ল্যামার্কের
সূত্র মেনে অব্যবহারে ক্ষয়প্রাপ্ত অঙ্গের মতো আমার এই ব্লগ নিয়ে আজ আরেকবার বসা
গেল। এবারের লেখাটা আমার এক বন্ধু-কাম-ভাইয়ের লেখালেখি নিয়ে।
আপনারা সৌরভ নামে ক’জনকে চেনেন?
বাঙালিদের
মধ্যে এই নামটাকে মোটামুটি কমন বলা যায়, তাই এই নামে আপনারা যে একাধিক ব্যক্তিকে
চিনবেন, সেটাই স্বাভাবিক।
আমি কাদের
চিনি?
(১) সৌরভ গাঙ্গুলি: ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম অধিনায়ক, এবং
বিশ্বক্রিকেটে বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই খেলোয়াড়টির আলাদা
করে পরিচয় দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যদি কেউ দাবি করেন যে তিনি এঁকে চেনেন না,
তাহলে, মা কসম! চুন-চুনকে মারুংগা!
(২) সৌরভ গাঙ্গুলি: আমার শালা। বিশ্বাস করুন, ইয়ার্কি মারছি না, গালাগালও দিচ্ছি
না। আমার বউয়ের মাসতুতো ভাইয়ের নাম এটাই।
(৩) সৌরভ
মুখোপাধ্যায়: এই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক, যাঁর কাছ
থেকে আমরা পেয়েছি ‘ধুলোখেলা’, ‘সংক্রান্তি’-র মতো অসাধারণ উপন্যাস, এবং অবিস্মরণীয়
কিছু ছোটোগল্প।
(৪) সৌরভ দত্ত: মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য-র বিভিন্ন রচনা এবং অলঙ্করণ নিয়ে “মনোরঞ্জন মিউজিয়াম”,
প্রেমেন্দ্র মিত্র-র রচিত অদ্বিতীয় চরিত্র ঘনাদা-র বিভিন্ন কাহিনি প্রকাশের সঙ্গে
জড়িত তথ্য এবং অমূল্য সব অলঙ্করণ নিয়ে “ঘনাদা গ্যালারি”, এবং সামগ্রিক ভাবে
কৌতূহলোদ্দীপক এবং দুর্লভতম তথ্য ও অলঙ্করণের সমাহার “ব্লোগাস”-এর প্রাণপুরুষ হলেন
এই মানুষটি।
বাংলা সাহিত্যের হারিয়ে যাওয়া ও ভুলে যাওয়া নানা দিকের
সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া এই নীরব ও অনলস মানুষটির সঙ্গে পরিচয় হওয়াটা আমি
আমার সোশ্যাল মিডিয়া জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি বলেই মনে করি।
(৫) সৌরভ চক্রবর্তী: আজকের
পোস্ট এই অনুজপ্রতিম তরুণের লেখালেখি নিয়েই।
আগরতলা থেকে
প্রকাশিত ‘ব্ল্যাকবোর্ড’ নামক বিশিষ্ট পত্রিকার সম্পাদক এই মানুষটি নিজেও যে একজন
দক্ষ সাহিত্যিক তা জানতে আমার বেশ সময় লেগেছিল। মানুষটি লেখেন খুবই কম, তাও
প্রচারের ঢক্কা-নিনাদ থেকে দূরে থাকা পত্রপত্রিকায়। তাই তাঁর লেখাগুলো পাঠকের
রাডারের নিচেই থেকে যায়।
বড়োদের লেখায়
যথেষ্ট দড় সৌরভ রহস্য, রোমাঞ্চ, অলৌকিক সাহিত্যে পদচারণা করছেন আজ বেশ কয়েক বছর
ধরে, যার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে মূলত ‘ব্ল্যাকবোর্ড’ পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন লেখায়,
যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ “হোরেশিও, এমনি এক গল্প”, “ইক্লিপ্স”, “চতুর্থ স্তম্ভ”,
এবং “কংক্রিট”।
শিশু-কিশোর
সাহিত্যের অঙ্গনে সৌরভ পা রেখেছেন কম দিনই। আজকের এই পোস্টে আমি শিশু-কিশোর সাহিত্যে
তাঁর যাত্রাপথের একটা ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
পথ-চলতে শুরু
করা যেকোনো শিশুর মতো এই লেখাগুলোয় লেখকের কলম বা আঙুল প্রথমে থেকেছে আড়ষ্ট এবং
টলায়মান। কিন্তু একটু-একটু করে লেখক তাঁর নিজস্ব ভাষা খুঁজে পেয়েছেন, এবং উপহার
দিয়েছেন একবার ধরলে শেষ না করে থামা যায়না, এমন বেশ কিছু গল্প।
১] বিট্টুর চিঠিঃ
বিট্টু নামে এক কৈশোরের দরজায় কড়া নাড়া শিশুর এই গল্পটা তার এক বন্ধুর সঙ্গে হওয়া
বন্ধুত্ব নিয়ে খুব সরল ভাবে এগিয়েছে। কিন্তু গল্পটা ব্যতিক্রমী হয়েছে আপাতভাবে
অলৌকিক উপাদান এতে মিশে গিয়ে তাকে কিছুটা ওপন-এন্ডেড করে দেওয়ার জন্যে।
২] মুখার্জিবাবুর গ্যাজেটঃ “কিচিরমিচির” পত্রিকার বৈশাখ ১৪২২
সংখ্যায় প্রকাশিত এই গল্পটা দিয়ে লেখক আরো একবার প্রমাণ করে দেন যে আপাত সহজ ছকের
মধ্যেও তিনি শিশু-কিশোর সাহিত্যে এমন কিছু উপাদান নিয়ে আসতে চাইছেন, যা সচরাচর
দেখা যায় না।
গল্পের
বিষয়বস্তু এরকমঃ বিজ্ঞান শিক্ষক প্রতুলবাবু বেশ কিছুদিন ধরে অনিদ্রায় ভুগছেন।
ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুমোতে না পারা প্রতুল তাঁর ভাইপো বিট্টুকে নিয়ে এলেন এক দূরের
বাংলোবাড়িতে। সেখানে মুখার্জিবাবু নামে জনৈক বিজ্ঞানীর আবিষ্কৃত একটি ঘড়ির মতো
চেহারার যন্ত্র পাওয়া গেল ঝোপের মধ্যে, যা হাতে পড়লেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সংশ্লিষ্ট
ব্যক্তি। এই গ্যাজেট কি পারবে প্রতুলবাবুর হারিয়ে যাওয়া ঘুম ফিরিয়ে দিতে?
বিজ্ঞান,
সিউডো-সাইন্স, এবং মনস্তত্ত্ব দিয়ে সহজ ভঙ্গিতে একটা টানটান গল্প সাজিয়েছেন লেখক
এখানে।
৩] বিট্টুর বাবুই কাণ্ডঃ “কিচিরমিচির” পত্রিকার ২০১৫ উৎসব
সংখ্যায় প্রকাশিত এই গল্পটা কিন্তু একেবারেই সহজ-সরল, এবং যেসব পাখিদের দিকে আমরা
এমনিতে তাকাইও না, তাদের প্রতি ছোটোদের মধ্যে কৌতূহল এবং ভালোবাসা জাগানোর
উদ্দেশ্য নিয়েই লেখা।
৪] মার্জার বিভীষিকাঃ “কাকলি” পত্রিকার ১৪২২ পুজো সংখ্যায়
প্রকাশিত এই গল্পটা পড়া শুরু করে একেবারে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে হয়। এই গল্পের
কাঠামোটিও আদ্যন্ত মনস্তাত্ত্বিক, এবং প্রাপ্তমনস্ক পাঠকের জন্যেই।
এক দুর্ঘটনার
পর উদীয়মান লেখক রথিনের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল বেড়ালের ভয়ে। পরিবেশের বদল হলে
অবস্থা বদলাবে, এই আশায় শহর থেকে দূরে এক বাংলোয় এল রথিন। কিন্তু সেখানেও তার পিছু
নিল বেড়ালের থাবার ছাপ! তারপর কী হল?
লেখনীর
যৎকিঞ্চিত শিথিলতা নিয়েও এই গল্পটি রোমাঞ্চলোভী পাঠকের মন জয় করবেই।
৫] শেষ গল্পঃ “কিচিরমিচির” পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যায়
(এপ্রিল ২০১৬) প্রকাশিত হয় এই গল্পটি।
কন্সট্রাকশনের
কাজ নিয়ে দিল্লির উপকন্ঠে যাওয়া এক ইঞ্জিনিয়ার তার প্রতিবেশীর রোজকার আচরণে এমন
একটা অস্বাভাবিক জিনিস দেখল যে সে তার সঙ্গে আলাপ করল ব্যাপারটা ভালো ভাবে জানার
জন্যে। সেই প্রতিবেশীর কাছে সে এমন একটা বই পেল যার গল্পগুলো অসম্পূর্ণ, অথচ বইটির
পাঠক স্বপ্নে গল্পটার শেষ দেখতে পায়, আর প্রতিটি গল্পই শেষ হয় মৃত্যু দিয়ে। তারপর
কী হল?
টানটান গতি,
নির্মেদ সংলাপ, মজবুত কাঠামো, আর রুদ্ধশ্বাস সাসপেন্সঃ এই দিয়ে গড়ে ওঠা এই গল্পটি
বাংলায় শিশু-কিশোর সাহিত্যের এক বিরল সম্পদ।
৬] ত্রিমাত্রিক ভয়ঃ “সন্দেশ”
পত্রিকার জুলাই ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এই গল্পটি।
আগরতলা ছেড়ে দীর্ঘদিন কলকাতাবাসী মনোহর সিদ্ধান্ত নিলেন,
তাঁর পৈতৃক বাড়ি, এতদিন যার রক্ষণাবেক্ষণ তথা ভোগদখল করে এসেছেন ছোটোবেলার বন্ধু
ভোলা, এবার তিনি বেচে দেবেন তাঁর ভগ্নিপতিকে। সব ঠিকঠাক, কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়াল
বাড়ির লাগোয়া আট থামওয়ালা চালাটি।
কেন? কীভাবে? আর রহস্যের সমাধান হল কেমন করে?
রহস্য-রোমাঞ্চ, আর তার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও যুক্তিকে পছন্দ
করা ছোটোরা যে এই গল্প খুব-খুব ভালোবাসবে, এ নিয়ে আমি নিশ্চিত।
৭] সুনন্দ
আর সবুজ বজ্রঃ “কিচিরমিচির” পত্রিকার ২০১৬ উৎসব সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে এই
গল্পটি।
গ্রামের ফাঁকিবাজ ছেলে সুনন্দ এক রাতে জানলা দিয়ে বাইরের
ঝড়বৃষ্টি দেখছিল। হঠাৎ সে দেখল, একটা সবুজ আলো পড়ল কিছুটা দূরের ঝোপঝাড়ে। সক্কাল
হতেই সেখানে গিয়ে সে খুঁজে পেল সবুজ আলোর দ্যূতি ছড়ানো বাজ-এর মতোই চেহারার একটা
জিনিস। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সে বুঝতে পারল, আশ্চর্য ক্ষমতা আছে সেই সবুজ বজ্রের।
তারপর কী হল?
কল্পবিজ্ঞান, ফ্যান্টাসি, ইচ্ছাপূরণ, আর বড়ো হওয়ার এই
সহজ-সুন্দর গল্পটা পড়তে পেয়ে মন ভরে যায়।
আমার এই সংক্ষিপ্ত পোস্ট পড়ে সৌরভের লেখার বিষয়গত বৈচিত্র্য,
এবং কাহিনির নির্মাণকুশলতা বোঝা মুশকিল। আরো কঠিন প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকের জন্য লেখায়
তাঁর দক্ষতার আন্দাজ পাওয়া, যেহেতু তাদের নিয়ে এযাত্রা কিছু লেখা গেল না। হয়তো পরের বার...
আপনারা যদি ওঁর লেখা পড়তে চান, তবে কিচিরমিচির পত্রিকাটি
জোগাড় করার চেষ্টা করুন। অনেকগুলো ভালো লেখা সেখানেই পেয়ে যাবেন।
আশা রাখি যে পাঠকের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সম্পাদকদের উৎসাহে
সৌরভ তাঁর লেখা দিয়ে আমাদের আমোদিত করে চলবেন আরো অনেক-অনেক দিন।