Friday 29 January 2016

'সৃষ্টি' এবং গল্পের রাত

বইমেলা শুরু হওয়ার পর দিন তিনেক পেরিয়েছে| মেলা-উপলক্ষে হওয়া আড্ডার এবং জন-সমাগমের ছবি ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুকে| আর আনন্দ নিয়ে গেছে ওরা সকলে, দুঃখটা থাক নয় শুধুই আমার স্টাইলে গুয়াহাটিতে পড়ে আছি আমি| এই মন-খারাপ ভাবটা কাটানোর জন্যে কাল রাতে আমার নিত্যপাঠের (ভূত, রহস্য, রোমাঞ্চ, কল্পবিজ্ঞান, ফ্যান্টাসি) বাইরের দুটো বই তুলে নিয়েছিলাম| দুটো বই-ই আমাদের আদরের প্রকাশনা সৃষ্টিসুখ থেকে প্রকাশিত গল্প-সংকলন, গত বইমেলার সময়ে কেনা (যেকোন গ্রন্থকীটের মতো আমারও পড়তে হবে বলে কেনা বইয়ের সংখ্যা পড়া হয়েছে-র তুলনায় অনেক বেশি) হলেও নানা রকম অমনিবাস আর সমগ্র-র ভিড়ে ঘাপটি মেরে ছিল বলে হাতে আসেনি| বইদুটো সুমুদ্রিত, ছিমছাম, এবং শ্রদ্ধেয়া বাণী বসুকে উদ্ধৃত করে বলতে গেলে, বাইরে শুকনো, ভেতরে মধুর বয়ামের মতো ভারী| বইদুটো পড়ে শেষ করতে রাত তিনটে বাজল| আর তাদের পড়ে কেমন লাগল, সেই নিয়ে লেখার জন্যেই এই পোস্ট|

প্রথম বইটি হল পাঁচটি নভেলা, যাতে আছে:
(১) সৈকত মুখোপাধ্যায়-এর বেদনার রঙ: এই লেখকের বিশেষত্ব এটাই যে তাঁর আপাত সুখপাঠ্য এবং দ্রুতগামী অশ্বের মতো শিহরণ-জাগানিয়া গদ্য প্রায়শই আমাদের এমন অন্ধকারে নিয়ে যায় যেখানে আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু ভাবটা প্রগাঢ় হয়ে ওঠে আর পাঠকের অজান্তেই তাঁর জগৎ বিষিয়ে যায় কালচে নীল রঙে| এই গল্পটি খানিকটা তেমন, তবে খানিকটা উত্তরণ-অভিমুখীও বটে| বেশ-বেশ ভালো গল্প|
(২) দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য-র শেষ বিচার: কল্পবিজ্ঞানের মোড়কে এই অসামান্য বড়ো গল্পটি এই বইয়ের সেরা লেখা, এবং সাম্প্রতিককালে আমার পড়া অন্যতম সেরা কাহিনিও বটে| তবে খুব-খুব আশায় আছি যে লেখক তাঁর এই কল্পকাহিনিগুলোকে একত্রিত করে গ্রন্থবদ্ধ করবেন অদূর ভবিষ্যতে|
(৩) মহুয়া মল্লিক-এর শূন্য গর্ভ: ঝুল|
(৪) দেবাশিস বন্দোপাধ্যায়-এর নিভৃতে যতনে: বোরিং|
(৫) অভীক দত্ত-র শুরুয়াৎ: সলিড লেখা| ওয়েবজিনে আর এখানে-ওখানে এনার যত লেখা পড়েছি, তার মধ্যে খুব উঁচু দিকে থাকবে এই গল্পটা| একটাই আক্ষেপ, এমন টানটান আর প্রায় শ্বাসরোধী গদ্য লেখার ক্ষমতা নিয়েও ইনি পলিটিক্যাল থ্রিলার (নষ্ট সময়ের উপাখ্যান স্মর্তব্য) আরও বেশি করে লেখেন না কেন|

দ্বিতীয় বইটি হল সৃষ্টি গল্প প্রতিযোগিতা, সেপ্টেম্বর ২০১৩- উপলক্ষে শীর্ষ স্থানাধিকারী এবং উল্লেখযোগ্য গল্পের সংকলন| অনেক গল্প যেখানে জমা হয় সেখানে কিছু হিট কিছু মিস থাকবেই, এই বইয়ের গল্পরাও তার ব্যতিক্রম নয়| তবে যেটা দেখে (ও পড়ে) বেশ হতাশ হলাম সেটা হচ্ছে তথাকথিত টপ টেন-এর বেশির ভাগ গল্পই খুব দুর্বল, এবং চালাকির দ্বারা মহৎ কার্য করায় (অর্থাৎ পরীক্ষানিরীক্ষার নাম ‘গল্প’ জিনিসটাকে বিসর্জন দেওয়ায়) তত্পর| এতে যেসব গল্প আছে তারা হল:
প্রথম দশ: -
১) সংহিতা মুখোপাধ্যায়-এর সুকন্যা বৃত্তান্ত: আহামরি নয়, কিন্তু ভালো|
২) সৌরাংশু সিংহ-র সত্যি: গল্পের মধ্যে গল্পটা বেশ জমেছিল, কিন্তু শেষটা কেমন হুড়মুড় করে থেমে গেল|
৩) হৃষীকেশ বাগচী-র আর্যরক্ত: জালি|
৪) শাশ্বতী ভট্টাচার্য-র ডিয়ার মিস্টার কভি: পচা|
৫) সুপ্রিয় সাহা-র অতনুর নামগন্ধ: পরীক্ষামূলক গল্প| আমার ভালো লাগেনি|
৬) উল্কা-র বি-দূষকম মূড়োকাবচনম: আরেকটি পরীক্ষামূলক এবং মূলত আঁতেল-মনস্ক গল্প, যা আমার অত্যন্ত বাজে লেগেছে|
৭) এশরার লতিফ-এর স্ফটিক বাড়ি: ভালো| বেশ ভালো|
৮) জয়াশীষ ঘোষ-এর বোধন: বেশি লম্বা, তবে শেষে চমক আছে|
৯) অভ্র পাল-এর চিড়: রাবিশ|
১০) শংকর সেন-এর ঘুষ: বোরিং|
১১) মোজাফফর হোসেন-এর গল্পগুলো পাথরের: এই গল্পটা এজন্যেই উল্লেখযোগ্য যে এমন রদ্দি গল্পও লেখক প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছেন, আর সেটা অত্যাধুনিক বিচার-পদ্ধতিতে ওপরের দিকে এসেও গেছে|
১২) মাহফুজ পারভেজ-এর মোহনা: যাচ্ছেতাই!

বিশেষ উল্লেখ:
১. অদিতি ভট্টাচার্য্য-র “গল্পের খোঁজে”: ভালো|
২. অনিরুদ্ধ সেন-এর “একটি ভালোমানুষের গপ্পো”: আহা, এমন ইচ্ছাপূরণের আর মন-ভালো করা আরও গল্প যদি পড়তে পেতাম!
৩. অলোকপর্ণা-র “দশ ফুট বাই দশ ফুট”: পরীক্ষামূলক, তথা আঁতেলদের জন্যে লেখা|
৪. আষিক-এর “বিড়ালমনস্কতা”: আরও একটি আঁতেলপাঠ্য লেখা|
৫. ঋষি সৌরক-এর “শু”: এই জিনিসও এখন ‘গল্প’ বলে চিহ্নিত হচ্ছে তাহলে!
৬. কিশোর ঘোষাল-এর “স্তন্যডায়িনি”: ভয়াবহ, নির্মম, নৃশংস, এবং পড়ার পর থম-মারিয়ে দেওয়া এই জিনিস থেকে আমি এমনিতে আলোকবর্ষ দূরে থাকা পাবলিক, কিন্তু “ফর দ্য আঁতেলজ, অফ দ্য আঁতেলজ, বাই দ্য আঁতেলজ” লেখার ভিড়ে এমন একটা জিনিস পেয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম| লেখককে, এবং তাঁর অন্যান্য লেখাকে, খুঁজে বের করতে হবে এখন|
৭. প্রতীক মিত্র-র “শিবপুরাণ”: ধুস!
৮. বিতান চক্রবর্তী-র “পরলেই রাজা”: পড়া যায়, তবে ওই অবধিই|
৯. মৌ দাশগুপ্তা-র “কোনও এক গাঁয়ের কথা”: সপ্রতিভ ও বুদ্ধিমান ড্রাইভারের চালানো একটি দ্রুতগামী গাড়ির সওয়ারি হয়ে খাদে পড়লে যেমন লাগে, গল্পটা শেষ করে তেমনই লাগল|
১০. মুরাদুল ইসলাম-এর “মার্চ করে চলে যাওয়া একদল কাঠবিড়ালি ও খয়েরি ঘাসফড়িং”: দুর্বোধ্য ও আঁতেলপাঠ্য|
১১. সর্বজয়া-র “বেণুগোপালের লাঠি”: কী হইতে কী হইয়া গেল, ‘গল্প’ (?) ফুরাইল, অর্থ বুঝিলাম না| ধুত!
১২. বচন ফকির-এর “বিদূষকের প্রবেশ”: জমেও জমল না, কারণ শেষটা আরোপিত হয়েই সব ছড়িয়ে গেল|


মোদ্দা কথা, অনেক গল্প পড়েছি| কিছু-কিছু গল্প আলাদা করে রেখে দিয়েছি ফিরে-ফিরে পড়ার জন্যে| এখন এটাই দেখার যে “সৃষ্টি” গল্প-প্রতিযোগিতার পরবর্তী সংস্করণ থেকে আমরা কেমন গল্প পাই| ইতিমধ্যে মেলায় গিয়ে ৪৯৩ নম্বর স্টলে পৌঁছতে পারলে প্রথম বইটা, মানে “পাঁচটি নভেলা” (যার তিনটে লেখাতেই বইয়ের দাম উশুল হয়েও কিছু থাকবে) কিনতে ভুলবেন না: এটাই আমার বিনীত পরামর্শ| যদি দ্বিতীয়টাও কিনতে চান, তবে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: যে গল্পগুলো আমি বোল্ড করে দিয়েছি, তার বাইরে কিছু পড়লে দায়িত্ব আপনার|

পাঠ শুভ হোক|

5 comments:

  1. 'পাঁচটি নভেলা' পড়েছি। তোমার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে মতামত। অভীকের লেখার স্মার্ট স্টাইলটা গল্পটা পাঠকের ঘাড় ধরে পড়িয়ে নেয়। কিন্তু আরো আরো লেখা যে কেন নেই তাঁর! দেবাশিসবাবুর গল্পটা সেই প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়-ঘরানার। জমেনি। মহুয়া মল্লিকের গল্প মামুলি প্লটকে অযথা দীর্ঘ করা। ছোট হলে ভাল হত হয়তো। সৈকতদা ও দেবজ্যোতিদা তো কেয়াবাত গল্পকার! ভাল লেগেছে।
    অন্য সঙ্কলনটি আমি পড়িনি। তবে কিশোর ঘোষালের গল্প প্রথম পড়ি দেশ-এর পাতায়। চমকে গিয়েছিলাম। খুব ভাল লেগেছিল।

    ReplyDelete
  2. আমিও কিশোর ঘোষালের লেখা "দেশ"-এ পড়েছিলাম। স্টানিং বিশেষণটা এঁনার লেখায় প্রযোজ্য।

    ReplyDelete
  3. আপনার চাঁচাছোলা গল্পবিচার ভালো লাগলো। কিন্তু কোনও গল্পই না পড়া হওয়ায় ঐ ঝুল, বোরিং, জালি, পচা, রাবিশ ও যাচ্ছেতাই-এর আপেক্ষিক অনুৎকর্ষতা ঠিক আইডিয়া করতে পারলাম না। শুধু বুঝলাম পরিত্যজ্য।

    ReplyDelete