গত পুজোর আগে-পরে বেশ
কয়েকটা পূজাবার্ষিকী কিনলেও একটা বিশেষ পত্রিকা হাতে নিয়েই মনটা ছেলেমানুষি খুশিতে
ভরে গেছিল: “টগবগ উৎসব সংখ্যা ১৪২২”|
পত্রিকাটির মলাট খুব সহজ অথচ রঙিন| পাতাগুলো বেশ মোটা, আর বাঁধাই চমত্কার|
সর্বোপরি পত্রিকাটির লেখা পরিবেশনের পদ্ধতি অনাড়ম্বর হলেও আক্ষরিক অর্থে
চোখ-জুড়োনো| ঠিক করেই রেখেছিলাম যে হুড়মুড় করে না পড়ে পত্রিকাটা পড়ার জন্যে ক’দিন অপেক্ষা করব| ২০১৬-র
প্রথম দু’দিন
পত্রিকাটি পড়ার সুযোগ করে দিল, আর আমিও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ফেললাম| তবে
ফুরফুরে মনে পড়তে গিয়েও পত্রিকাটির এই বিশেষ সংখ্যা নিয়ে দুটো প্রশ্ন মাথায়
ঘোরাঘুরি করেছিল:
(১) যথেষ্ট সম্ভ্রম-উত্পাদক
ঐতিহ্য থাকলেও পত্রিকার এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন রূপে, একঝাঁক
সাহসী ও স্বপ্নময় মানুষের উদ্যোগে| এই পত্রিকার ওপরে আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা রয়েছে
বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত প্রায় সব মানুষের| তাঁদের, এবং প্রকাশকের
প্রয়াস সফল করে আজকের ছোটোদের তেপান্তরের মাঠের ওপার থেকে কি ঘুরিয়ে আনতে পারবে ‘টগবগ’?
(২) এই পত্রিকার সম্পাদক
এবং শিশুসাহিত্যের নীরব ও প্রচারবিমুখ সেবক শ্রী সরল দে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন
মাত্র কয়েক দিন আগে| এই অবস্থায় তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত সম্ভবত শেষ পত্রিকাটির
নির্মোহ মূল্যায়ণ করাটা কি এই মুহূর্তে উচিত হবে?
একবার মনে হয়েছিল যে
খারাপ লাগা লেখাগুলো নিয়ে কিছু না লিখে শুধু ভালো লেখা নিয়ে ভালো কথা বলে ছেড়ে
দিই| কিন্তু তারপর ভাবলাম যে নেভিল কার্ডাসের পদ্ধতি যেমন আজকের ক্রীড়া-সাংবাদিকতায়
অচল, তেমনই ওই কৌশলী লেখা আমার মগজ থেকে বেরোবে না| অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্তেই এলাম
যে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্য আবেগ বা ক্ষণিকের বিহ্বলতার চেয়ে অনেক বড়ো ব্যাপার,
আর আমার ভালোবাসার সেই জায়গাটা নিয়ে সোজা কথা স্পষ্ট করে লিখে দেওয়াটাই মঙ্গল|
সম্পাদকীয় লেখা ‘ছুটছে টগবগ’ এই পত্রিকার
যাত্রাপথের একটা সরলীকৃত ও আশাবাদী ছবি তুলে ধরলেও সেটা পড়ে (টার্গেট অডিয়েন্স,
অর্থাৎ ছোটোরা যদি আদৌ সেটা পড়ে) বেশ হতাশ হতে হয়| বাজারে আরও গাদা-গাদা পত্রিকা
থাকতেও কেন এই বিশেষ পত্রিকায় নতুন করে প্রাণপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হল, ঠিক
কোন-কোন ভাবনা নিয়ে এই পত্রিকা অন্যদের থেকে আলাদাভাবে শিশু-কিশোরদের মনে তুফান
তুলতে চায়: এসব কিছুই পেলাম না লেখাটায়|
সম্পাদকীয় পেরিয়ে মূল
পত্রিকায় ঢুকেই আমি ধাক্কা খেতে শুরু করলাম| কেন?
Ø প্রথম
লেখাটিই গৌরী ধর্মপাল-এর লেখা “পুরোনতুন রামায়ণ”, এবং
সেটি পড়ে আমি প্রায় স্তম্ভিত হলাম এই ভেবে যে এমন একটি কিম্ভূতকিমাকার জিনিস যদি গৌরী
ধর্মপালের মতো (একদা) অনাবিল রূপকথা-রচনাকার দৈবক্রমে লিখেও থাকেন, তবে এটিকে
পত্রিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হল কি শুধু লেখকের নাম ও পত্রিকার সঙ্গে তাঁর পুরনো
সম্পর্কের বশে?
Ø এরপরের,
এবং অত্যন্ত দুর্বল লেখাটি হল পবিত্র সরকার-এর “ব্যোমকেশবাবু ভি আই পি”| তার পরের লেখা, মানে উদয় নারায়ণ সিংহ-র “বেল পাকলে” পড়তে গিয়ে আমার মনে
হল লেখক নিশ্চই কোনভাবে একটা টাইম-ওয়ার্প-এ ঢুকে পড়েছেন, ফলে তাঁর মনে হচ্ছে যে
তিনি এখনও সেই সব খোকাখুকুর জন্যে লিখছেন যারা সত্তর, কি বড়োজোর আশির দশকের
বাসিন্দা| এই সমস্যা প্রকটতর হয়েছে গৌর বৈরাগী-র “তৈলাক্ত বাঁশ আর বাঁদরের গল্প”, অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী-র “জলদেবতার নৌকো”, আর অমর মিত্র-র নাটক “নিমকি বুঁদে লেডিকেনি”-তে, যে জিনিস আজকের কোন স্কুলে-কলেজে-পাড়ায় অভিনয়ের
প্রসঙ্গ উঠলে “ঘুড়ায়
হাসব”|
এবার আমি সেই সিরিয়াসলি
মন খারাপ করে দেওয়া লেখাগুলোর প্রসঙ্গে আসছি যেগুলো পড়লে সময় নষ্ট তো হবেই, রাগে ও
বিরক্তিতে দাঁতে ব্যথা, মাসল-ক্র্যাম্প, এমনকি রাত-বিরেতে প্রকাশকের উদ্দেশ্যে
ঝাঁঝালো মেইল দেওয়ার বাসনা জাগতে পারে| তেমন “বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ”-সম্বলিত লেখাগুলো হল:
১. মুহম্মদ জাফর
ইকবাল-এর “টি-রেক্সের
সন্ধানে”: আমার
অত্যন্ত প্রিয় লেখকের এই লেখাটা পড়ে অবধি আমি এটাই ভেবে চলেছি যে কোন যুক্তিতে এই
উপন্যাস (বিশেষত এর প্রথমার্ধ) শিশু-কিশোর সাহিত্য বলে বিবেচিত হল| দ্বিতীয়ার্ধ
ভালো, কিন্তু সেটিও এত দুর্বল যে তার তুলনায় অনেক ভালো লেখা অনামা পত্রিকায় ছাপা
হয়ে নজরের আড়ালে চলে যায়| এটা কি বাংলাদেশের বাজার ধরার কোন কৌশল?
২. মিমি
রাধাকৃষ্ণণ-এর “প্রশান্ত
কুমারের প্রতিশ্রুতি”: একে তো
একটা ব্যবহৃত হতে-হতে শুয়োরের মাংস হয়ে যাওয়া আধ পাতার প্লটকে ফাঁপিয়ে ৪০+পাতার
উপন্যাস বানানো হয়েছে, তাতে লেখক যে ঠিক কোন পত্রিকার জন্যে লিখছেন (মানে নবকল্লোল,
সানন্দা, বর্তমান, নাকি টগবগ) সেটা তিনি নিজেও জানতেন বলে মনে হয়নি| এই থার্ড
ক্লাসের অধম লেখার লেখকের নাম যদি এরপর কোন সংখ্যায় সূচিপত্রে দেখি তাহলে পত্রিকার
দপ্তরের বাইরে ক্যাম্পেন করতে হবে|
৩. দেবজ্যোতি
ভট্টাচার্য-র “মেঘরৌদ্রের
খেলা”: এটা কি
পাঠকদের নিয়ে কোন বিশ্রী ঠাট্টা ছিল? ২০১৩-র পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত, সৌরভ
মুখোপাধ্যায়-এর লেখা যে উপন্যাস “মেঘ-ছেঁড়া রোদ” পড়ে বুকের
ভেতরটা হু-হু করে উঠেছিল আর চোখের কোনটাও গেছিল ভিজে, এই দানবাকৃতি উপন্যাসটি কি
তার স্পুফ? এই অদ্ভূত ও একটিও সকর্মক উদ্দীপনা-জাগরণে অক্ষম বিরাট লেখাটাও শেষ
করেননি লেখক, ছেড়ে দিয়েছেন আঁধ-খেঁচড়া করে|
আর না| আর এসব রদ্দি
ও অচল মাল নিয়ে ভাবব না| বরং এবার লিখি ভালো লাগা ফিচার আর গল্প গুলোর কথা: -
১. শিশির বিশ্বাস-এর “আলেকজান্ডারের শিবিরে
এক আগন্তুক”: ময়ূখ
চৌধুরীর ভক্তরা এই গল্পটা চট করে বুঝে নেবেন, কিন্তু তবুও লেখাটা পড়তে ভালো লাগবে|
২. মল্লিকা ধর-এর “সীমান্তপারের বন্ধু”: কল্পবিজ্ঞান নয়,
বিশুদ্ধ ফ্যান্টাসি, তবে পড়তে ভালো লাগে|
৩. দেবাশিস
বন্দোপাধ্যায়-এর “জঙ্গল.
এর নাম জঙ্গল”:
প্রেডিক্টেবল, তবে পড়তে মন্দ লাগে না|
৪. অরিন্দম বসু-র “বিশ্বরঞ্জনের ব্যথা”: মন ভালো হয়ে যায়
এমন গল্প পড়লে|
৫. প্রবীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়-এর “ভয়ের নাম
গলগাথা”: শুধু দ্রুতগতিসম্পন্ন
নয়, এই বড়োগল্পে বেশ কিছু ভাবনার খোরাক আছে যা আজকের বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকের মনে ধরবে|
৬. বিমান নাথ-এর “প্রাচীন ভারতে শূন্য
আবিষ্কার”
৭. কালীপদ
চক্রবর্তী-র “সুমো
কুস্তিগিরের গল্প”
৮. অপূর্ব
চট্টোপাধ্যায়-এর “সত্যান্বেষণে
মাছি”
৯. প্রসেনজিৎ
দাশগুপ্ত-র “পুরীতে
পুরাতত্ত্ব”
১০. শ্যামল
চক্রবর্তী-র “ ‘আজব’ জ্যামিতির কারিগর”
১১. শ্রী শাম্ব-র
কমিকস “দ্রিঘাংচু”
১১. কবিতার পাতা,
যাতে অনেক পড়ার মতো ছড়া-কবিতা থাকলেও একবার পড়ুন, বারবার পড়ুন প্রকল্প
ভট্টাচার্য-র কবিতাটি| কেন? পড়েই দেখুন একবার|
এবার বলি সেই লেখাগুলোর
কথা যেগুলো পড়ার পর আকাশটা আরও একটু নীল মনে হবে, রোদ্দুরটাকে ঝকঝকে ঠেকবে, আর
বাতাসে পাওয়া যাবে সেই শুকনো ধুনোর গন্ধটা যেটার জন্যে আমরা সারা বছর মুখিয়ে থাকি|
সেই লেখাগুলো হল:
(১) দোয়েল
বন্দোপাধ্যায়-এর “চিন্তাহরণ”
(২) প্রসেনজিৎ
বন্দোপাধ্যায়-এর “ননিগোপালের
জুতো”
এদের নিয়ে, এত অল্পে
কিছু লিখলে গল্পগুলোকে অপমান করা হবে| তাই আমি এই পত্রিকার সেরা, একেবারে আল্টিমেট
বেস্ট গল্পটার কথা উল্লেখ করে ইতি টানব, আর সেই গল্পটা হল: সৈকত
মুখোপাধ্যায়-এর “টমটম চলছে”| এই গল্পটা, বিশেষত এর শেষ লাইনটা
নিয়ে যতবার ভাবছি ততবার চোখটা ঝাপসা হচ্ছে, আবার বুকটা ভরেও উঠছে টাটকা বাতাসে| আর
হ্যাঁ, সূচিপত্রে এনার নাম থাকলে আমি পত্রিকাটা কিনবই (বোধহয় অন্যরাও) ও পড়বই,
তাতে যদি এর আগে আলোচিত অখাদ্য-প্রস্তুতকারকদের লেখা পিন দিয়ে স্টেপল করতে হয়, তো
ভি সহি|
তাহলে শেষ বিচারে কী দাঁড়াল? পারবে কি এই পত্রিকা আজকের ছোটোদের কাছে একটা নতুন জানালা খুলে দিতে? আমার উত্তর: হ্যাঁ, পারবে| সম্পাদক যদি আরও নির্মম হন, মুদ্রণের ক্ষেত্রে এই পারিপাট্য যদি অক্ষুণ্ন রাখা যায়, আর কল্পবিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসিকে যদি আর একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া যায়, তবে এই পত্রিকা শিশু-কিশোরদের ভালো লাগবে: এমনটাই আমার বিশ্বাস|
উরেব্বাস রে! এমন সপাট নিপাট সমালোচনা কতদিন পড়িনি! আমার পক্ষে দমবন্ধ করা উত্তেজনারও বটে। পড়ছি আর প্রতি মুহূর্তে ভাবছি এই বুঝি নেক্সট জুতোটাই আমার গালে গিয়ে বসল।
ReplyDelete.
কিন্তু শেষরক্ষা পেয়ে দারুণ লাগছে! :-)