়ের কথা মানল| ট্রেন স্টেশনে দাঁড়াল| হুড়মুড় করে নামা যাত্রীদের সঙ্গে মা-মেয়ে নেমে গেলেও ছেলেটি ভিড়ের মধ্যে তাদের খোঁজার চেষ্টা করছিল| মহিলা ট্রেনের জানলার কাছে এসে ছেলেটির চোখে চোখ রেখে বললেন, “আমার মেয়ের নাম রুক্মিণী| তুমি ভালো থেকো|” তারপর ট্রেন ছেড়ে দিল|

দুলতে থাকা ভিড়াক্কার কামরার মধ্যে হতবুদ্ধি হয়ে বসে থাকা ছেলেটি দুটো প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিল| প্রথমত, মেয়েটার মুখে কেমন যেন একটা চেনা আদল রয়েছে, যেটা তার মায়ের থেকে আলাদা; এমনটা কেন মনে হচ্ছে? দ্বিতীয়ত, রুক্মিণী নামটা ওদের মধ্যে, এমনকি এই প্রদেশেও, খুব একটা প্রচলিত নয়; তাহলে এমন নামকরণ কেন? এই ভাবনার ঘূর্ণিঝড়-এর মধ্যে কখন যে ছেলেটি তার গন্তব্যে পৌঁছল, তার তা মনেও নেই| কিন্তু বাথরুমে গিয়ে, চোখে-মুখে-গলায়-ঘাড়ে জলের ঝাপটা দিয়ে মুখ মুছতে গিয়ে বিদ্যুতচমকের মত একটা স্মৃতি তার মনের অন্ধকারে ঝলসে উঠল| যে হাতির পিঠে চড়ে ওরা সেদিন ন্যাশনাল পার্কে ঘুরেছিল, তার নাম ছিল রুক্মিণী| আর তখনই, আয়নার দিকে তাকিয়ে, হতাশার অন্ধকারে আরও একবার তলিয়ে যেতে-যেতে ছেলেটি বুঝতে পারল, কেন মেয়েটার মুখের কিছু অংশ তার এত চেনা লেগেছিল|

No comments:

Post a Comment