ঠাকুর্দার মুখে শুনেছিলাম যে দেশভাগ, এবং উদ্বাস্তু
হয়ে এদেশে আসার আগে, আমাদের পারিবারিক পেশা নাকি ছিল পৌরোহিত্য ও কথকতা|
পরবর্তীকালে রুজির বন্দোবস্ত করার জন্যে পরিবারের সদস্যদের নানা পন্থা বেছে নিতে
হলেও এটা আমি ছোটোবেলাতেও দেখেছিলাম, যে অবিভক্ত গাঙ্গুলি-পরিবারের বিভিন্ন
অনুষ্ঠানে এমনকি রসিকতার ছলেও পৌরাণিক প্রসঙ্গ এসে যায়| খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার
হাতে, কার্যত অক্ষর-পরিচয়ের পরেই, এসেছিল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর “ছেলেদের
রামায়ণ” আর “ছেলেদের মহাভারত”| প্রথমটি
সেই শৈশবেই কিঞ্চিৎ সরলীকৃত (অতএব তুচ্ছ) ঠেকলেও শেষোক্ত মহাকাব্যটি আমাকে যুগপৎ
কৌতূহলী ও বিস্ময়বিহবল করে তুলেছিল তার জটিলতায়, যার কাছে ঠাকুমার সঙ্গে সিনেমা (রাজা
হরিশ্চন্দ্র, সীতার বনবাস, ইত্যাদি) দেখতে গিয়ে মোকাবিলা করা নানা ঘটনাক্রম
নিতান্তই তুশ্চু বলে মনে হত| বয়স বাড়ার সঙ্গে প্রথমে পড়লাম ‘অমর চিত্র কথা’-য়
খণ্ড-খণ্ড আকারে বিভিন্ন উপাখ্যান, আর তার কিছুদিন পরেই টেলিভিশনের পর্দায় জাঁকিয়ে
বসল বি.আর.চোপড়া-র মহাভারত|
স্রেফ গল্প-পড়ার তাগিদে মহাভারতের নানা রকম সংক্ষিপ্ত
ও সংক্ষিপ্ততর সংস্করণ এরপর কিনেছি ও পড়েছি, নিজের মতো করে বিভিন্ন চরিত্র ও
তাঁদের পরিণতি নিয়ে ভেবেওছি| তবে, এবার ‘ব্ল্যাকবোর্ড’
পত্রিকার উত্সব সংখ্যার থিম ‘মহাভারত’ বলে তাতে লেখা
পাঠানোর জন্যে, অনেক দিন পর, এই মহাকাব্যটির একটি বিশেষ অংশ নিয়ে পড়াশোনা করতে
বাধ্য হই| আর তার পরেই মহাভারতের বৌদ্ধিক দিকটা নিয়ে পড়ার আগ্রহটা আমার মধ্যে ফিরে
আসে, যেখানে গল্পের মাদকতার পেছনে ছোটা নেই, নেই চোখ-ধাঁধানো বর্ণনার বিলাসে ডুবে
যাওয়া, কিন্তু আছে মানব জীবনের অন্তর্নিহিত অর্থের সন্ধানে স্থিতধী পথচলা|
বাজারে এমন বইয়ের অভাব নেই, যেগুলো মহাভারতের বিশ্লেষণ
করে তাতে এমন অনেক লুকিয়ে থাকা মাত্রা ও তাত্পর্যের সন্ধান দিয়েছে, যা এই প্রায়
দুই সহস্রাব্দী পার করা মহাকাব্যকেও সম্পূর্ণ নতুন আলোয় দেখতে সাহায্য করে| কিন্তু
আমার অবস্থা তখন অঞ্জনের সেই গানের মতো:
“আমার শুধু ছিল-আছে
কাঠখোট্টা বাস্তবটা, দিবারাত্রি আপোষ আর আপোষ,
রবীন্দ্র কি গণসঙ্গীত কোনটাই ঠিক দিচ্ছিল না,
বুকের ভেতর রেগে ওঠার রোষ|”
তত্ত্বকথা নয়, আমার মতো পাঁড় গল্পপ্রেমী
চাইছিল গল্পের মধ্য দিয়ে সত্যানুসন্ধান, আর সেটি যে কী ভীষণ কঠিন কাজ তা সবাই
জানেন| এবার একে সমাপতন বলা উচিত না কপালক্রম তা জানি না, কিন্তু ঠিক তখনই ১৪২২-এর
শারদীয়া দেশ-এ প্রকাশিত, আমার অত্যন্ত প্রিয় সাহিত্যিক সৌরভ মুখোপাধ্যায়-এর লেখা,
একটি গল্প নিয়ে ফেসবুক তেতে উঠল|
ফেসবুক নামক চায়ের পেয়ালা এসে অবধি তর্কপ্রিয়
বাঙালির তুফান তোলার মস্ত একটা জায়গা করে দিয়েছে ঠিকই, তবে এবারের আলোচনাটা ছিল
প্রশংসাসূচক| শারদীয়া পড়ার ক্ষেত্রে আমি সচরাচর ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর
রিকশাওয়ালার পদ্ধতি নিই, মানে শিশু-কিশোর সাহিত্যের হলে পড়তেই হবে, অন্য ক্ষেত্রে “হামি
গরিব আদমি আছে”| কিন্তু এই লেখাটা নিয়ে ভালো-ভালো কথা না
থেমে চলেছে-তো-চলেইছে, আর এও পড়তে পাচ্ছি যে লেখাটা মহাভারতের একটি বিশেষ মুহূর্ত
নিয়ে| যখন এও জানলাম যে এই লেখাটি বিচ্ছিন্ন নয়, বরং এযাবৎ মহাভারতের কোন-না-কোন
বিশেষ সময় নিয়ে লেখকের এটি তৃতীয় লেখা, তখন আর পারা গেল না| আমি এমনিতে পি.ডি.এফ-এর
মাধ্যমে বই পড়ার বিরোধী হলেও এবার একে-একে ডাউনলোড করতে বাধ্য হলাম শারদীয়া
আনন্দবাজার পত্রিকা ১৪২০, শারদীয়া দেশ ১৪২১, এবং শারদীয়া দেশ ১৪২২. এই তিনটি
পূজাবার্ষিকীতে পড়া তিনটি ‘মহাভারতীয়’ গল্প পড়ে আমার
যে প্রতিক্রিয়া, তাই নিয়েই আজকের এই ভ্যাজর-ভ্যাজর|
(১) অবরোহিণী: ২০১৩-য় প্রকাশিত
এই গল্প আয়োজিত হচ্ছে মহাভারতের শেষ মুহূর্তে, যখন মহাপ্রস্থানের পথে যুধিষ্ঠির
একা রয়েছেন সুমেরুর পথে, আর পতন হয়েছে বাকিদের| কিন্তু এখানেই গল্প বাঁক নিয়েছে এক
নতুন দিশায়, যার সন্ধান পেতে গেলে আপনাকে লেখাটা পড়তে হবে| তবে আমার
পাঠ-প্রতিক্রিয়া এরকম:
Ø শংকরের
লেখায় পড়েছিলাম যে শরদিন্দু তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার আগে
সংস্কৃত শেখার| পৌরাণিক লেখার ক্ষেত্রেও যে সেই ঋষিবাক্য কঠোরভাবে পালনীয়, সেটি
অক্ষরে-অক্ষরে বুঝলাম এই লেখা পড়তে গিয়ে| এমনিতেই সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের গদ্যভাষা
নান্দনিকতার শিখর ছুঁয়েও সহজবোধ্য থাকে বলে আমি তাঁর লেখার ভক্ত| কিন্তু এই সংস্কৃত-ব্যঞ্জনায়
মুখর অথচ শাণিত অসির মতো যুক্তিনির্ভর ভাষা পড়ে আমি স্রেফ স্তব্ধবাক হয়ে রইলাম|
কিছুক্ষণ কথা বললাম না, ফোন ধরলাম না, স্রেফ পঠনের অভিজ্ঞতাটা ধরে রাখতে চাইলাম নিজের
মনে|
Ø লেখাটি
বড়ো বেশি একতরফা, এবং বিশালাকার সংলাপ-নির্ভর বলে আমার মনে হয়েছে| শিশিরকুমার
দাসের “অলৌকিক
সংলাপ” আমায়
মুগ্ধ করেছিল এই জন্যে যে তাতে হেলেনের যুক্তিতে তীক্ষ্ণ ও ক্রোধে উত্তপ্ত প্রশ্ন
বা আরোপ, এবং রাম-এর নমনীয়, স্নিগ্ধ, অথচ ভাগ্য-বিড়ম্বিত উত্তর, দুইই ছিল
সংক্ষিপ্ত| এখানে সেটা না হওয়ায় রসভঙ্গ হয়েছে বলেই আমার ধারণা|
Ø সর্বোপরি,
এক জনকে কুকর্মের চক্রী সাব্যস্ত না করে কথোপকথনটা চালালে তা বোধহয় এই মহাকাব্যের সঙ্গে
আরও মানানসই হত| তবে গল্পের পরিণতি, কিছুটা অতিকথিত হলেও, একে এক অন্য স্তরে
উত্তীর্ণ করেছে|
(২) উত্তরফাল্গুনি:
২০১৩-র কাহিনি মহাভারতের যে বিন্দুতে সংঘটিত হয়েছে, ২০১৪-র কাহিনি কিন্তু তার
তুলনায় পিছিয়ে এসেছে সেই ক্ষণে, যখন দ্বারকা থেকে যাদব কুলনারীরা চলেছে
হস্তিনাপুর, অর্জুনের প্রহরায়| এখানেও গল্প বেদব্যাসকে উল্লঙ্ঘন করে চলে গেছে এক
অন্য পথে, আর এক্ষেত্রেও আমি পাঠককে লেখাটি পড়ে রসাস্বাদন করতে অনুরোধ করব| ভাষা
নিয়ে আমার মুগ্ধতার পুনরাবৃত্তি করব না| তাছাড়া এই লেখাটি আমার কার্যত
সর্বাঙ্গসুন্দর লেগেছে| চরিত্রবর্ণন, নির্মেদ ঘটনাক্রম, পরিমিত-অথচ-নির্মোহ সংলাপ,
এবং পরনির্ধারিত সর্বব্যাপী অন্ধকারের মধ্যে স্বীয় ভাগ্যনির্মাণের তিমিরবিদারী
প্রয়াস: একটি গল্পে লেখকের কাছ থেকে এর বেশি আর কী চাইতে পারি আমি?
(৩) শেষ
সূর্যোদয়: ২০১৫-র এই কাহিনি পিছিয়ে এসেছে আরও, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের
চতুর্দশ দিনের ভোরে| জ্ঞানী পাঠক চট করে বুঝে নেবেন ঠিক কোন দিনটির সূচনালগ্ন নিয়ে
লেখক এবারে আমাদের উপহার দিয়েছেন শক্তি, সাহস, ভীরুতা, প্রেম, লজ্জা, গর্ব, আর অমরত্বের
অভিলাষ-পূরণের জন্যে সর্বস্ব পণ করার এক আশ্চর্য উপাখ্যান| আমার প্রতিক্রিয়া? আকাশচুম্বী
গিরিশৃঙ্গ থেকে পতনোন্মুখ আরোহী যেমন ভয়ংকর সুন্দরের ডাকে মরণকে উপেক্ষা করে, আমিও
তেমন এই গল্পের আপাত-অবাস্তবতা আর নারী চরিত্রটির ম্লান (এবং পার্শ্ব) উপস্থিতি
ভুলে এখনও বুঁদ হয়ে আছি তার ভাষা, আর মূল চরিত্রের ট্র্যাজেডির গভীরতায়| কাল সকালে
যদি নেশা কাটে, নাহয় আরও কিছু লিখব| আপাতত শুধু এটুকুই লেখার: সৌরভ, আপনার লেখার
সুরভি এমনি করেই মহাভারতের বিপুল ঐশ্বর্য আমাদের মতো দীন পাঠকের মাঝে বিলিয়ে দিক,
বছরের-পর-বছর|
No comments:
Post a Comment